• রপ্তানিযোগ্য আমের ৭০ শতাংশই পূরণ করে রাজশাহী• নানান বাধায় কমেছে রপ্তানি• প্রতিবেশী দেশের তুলনায় পরিবহন খরচ বশি • ফাইটোস্যানিটারি সনদ জটিলতা
Advertisement
দেশে ও বিদেশে রাজশাহী অঞ্চলের আমের চাহিদা বেশি। বিশেষ করে যে পরিমাণ আম রপ্তানি হয়, তার ৭০ শতাংশই পূরণ হয় রাজশাহী থেকে। তবে নানা সংকটে রাজশাহীর আম রপ্তানির লক্ষ্যমাত্রা ছুঁতে পারছে না। গত তিন বছরে উৎপাদনের মাত্র ২২ দশমিক ১১ শতাংশ আম রপ্তানি হয়েছে এই অঞ্চল থেকে। ফলে বিদেশে পাঠানোর জন্য প্রস্তুত করা বিপুল পরিমাণ আম পাঠাতে না পেরে দেশের সুপারশপই শেষ ভরসা হয়ে দাঁড়িয়েছে চাষিদের।
রাজশাহী অঞ্চলিক কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের তথ্যমতে, রাজশাহী অঞ্চলে গত তিন বছরে রপ্তানিযোগ্য আম উৎপাদন হয়েছে চার হাজার ৬৪৮ মেট্রিক টন। এর মধ্যে রপ্তানি হয়েছে এক হাজার ২৭ দশমিক ৮৮ মেট্রিক টন, যা উৎপাদনের মাত্র ২২ দশমিক ১১ শতাংশ। রাজশাহী অঞ্চলে ২০২১-২০২২ অর্থবছরে রপ্তানিযোগ্য আম উৎপাদন হয়েছিল ৫৫০ মেট্রিক টন। ওইবছর আম রপ্তানি করা হয় ২২২ দশম ৮৮ মেট্রিক টন, যা উৎপানের ৪০ দশমিক ৫২ শতাংশ। আর ২০২২-২০২৩ অর্থবছরে উৎপাদন বেড়ে দাঁড়ায় দুই হাজার ৫২৮ মেট্রিক টন। ওইবছর রপ্তানি করা হয় ৬০৬ মেট্রিক টন, যা উৎপাদনের মাত্র ২৩ দশমিক ৯৭ শতাংশ। ২০২৩-২০২৪ অর্থবছরে রপ্তানিযোগ্য আম কমে উৎপাদন হয় এক হাজার ৫৭০ মেট্রিক টন। এসময় রপ্তানি হয় ১৯৯ মেট্রিক টন, যা মোট উৎপাদনের মাত্র ১২ দশমিক ৬৮ শতাংশ।
চলতি বছর রাজশাহী অঞ্চলের রপ্তানিযোগ্য আম উৎপাদন হয়েছে ছয় হাজার ৭২০ মেট্রিক টন। এরমধ্যে রাজশাহীতে ২০০ মেট্রিক টন, চাঁপাইবানাবগঞ্জে ৬ হাজার, নওগাঁয় ৫০৫ এবং নাটোরে উৎপাদন হয়েছে ১৫ মেট্রিক টন। চলতি বছরে আমের রপ্তানি মৌসুম শুরু হলেও তেমন রপ্তানি করতে পারেনি রাজশাহী অঞ্চল থেকে। চাঁপাইনবাবগঞ্জ থেকে রপ্তানি হয়েছে মাত্র ১৭ মেট্রিক টন। আর নওগাঁ থেকে রপ্তানির পরিমাণ মাত্র ৪ দশমিক ৮ মেট্রিক টন। অর্থাৎ চলতি বছরে আম রপ্তানি হয়েছে মাত্র ২১ দশমিক ৮ মেট্রিক টন। ফলে বিপুল পরিমাণ আম এবারও থেকে যাবে রপ্তানির বাইরে।
Advertisement
‘আমরা ভালো আম উৎপাদন করি। এক্সপোরটাররা আমাদের কাছ থেকে নিয়ে যান। কিন্তু দিন দিন আমাদের চাষি কমছে। বর্তমানে আমাদের সংগঠনে ১০০ জনের মতো আছেন। এর আগে অনেক বেশি ছিল। কিন্তু আম রপ্তানি করতে না পেরে অনেকেই সরে যাচ্ছেন।’
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, আম রপ্তানিতে সরকারিভাবে একটি প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়েছে। এই প্রকল্পের উদ্দেশ্য মানসম্মত আম উৎপাদন করে বিদেশে রপ্তানি করা। এই প্রকল্পের অধীনে কৃষকদের উন্নত কৃষি পদ্ধতি, রোগ ও পোকা-মাকড়ের ব্যবস্থাপনা এবং ভালো জাতের আম চাষের প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। এই প্রকল্পের মাধ্যমে আমের ফলন বৃদ্ধি, প্রক্রিয়াকরণ এবং বাজারজাতকরণে সহায়তা করা হয়। যার ব্যয় ধরা হয়েছে ৬২ কোটি টাকা। এত পরিমাণে খরচের পরও দেখা মিলছে না সাফল্যের।
