কৃষি ও প্রকৃতি

বিলুপ্তির পথে বাড়িয়াদীর কোন্দা শিল্প

বিলুপ্তির পথে বাড়িয়াদীর কোন্দা শিল্প

গাজীপুরের কালীগঞ্জ উপজেলার জাংগালিয়া ইউনিয়নের ছোট্ট একটি গ্রাম বাড়িয়াদী। এ গ্রামের পরিচয় একসময় ছিল অন্যরকম। এটি ছিল কোন্দা তৈরির স্বনামধন্য গ্রাম। বর্ষার মৌসুম এলেই যেন নতুন প্রাণ ফিরে পেতো গ্রামটি। শতাধিক পুরুষ মেতে উঠতো কোন্দা তৈরির কাজে। তালগাছ থেকে কেটে, ঘঁষে, ছেঁটে নিখুঁতভাবে তৈরি হতো কোন্দা। একসময় দেশের নানা প্রান্তে ছড়িয়ে পড়তো। সময়ের পালাবদলে প্রযুক্তির জোয়ারে বিল-জলাশয়ের অবক্ষয়ে পরিবেশ দূষণের করুণ থাবায় বিলুপ্তির পথে এ শিল্প। বাড়িয়াদীর ঐতিহ্যবাহী কোন্দা এখন শুধুই স্মৃতির সরণি ধরে বেঁচে আছে কিছু পরিবারের মাঝে।

Advertisement

সরেজমিনে জানা গেছে, গ্রামের অধিকাংশ মানুষই পেশা পরিবর্তন করেছেন। অথচ এ গ্রামেই একসময় প্রতিটি বাড়ির উঠানে, গাছতলায় কিংবা খোলা মাঠে তালগাছ কেটে কোন্দা তৈরির দৃশ্য ছিল নিত্যদিনের। সেই ঐতিহ্যের ধারক হয়ে আজও হাতের কাজ ধরে রেখেছেন কয়েকজন কারিগর। নুরুল ইসলাম বেপারীর ছেলে আব্দুল কাদির, আফছার উদ্দিন শিকদারের ছেলে নাজমুল শিকদার এবং ফাইজুদ্দিন শিকদারের ছেলে লাল মিয়া।

প্রবীণ কারিগর হানিফ বেপারী বলেন, ‘আমাদের সময় এই গ্রামে প্রতিটি পুরুষ কোন্দা বানাতে পারতো। আমি নিজেও বাবা-চাচার সঙ্গে কোন্দা তৈরি শিখেছি। অনেক মেলায় পুরস্কারও পেয়েছি। কিন্তু এখন আর সেই চাহিদা নেই। ডিজিটালের যুগে কেউ আর কোন্দা কিনতে চায় না। কোন্দা যেন আজ স্মৃতির জিনিস।’

বর্তমান প্রজন্মের কারিগর আব্দুল কাদির ও নাজমুল শিকদার বলেন, ‘আগে প্রতিটি ঘরে কোন্দা লাগতো। বিলে মাছ ছিল, তাই সবাই মাছ ধরতে কোন্দা কিনতো। এখন তো কারখানার বর্জ্য এসে বিলের পানি নষ্ট করে ফেলেছে। মাছ নেই, ফলে কোন্দার চাহিদাও নেই। তাই আর বাণিজ্যিকভাবে বানানো হয় না। শুধু শখের বশে কিছু বানাই। বাজারে নিয়ে গেলে খুব একটা বিক্রি হয় না। কেউ কেউ বাড়িতে এসে অর্ডার দেন, সেটাই মূলত বিক্রি হয়।’

Advertisement

আরও পড়ুন বর্ষায় বীজ না কলম কোনটা বেছে নেবেন?  কলার সাত হাজার বছরের ইতিহাস 

বাড়িয়াদীর এ শিল্পের পেছনে আছে নিখুঁত দক্ষতা ও নিঃসীম ধৈর্য। একটি ভালো মানের কোন্দা তৈরি করতে লাগে এক সপ্তাহের বেশি। তালগাছ সংগ্রহ করা হয় কালীগঞ্জ, কাপাসিয়া এবং শ্রীপুরের বিভিন্ন এলাকা থেকে। এরপর নির্ধারিত দৈর্ঘ অনুযায়ী গাছ কেটে দ্বিখণ্ডিত করা হয়। একটি গাছ থেকে দুটি কোন্দা তৈরি হয়। পরিশ্রমের ফসল সেই কোন্দা প্রতি গাজীপুর মহানগরীর শনিবার পুবাইল বাজারে বিক্রি করা হয়। একটি ভালো মানের কোন্দার দাম প্রায় ১২-১৩ হাজার টাকা। বর্তমানে চাহিদা কম হওয়ায় কারিগরদের খরচই ওঠে না।

বাড়িয়াদীর কোন্দা শুধু একটি মাছ ধরার যন্ত্র নয়। এটি এ গ্রামের ইতিহাস, ঐতিহ্য, কৃষ্টির প্রতিচ্ছবি। এলাকাবাসীর ভাষায়, ‘এ কোন্দা বাড়িয়াদীকে আলাদা পরিচয় দিয়েছে। আমরা চাই, এ শিল্প যেন হারিয়ে না যায়। সরকারের বা কোনো সংস্থার সহায়তা পেলে হয়তো আবার নতুন করে ঘুরে দাঁড়াতে পারে আমাদের এ ঐতিহ্য।’

বাড়িয়াদীর কোন্দা এখন আর প্রতিদিনের প্রয়োজন নয়। তবে এটি এক সাংস্কৃতিক চিহ্ন, যা বাঁচিয়ে রাখতে পারে একটি গ্রামের ইতিহাস। কয়েকজন কারিগরের হাতে হয়তো টিকে আছে এর অস্তিত্ব। কিন্তু প্রয়োজন সামাজিক ও প্রাতিষ্ঠানিক স্বীকৃতি, সহায়তা এবং প্রচারের। না হলে অদূর ভবিষ্যতেই হয়তো ‘কোন্দা’ শব্দটাই কেবল বইয়ের পাতায় খুঁজতে হবে।

আব্দুর রহমান আরমান/এসইউ/জিকেএস

Advertisement