আগামী ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে গাইবান্ধা-২ (সদর) আসনে ভোটের জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী। এরই মধ্যে জেলা আমির ও সদর উপজেলা পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান মো. আব্দুল করিম সরকারকে প্রার্থী ঘোষণা করেছে দলটি। তাদের নেতাকর্মীরা সংগঠনকে বিস্তারের জন্য দাওয়াতি কাজ চালিয়ে যাচ্ছেন। সেইসঙ্গে দলীয় প্রার্থীর পক্ষে ভোটও চাইছেন। বর্তমানে নিবন্ধনের সঙ্গে দলীয় প্রতীক দাঁড়িপাল্লাও ফিরে পেয়েছে জামায়াত। ফলে প্রচারণায় গতি এসেছে।
Advertisement
অন্যদিকে বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় রাজনৈতিক দল বিএনপির নেতাকর্মীরা হাইকমান্ডের নির্দেশের অপেক্ষায়। এই আসনে এখনো প্রার্থী ঠিক করেনি দলটি। বিগত ১৬ বছরের নির্যাতনের অবসানের পর নিজেদের অবস্থান শক্তিশালী করতে সাংগঠনিক কার্যক্রম অব্যাহত রেখেছে তারা।
অন্যদিকে ছাত্র-জনতার রোষানলে আওয়ামী সভানেত্রী শেখ হাসিনা দেশ থেকে পালিয়ে যাওয়ার পর তার দীর্ঘদিনের জোটসঙ্গীরাও আতংকে আছেন। তাদের ভোটের মাঠে নামার এখনো কোনো প্রস্তুতি চোখে পড়েনি। বিগত তিনটি বিতর্কিত জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের সঙ্গী জাতীয় পার্টি, জাসদ, ওয়ার্কার্স পার্টিসহ মহাজোটের নেতাকর্মীরা বিভিন্ন সামাজিক সংগঠনের সঙ্গে প্রকাশ্যে চলাফেরা করলেও তাদের ভোট নিয়ে কোনো চিন্তা নেই। এ দলগুলোর অনেকে বিএনপি-জামায়াতে আশ্রয় নিয়েছেন বলে অভিযোগ আছে।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে নেতৃত্ব দেওয়া ছাত্রদের দল জাতীয় নাগরিক পার্টিসহ (এনসিপি) স্বৈরাচার হাসিনাবিরোধী আন্দোলনে শরিকদের কেউ ভোটের মাঠে নেই।
Advertisement
গাইবান্ধা সদর উপজেলাকে কেন্দ্র করে গাইবান্ধা-২ আসন গঠিত। জেলা সদরের কারণে সব রাজনৈতিক দলের কাছে এ আসনটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। তাই এ আসনটি নিজেদের দখলে নিতে চায় সবাই। বর্তমানে এই আসনটিতে বিএনপির সঙ্গে ভোটের মাঠে লড়াইয়ের প্রস্তুতি নিচ্ছে অন্যরা। ভোট নিয়ে সবার মাঝে ব্যাপক আগ্রহ লক্ষ্য করা গেছে।
আরও পড়ুন
হেভিওয়েট নেতায় ভরসা বিএনপির, আসন উদ্ধারে মরিয়া জামায়াত বগুড়াসহ তিন আসনে লড়তে পারেন খালেদা জিয়াভোটাররা বলছেন, বিগত তিনটি বিতর্কিত জাতীয় নির্বাচনে সাধারণ জনগণ ভোট দিতে পারেনি। দিনের ভোট রাতে হয়েছে। আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন অবাধ ও সুষ্ঠু হলে সৎ, যোগ্য প্রার্থীদের ভোট দিয়ে নির্বাচিত করা সম্ভব হবে।
