ইরান ও ইসরায়েলের মধ্যে হামলা-পাল্টা হামলা চলছেই। দুই দেশই তাদের অভ্যন্তরের গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনায় হামলা চালাচ্ছে। দেশ দুটির এই যুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্র জড়িয়ে যেতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে। এতে যুদ্ধ পরিস্থিতি আরও দীর্ঘদিন স্থায়ী হওয়ার আশঙ্কা করা হচ্ছে। ফলে অস্থির হতে পারে বিশ্ব বাণিজ্য। বিশেষ করে সংযুক্ত আরব আমিরাত ও ইরানের মধ্যে থাকা হরমুজ প্রণালি ইরান বন্ধ করে দিলে অস্থির হয়ে উঠতে পারে বিশ্ব জ্বালানির বাজার।
Advertisement
চলমান এই পরিস্থিতির মধ্যে হরমুজ প্রণালি বন্ধ হয়ে গেলে অন্য দেশের মতো বাংলাদেশেরও জ্বালানি তেল এবং তরলকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস (এলএনজি) আমদানি বন্ধ হয়ে যাবে। এতে ঝুঁকি তৈরি হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। বিশ্ব বাজারের সঙ্গে তাল মিলিয়ে দেশেও বাড়তে পারে জ্বালানি তেলের দাম। ফলে বিকল্প উৎস খুঁজছে সরকার। তবে তেল পরিবহনে বেসরকারিভাবে কিছুটা ভরসা করা গেলেও কাতার থেকে এলএনজি আমদানি বন্ধ হয়ে যাবে পুরোটাই।
বাংলাদেশ যেসব দেশ থেকে এলএনজি আমদানি করে তার সব থেকে বড় উৎস কাতার। বাংলাদেশ ২০১৭ সালে কাতারের সঙ্গে ১৫ বছরের চুক্তি স্বাক্ষর করে, যার আওতায় ১.৮ থেকে ২.৫ মিলিয়ন মেট্রিক টন এলএনজি বছরে সরবরাহ হয়। ২০২৩ সালে আরও একটি ১৫ বছরের চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়, যার আওতায় ২০২৬ সাল থেকে ১.৮ মিলিয়ন মেট্রিক টন এলএনজি সরবরাহের কথা রয়েছে। এলএনজি স্থলপথে পরিবহন করা যায় না। তাই কাতার থেকে এলএনজি পরিবহনের একমাত্র ভরসা হরমুজ প্রণালি। এটি বন্ধ হলে শুধু বাংলাদেশ নয়, বিশ্বের অন্যান্য দেশও সংকটে পড়বে।
আরও পড়ুন:
Advertisement
দেশের জ্বালানি তেল আমদানি সংস্থা বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশনের তথ্য বলছে, পরিশোধিত জ্বালানি তেলের ২০ শতাংশ ও অপরিশোধিত জ্বালানি তেলের ৩০ শতাংশ পরিবহন করা হয় হরমুজ প্রণালি হয়ে। দেশের একমাত্র জ্বালানি পরিশোধনাগারের সক্ষমতা অনুযায়ী, বছরে ১৫ লাখ টনের বেশি অপরিশোধিত তেল আমদানির সুযোগ নেই বিপিসির। অপরিশোধিত তেল হিসেবে সৌদি আরব থেকে অ্যারাবিয়ান লাইট এবং সংযুক্ত আরব আমিরাত থেকে মারবান লাইট আমদানি করা হয়। এই দুই দেশ থেকেই জ্বালানি আসে হরমুজ প্রণালি হয়ে।
ইসরায়েল যদি ইরানের তেল ও জ্বালানি অবকাঠামোতে আরও বড় ধরনের হামলা চালায়, তাহলে ইরান হরমুজ প্রণালি বন্ধ করে দিতে পারে। এটিই হতে পারে তাদের (তেহরানের) চূড়ান্ত প্রতিক্রিয়া-সেন্টার ফর ইন্টারন্যাশনাল পলিসির জ্যেষ্ঠ বিশ্লেষক সিনা তুসি
বিপিসির কর্মকর্তারা বলেন, এভাবে যুদ্ধ পরিস্থিতি চলতে থাকলে বিশ্ববাজারে জ্বালানি তেলের দাম বাড়বে। এর প্রভাব বাংলাদেশেও পড়বে। তবে বিকল্প উপায়ে সংকট সমাধানে প্রস্তুতি নেওয়া হচ্ছে।
অন্যদিকে, পেট্রোবাংলার এক কর্মকর্তা জাগো নিউজকে জানিয়েছেন, কাতার থেকে দেশে যেসব এলএনজি কার্গো আসে সবগুলোই হরমুজ প্রণালি দিয়ে আনতে হয়। স্থলপথ বা অন্য কোনো নৌপথে এলএনজি কার্গো আনা সম্ভব নয়। যদি হরমুজ প্রণালি বন্ধ হয়ে যায় তাহলে সংকটে পড়তে হতে পারে। তবে তিনি আশা প্রকাশ করেন এ ধরনের পরিস্থিতি হয়তো তৈরি হবে না।
Advertisement
বিশ্বের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ তেল পরিবহন পথ হরমুজ প্রণালি। প্রতিদিন গড়ে প্রায় ২০.৯ মিলিয়ন ব্যারেল তেল এই প্রণালি দিয়ে পরিবহন হয়, যা বিশ্বব্যাপী সি-বর্ন তেল বাণিজ্যের প্রায় ২০ শতাংশ। পরিবহন করা এসব জ্বালানির মধ্যে কাঁচা তেল, কনডেনসেট এবং তেলজাত পণ্য অন্তর্ভুক্ত।