আরও পড়ুন: গরম-ঈদের ছুটিতে আম চাষির সর্বনাশ আমের নাম ল্যাংড়া কেন আমের ওজনে ‘ঢলন’ প্রথা বাতিল, কেজিপ্রতি কমিশন পাবেন ব্যবসায়ীরা আম রপ্তানি ৫০ হাজার টনে উন্নীত করতে পারি: কৃষি সচিবরাজশাহীর বিপন এগ্রো প্রোডাক্টস লিমিটেডের মালিক হাফিজুর রহমান খান জাগো নিউজকে বলেন, ‘আম এক্সপোর্ট লেভেলের কয়েকটি ধাপ আছে। তবে নিরাপদ স্থান, প্যাকিং, গ্রেডিং, কার্গো বিমান ইত্যাদি সমস্যার কারণেই আমরা আম উৎপাদন থেকে পিছিয়ে যাচ্ছি। আমাদের আগে আমের চাহিদা বেশি ছিল, তখন কৃষক ছিল না। এখন কৃষক আছে কিন্তু দক্ষ লোক ও সরকারি সহায়তা খুব একটা নেই। এজন্যই আমাদের আম রপ্তানি কমে গেছে।’
তিনি বলেন, ‘আম রপ্তানিতে সমস্যার কথা বারবার সরকারকে লিখিত ও মৌখিকভাবে বলেছি। তারা শুধু আশ্বাস দেন কিন্তু সমাধান করেন না। প্রতিবছর আম বাড়তি থেকে যায়। এসব আম কৃষকদের ঘাড়ে পড়ে। আম রপ্তানির জন্য যখন চুক্তি করা হয়, তখন কিন্তু বলা হয় না এই আম রপ্তানি হবে কিংবা এর গ্যারান্টি ক্লজও নেই যে, সব আমই বিদেশে রপ্তানি হবে।’
Advertisement
আম রপ্তানিতে সমস্যার কথা জানিয়ে রপ্তানিকারক হাফিজুর রহমান বলেন, ‘আম রপ্তানিতে মিডিয়ার অভাব। বিদেশের মার্কেটে যোগাযোগের অভাব। কাঙ্ক্ষিত মুনাফা না পেয়ে চাষিরাও হারিয়ে যাচ্ছেন। আমাদের দেশের মতো দুর্বল বন্দর ব্যবস্থাপনা আর কোথাও নেই। কার্গো খরচও বেশি। এ কারণে আগ্রহ হারাচ্ছেন।’
রাজ চাঁপাই এগ্রো ফুড প্রোডিউসারের সভাপতি আনোয়ারুল হক বলেন, ‘নানা কারণে আম রপ্তানি করা যায় না। আম রপ্তানি মুখ থুবড়ে পড়েছে। এর আগে আমরা ৩-৪ হাজার মেট্রিক টন আম পাঠিয়েছি, এবার মাত্র ৫০০ মেট্রিক টন বিদেশে যাবে। তবে এবছর আম রপ্তানি এখনো শুরু হয়নি।’
তিনি আরও বলেন, ‘আমরা খুব একটা ভালো নেই। আমাদের সীমাহীন ক্ষতি হচ্ছে। সরকারের কাছে বারবার আবেদন করেছি প্যাকেজিং হাউজ রাজশাহীতে দেওয়া হোক। আমরা ১০ বছর ধরে দাবি জানিয়ে আসছি। প্রতি বছরই রাজশাহীতে করা হবে বলা হয় কিন্তু সেটি ওই বলা পর্যন্ত। আম যতই উৎপাদন হোক, ঢাকার শ্যামপুরে প্যাকেজিং হাউজ করে বিদেশে এতো আম পাঠানো যাবে না। হাতেগোনা কিছু যাবে।’
‘রাজশাহী থেকে আম রপ্তানির পরিমাণ খুবই কম। এর কারণ নিজস্ব কার্গো বিমান নেই। এককেজি আম পাঠাতে ৫০০ টাকা পরিবহন খরচ পড়ে যায়। পার্শ্ববর্তী দেশ থেকে পাঠাতে এই খরচ কম। এ কারণে তারা বেশি পাঠাচ্ছেন।’
‘আমরা ভালো আম উৎপাদন করি। এক্সপোর্টাররা আমাদের কাছ থেকে নিয়ে যায়। কিন্তু দিন দিন আমাদের চাষি কমছে। বর্তমানে আমাদের সংগঠনে ১০০ জনের মতো আছেন। এর আগে অনেক বেশি ছিল। কিন্তু আম রপ্তানি করতে না পেরে অনেকেই সরে যাচ্ছেন’, যোগ করেন আনোয়ারুল হক।
আম রপ্তানিতে যত সমস্যা
কৃষি বিভাগ ও চাষিদের সঙ্গে কথা বলে যানা গেছে, রাজশাহীর আমের প্রধান সমস্যা হলো ফাইটোস্যানিটারি সনদ জটিলতা। বিদেশে আম রপ্তানির জন্য স্বাস্থ্য সনদ (ফাইটোস্যানিটারি সার্টিফিকেট) প্রয়োজন হয়। অনেক সময় এসব সনদ প্রক্রিয়ায় জটিলতা ও বিলম্ব হয়। পর্যাপ্ত হট ওয়াটার ট্রিটমেন্ট প্ল্যান্ট না থাকাও একটা বড় সমস্যা। ইউরোপসহ অনেক দেশ আমদানি করার আগে হট ওয়াটার ট্রিটমেন্ট চায়, যা বাংলাদেশে শুধুমাত্র ঢাকাতেই রয়েছে।