স্বৈরাচার হাসিনাসহ মানুষ হত্যার সঙ্গে যারা সম্পৃক্ত তাদের বিচার করাসহ দেশ সংস্কার করে নির্বাচনের আয়োজন করতে হবে। ভোটাধিকার প্রয়োগের পরিবেশ পেলেই জনগণ তার পছন্দের প্রার্থীকে ভোট দিয়ে নির্বাচিত করতে পারবে।
Advertisement
এ আসনের ভোটার আতিকুর রহমান বলেন, স্বৈরাচার হাসিনাসহ মানুষ হত্যার সঙ্গে যারা সম্পৃক্ত তাদের বিচার করাসহ দেশ সংস্কার করে নির্বাচনের আয়োজন করতে হবে। ভোটাধিকার প্রয়োগের পরিবেশ পেলেই জনগণ তার পছন্দের প্রার্থীকে ভোট দিয়ে নির্বাচিত করতে পারবে।
জেলা বিএনপির সাংগঠনিক সম্পাদক মোশাররফ হোসেন বাবু বলেন, বিএনপি হচ্ছে নির্বাচনমুখী দল। নির্বাচনের জন্য বিএনপি সবসময় প্রস্তুত। সংগঠনের কাজ অব্যাহত রাখছি। সংগঠনকে শক্তিশালী করার জন্য বিভিন্ন ইউনিটে কাউন্সিল হচ্ছে। কাউন্সিলের মাধ্যমে আমরা জনগণের সঙ্গে সম্পৃক্ত হচ্ছি। তবে ভোটের জন্য আমরা প্রস্তুতি নিয়েছি। শুধু হাইকমান্ডের নির্দেশনার অপেক্ষায়।
এ আসনে সম্ভাব্য প্রার্থী হিসেবে কেন্দ্রীয় বিএনপির গ্রাম বিষয়ক সম্পাদক আনিছুজ্জামান খান বাবু, জেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক মাহমুদুন্নবী টিটুল, জেলা বিএনপির সিনিয়র সহ-সভাপতি প্রয়াত খন্দকার আহাদ আহম্মেদের স্ত্রী শায়লা ইসলামসহ অনেকের নাম শোনা যাচ্ছে।
আরও পড়ুন
৪২ শতাংশ সনাতন ধর্মাবলম্বী ভোটারই নির্ধারণ করবে জয়-পরাজয় ফখরুলের প্রতিদ্বন্দ্বী জামায়াতের দেলাওয়ার, আছেন স্বতন্ত্ররাওবিএনপির তৃণমূল নেতাকর্মীরা বলছেন, ১৬ বছরের জেল, জুলুম নির্যাতনের শিকার নেতাকর্মীদের যারা মূল্যায়ন করবে তাদের দল থেকে মনোয়ন দিতে হবে। যারা দলের দুঃসময়ে ছিল না, ৫ আগস্টের পর দলের সাবেক নেতা হিসেবে নেতাকর্মীদের কাছে দাবি করছেন। তাদের দল থেকে মনোয়ন না দেওয়ারও পরামর্শ দেন তারা।
এ আসনে বিএনপি থেকে মনোনয়ন পেতে কাজ করছেন গাইবান্ধা জেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক মাহমুদুন্নবী টিটুল। তিনি বলেন, ‘আমি পারিবারিকভাবে জাতীয়তাবাদী রাজনীতির সঙ্গে জড়িত। স্বৈরাচারের শাসন আমল থেকে দীর্ঘ সময় ধরে জেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করছি। খুব কাছ থেকে বিএনপি নেতাকর্মীদের জেল-জুলুম, অত্যাচার-নির্যাতন ও নিপীড়ন সহ্য করতে দেখেছি। আমি নিজেও এসবের শিকার হয়েছি। আমাকে মনোনয়ন দিলে দলের সব নির্যাতিত নেতাকর্মীকে মূল্যায়ন করতে পারবো।’
এ আসনে সম্ভাব্য প্রার্থী হিসেবে কেন্দ্রীয় বিএনপির গ্রাম বিষয়ক সম্পাদক আনিছুজ্জামান খান বাবু, জেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক মাহমুন্নবী টিটুল, জেলা বিএনপির সিনিয়র সহ-সভাপতি প্রয়াত খন্দকার আহাদ আহম্মেদের স্ত্রী শীলা ইসলামসহ অনেকের নাম শোনা যাচ্ছে।