তেলের দাম নির্ধারণ করি যেদিন জাহাজ লোড হয় তার আগের তিনদিন এবং পরের তিনদিনের মূল্যের গড় হিসাব করে। আন্তর্জাতিক বাজারে যদি দাম বাড়ে ক্রয়মূল্য বাড়বে। তখন স্বাভাবিকভাবেই জ্বালানি তেলের দাম বাড়বে- ড. এ কে এম আজাদুর রহমান, বিপিসি পরিচালক (অপারেশন্স ও পরিকল্পনা)
এই প্রণালি মধ্যপ্রাচ্যের প্রধান তেল রপ্তানিকারক দেশগুলোর জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ রপ্তানি পথ। যেমন- সৌদি আরব, ইরাক, সংযুক্ত আরব আমিরাত, কুয়েত, কাতার এবং ইরান তাদের তেল রপ্তানির জন্য হরমুজ প্রণালি ব্যবহার করে। বিশেষ করে, কাতার তার প্রায় সব তরল প্রাকৃতিক গ্যাস (এলএনজি) এই প্রণালি দিয়ে রপ্তানি করে।
এই প্রণালি দিয়ে তেল পরিবহন বিশ্বব্যাপী জ্বালানি সরবরাহের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। যে কোনো ধরনের অস্থিরতা বা প্রতিবন্ধকতা এই পথের মাধ্যমে তেল পরিবহনে প্রভাব ফেলতে পারে, যা বৈশ্বিক জ্বালানি বাজারে অস্থিরতা সৃষ্টি করতে পারে বলে ধারণা করছেন আন্তর্জাতিক বিশ্লেষকরা।
আরও পড়ুন:
হরমুজ প্রণালি বন্ধ হলে কোন দেশ সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবে?হরমুজ প্রণালি দিয়ে কী পরিমাণ তেল সরবরাহ হয়?সংবাদমাধ্যম আল জাজিরার এক প্রতিবেদনে যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর ইন্টারন্যাশনাল পলিসির জ্যেষ্ঠ বিশ্লেষক সিনা তুসি জানিয়েছেন, ইসরায়েল যদি ইরানের তেল ও জ্বালানি অবকাঠামোতে আরও বড় ধরনের হামলা চালায়, তাহলে ইরান হরমুজ প্রণালি বন্ধ করে দিতে পারে। এটিই হতে পারে তাদের (তেহরানের) চূড়ান্ত প্রতিক্রিয়া, সর্বোচ্চ মাত্রার জবাব হতে পারে।
তিনি বলেন, ‘আজ জ্বালানি স্থাপনাগুলো ঘিরে পাল্টাপাল্টি হামলা হয়েছে। এ ধারা চলতে থাকলে পুরো পারস্য উপসাগর অঞ্চল থেকে জ্বালানি সরবরাহ হুমকির মুখে পড়তে পারে।
দুই দেশের এই যুদ্ধ পরিস্থিতির মধ্যেই ইরানের রাষ্ট্রীয় সংবাদমাধ্যম আইআরআইএনএন জানিয়েছে, সরকার হরমুজ প্রণালি বন্ধের বিষয়টি সক্রিয়ভাবে বিবেচনা করছে।
বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশনের (বিপিসি) পরিচালক (অপারেশন্স ও পরিকল্পনা) ও সরকারের যুগ্ম সচিব ড. এ কে এম আজাদুর রহমান জাগো নিউজকে বলেন, আমরা তেলের দাম নির্ধারণ করি যেদিন জাহাজ লোড হয় তার আগের তিনদিন এবং পরের তিনদিনের মূল্যের গড় হিসাব করে। সে ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক বাজারে যদি দাম বাড়ে আমাদের ক্রয়মূল্য বাড়বে। তখন স্বাভাবিকভাবেই জ্বালানি তেলের দাম বাড়বে।
আরও পড়ুন:
ইসরায়েলে ফের ইরানের ক্ষেপণাস্ত্র হামলাইসরায়েল বিশ্বকে ‘পারমাণবিক বিপর্যায়ের’ দিকে ঠেলে দিচ্ছে: মস্কোতিনি বলেন, হরমুজ প্রণালি বন্ধ হয়ে গেলে জ্বালানি তেল পরিবহনে প্রভাব পড়বে। আমরা ক্রুড অয়েল হরমুজ প্রণালি দিয়ে নিয়ে আসি, যদি এটি বন্ধ হয় তাহলে অবশ্যই আমাদের সংকটে পড়ার শঙ্কা আছে।
সংকটময় মুহূর্তে বিকল্প ব্যবস্থা বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, আমাদের অনেক বেসরকারি প্ল্যান্ট আছে। তারা হরমুজ প্রণালি ব্যবহার না করে অন্যান্য দেশ থেকে তেল নিয়ে আসে। সে ক্ষেত্রে আমরা কিছুটা সুবিধাজনক অবস্থায় থাকবো। তখন দাম হয়তো বাড়বে কিন্তু আমরা জ্বালানি তেল পাবো।
জ্বালানি তেল দরপত্রের মাধ্যমে ক্রয় করা হয় জানিয়ে হঠাৎ করে অন্য কোনো দেশ থেকে তেল ক্রয় করার সুযোগ কম বলেও জানান এই কর্মকর্তা।
এনএস/এসএনআর/জেআইএম