আরও পড়ুন: আম চাষে সফল ইসাহাক, এক গাছ থেকেই বিক্রি লাখ টাকা ইংল্যান্ডে যাচ্ছে চাঁপাইনবাবগঞ্জের খিরসাপাত আম এক বাগানে বিশ্বখ্যাত ৫৭ জাতের আম চাষ করে হেলালের বাজিমাতশুধু তাই নয়, আম সংরক্ষণের সঠিক ব্যবস্থা নেই। শীতলীকরণ সুবিধার অভাব রয়েছে। পর্যাপ্ত প্যাকেজিং এবং গ্রেডিং ব্যবস্থা নেই। আন্তর্জাতিক বাজারে মান অনুযায়ী প্যাকেট ও গ্রেডিং না থাকায় দাম কমে যায়। পরিবহন ও রপ্তানি খরচ বেশি। বিমানভাড়া এবং অন্যান্য ব্যয় বেশি হওয়ায় লাভজনকভাবে আম রপ্তানি করা কঠিন হয়। বাজার সংযোগেও রয়েছে দুর্বলতা। বিদেশে ভালো বাজার থাকলেও সরকারি বা বেসরকারি উদ্যোগে সে বাজারের সঙ্গে সংযোগ গড়ে তোলা হয় না।
চাঁপাইনবাবগঞ্জ কৃষি সম্প্রসরণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক ড. মো. ইয়াছিন আলী বলেন, রাজশাহী অঞ্চলের সবচেয়ে বেশি রপ্তানিযোগ্য আম উৎপাদন করা হয়েছে এই জেলায়। প্রায় ছয় হাজার মেট্রিক টন আম উৎপাদন করা হয়েছে। এরইমধ্যে আম রপ্তানি শুরু হয়েছে। আমরা ১৭ মেট্রিক টন আম রপ্তানি করেছি। এরপর ঈদের ছুটিতে রপ্তানি হয়নি। এখন আবারও শুরু হবে।’ তিনি বলেন, ‘যে পরিমাণ আম উৎপাদন হয়েছে মনে হয় না আবার রপ্তানি করতে পারবো। গতবছর ৩৩০ মেট্রিক টন আম রপ্তানি করেছি। এবার ৫০০-৭০০ মেট্রিক টন চেষ্টা করবো। বাকি আমগুলো বিভিন্ন সুপারশপে পাঠানো হবে।
রাজশাহী কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক উম্মে সালমা বলেন, রাজশাহী থেকে বিদেশে আম রপ্তানি এখনো শুরু হয়নি। ঈদ ও অনিয়মিত বৃষ্টির কারণে দেরি হচ্ছে। তবে এবার চীনে আম রপ্তানি হবে।
তিনি বলেন, রাজশাহী থেকে আম রপ্তানির পরিমাণ খুবই কম। এর কারণ নিজস্ব কার্গো বিমান নেই। এককেজি আম পাঠাতে ৫০০ টাকা পরিবহন খরচ পড়ে যায়। পার্শ্ববর্তী দেশ থেকে পাঠাতে এই খরচ কম। এ কারণে তারা বেশি পাঠাচ্ছেন।
রপ্তানিযোগ্য আম উৎপাদন প্রকল্পের পরিচালক অরিফুর রহমান জাগো নিউজকে বলেন, বাংলাদেশ থেকে যে পরিমাণ আম রপ্তানি করা হয়, এর ৭০ শতাংশই যায় রাজশাহী অঞ্চল থেকে। এবার পাঁচ হাজার মেট্রিক টন আম রপ্তানির লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। তিনি আরও বলেন, আম উৎপাদন বেশি হলে সবটাই রপ্তানি হবে এমনটি নয়। আম রপ্তানির কয়েকটি ধাপ আছে। এরমধ্যে রাজশাহী থেকে ঢাকায় আম যেতেই ১০ শতাংশ নষ্ট হয়ে যায়। এর পাশাপাশি কার্গো ভাড়াও বেশি। কার্গোতে স্থান না পাওয়াসহ বেশ কিছু সমস্যাও আছে। তবে এসব সমস্যা সমাধানে সরকারের পক্ষ থেকে চেষ্টা করা হচ্ছে।
‘ভালো কোয়ালিটির আম তো দেশের মানুষও খাবে। যা উৎপাদন হবে তার সবই তো আর বিদেশে চলে যাবে না। আমরা চেষ্টা করছি বেশি বেশি রপ্তানি করতে। বাকিটা দেশের মানুষ ভালো কোয়ালিটির আম খাবে’, যোগ করেন প্রকল্প পরিচালক অরিফুর রহমান।
এসআর/এএসএম