প্রয়াত বিএনপি নেতা খন্দকার আহাদ আহম্মেদের স্ত্রী শায়লা ইসলাম বলেন, আমার স্বামী দীর্ঘদিন থেকে বিএনপির রাজনীতির সঙ্গে জড়িত ছিলেন। তিনি এই আসনে বিএনপির মনোনয়নপ্রত্যাশী ছিলেন। মৃত্যুর আগ পর্যন্ত তিনি নেতাকর্মীদের পাশে ছিলেন। আমিও আমার স্বামীর সঙ্গে বিভিন্ন গ্রামগঞ্জে ভোটের মাঠে ঘুরেছি। তৃণমূল পর্যায়ে বিএনপির নেতাকর্মীসহ সাধারণ মানুষের দুঃখ-কষ্ট আমি বুঝি। আমি তাদের সঠিকভাবে মূল্যায়ন করতে পারবো। আশা করছি দল আগামী জাতীয় নির্বাচনে আমাকে দলীয় মনোনয়ন দেবে। মনোনয়ন পেলে সর্বোচ্চ ভোটে নির্বাচিত হয়ে এ আসনটি দলকে উপহার দেব।
আরও পড়ুন
নবীন-প্রবীণে ভোটের লড়াইয়ের প্রস্তুতি নতুন প্রার্থীদের ব্যাপক প্রচারণাজামায়াতে ইসলামীর জেলা সহকারী সেক্রেটারি ফয়সাল কবির রানা বলেন, বিগত সরকার প্রহসনের তিনটি নির্বাচন করেছে- জনগণের সঙ্গে তামাশা করেছে- জনগণকে প্রাধান্য দেয়নি। আমরা আশা করছি বর্তমান সরকার নির্বাচনের একটি উত্তম পরিবেশ তৈরি করতে সক্ষম হবে- প্রশাসন সমাজের সৎ ও যোগ্য ব্যক্তিকে সম্মানের জায়গায় রাখবে। জামায়াতে ইসলামী একটি নিয়মতান্ত্রিক ও গণতান্ত্রিক সংগঠন, এই সংগঠনের গণতান্ত্রিক চর্চা অনেক শক্ত সামনে নির্বাচনের জন্য আমরা প্রার্থী পরিচিতির পাশাপাশি ভোটকেন্দ্রভিত্তিক গণসংযোগের কাজ চলমান।
তিনি আরও বলেন, এ আসন থেকে জেলা জামায়াতের আমির ও সদর উপজেলা পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান মো. আব্দুল করিম সরকারকে একক প্রার্থী হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছে। জামায়াত বরাবরই সমাজসেবার মাধ্যমে জনগণের পাশে থাকার চেষ্টা করে। জনগণের সঙ্গে আমাদের যোগাযোগ অব্যাহত আছে- জনগণও গাইবান্ধায় জামায়াতে ইসলামীর প্রার্থীদের ব্যাপারে ইতিবাচক। মূলত জামায়াত এখন গণমানুষের সংগঠনে পরিণত হয়েছে।
এ আসনে ১৯৭৩ সালে প্রথম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী হিসেবে লুৎফর রহমান সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। তিনি ১৯৭৯ সালে দ্বিতীয় জাতীয় সংসদ নির্বাচন ও ২০২১ সালে অষ্টম জাতীয় সংসদ সদস্য ছিলেন। ১৯৮৬ সালে তৃতীয় জাতীয় সংসদ নির্বাচনে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে আব্দুর রউফ মিয়া গাইবান্ধা-২ (সদর) আসন থেকে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন।
১৯৮৮ সালে চতুর্থ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে অবসরপ্রাপ্ত মেজর আজগার আলী খান সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। ১৯৯১ সালের পঞ্চম সংসদ ও ১৯৯৬ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে ষষ্ঠ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে সংসদ সদস্য হিসেবে নির্বাচিত হন বিএনপি নেতা সাইফুল আলম সাজা। তিনি মাত্র চারমাস সংসদ সদস্য ছিলেন। ১৯৯৬ সালের জুন মাসের সপ্তম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে জাতীয় পার্টির মনোনয়নে লাঙ্গল প্রতীক নিয়ে আব্দুর রশীদ সরকার সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছিলেন।
এ আসন থেকে জেলা জামায়াতের আমির ও সদর উপজেলা পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান মো. আব্দুল করিম সরকারকে একক প্রার্থী হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছে। জামায়াত বরাবরই সমাজসেবার মাধ্যমে জনগণের পাশে থাকার চেষ্টা করে। জনগণের সঙ্গে আমাদের যোগাযোগ অব্যাহত আছে- জনগণও গাইবান্ধায় জামায়াতে ইসলামীর প্রার্থীদের ব্যাপারে ইতিবাচক। মূলত জামায়াত এখন গণমানুষের সংগঠনে পরিণত হয়েছে।
২০১৪ সালের দশম জাতীয় নির্বাচনে তিনি জাতীয় পার্টির মনোনয়ন পেলেও প্রত্যাহার করেন। ২০১৮ সালের একাদশ জাতীয় নির্বাচনে বিএনপির মনোনয়ন পেয়ে ধানের শীষ প্রতীক নিয়ে পরাজিত হন। ওই রাতেই বিজয়ী আওয়ামী লীগের সংসদ সদস্য মাহবুব আরা বেগম গিনিকে ফুল দিয়ে শুভেচ্ছা জানিয়ে বিএনপি থেকে পদত্যাগ করেন। পরদিন আবার জাতীয় পার্টিতে যোগদান করেন। ২০২৪ সালে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে মহাজোটের একক প্রার্থী হয়ে নির্বাচনে অংশ নেন। ওই নির্বাচনে আওয়ামী লীগসহ জোটসঙ্গী ১৪ দলের হয়ে ভোটের মাঠে কাজ করেও তিনি পরাজিত হন।
আরও পড়ুন
প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে সিইসির সাক্ষাৎ দীর্ঘদিনের মিত্র জামায়াতের সঙ্গেই লড়াই হবে বিএনপির২০০৮ (নবম), ২০১৪ (দশম) ও ২০১৮ (একাদশ) সালে আওয়ামী লীগ থেকে সংসদ সদস্য হিসেবে নির্বাচিত হয়েছেন মাহাবুব আরা বেগম গিনি।
২০২৪ সালের দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে এই আসন থেকে আওয়ামী লীগ নেতা শাহ সারোয়ার কবির স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে নির্বাচিত হন। ৫ আগস্ট ২০২৪ সালে ছাত্র-জনতার আন্দোলনের মুখে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পদত্যাগ করে ভারত পালিয়ে যান। পরদিন ৬ আগস্ট রাষ্ট্রপতি সংসদ ভেঙে দিলে শাহ সারোয়ার কবির সংসদ সদস্য পদ হারান।
এ আসনে পুরাতন ভোটার ৩ লাখ ৮৭ হাজার ২৯১। এবার নতুন করে ভোটার হয়েছেন ২৩ হাজার ৮১। তৃতীয় লিঙ্গের (হিজড়া) ভোটার ছয়জন। এ আসনে আগামী ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ৪ লাখ ১০ হাজার ৩৭২ ভোটার তাদের ভোটাধিকার প্রয়োগ করবেন।
এএনএইচএস/এসএইচএস/এমএফএ/এমএস