‘বিশ্ববিদ্যালয়ে আবাসিক হল না থাকায় পড়ার পরিবেশ নেই। গার্মেন্টস শ্রমিকের মতো সকালে বই-খাতা নিয়ে ক্যাম্পাসে যাই। নির্দিষ্ট সময় পর আবার বাসায় চলে আসি। এটা চাকরির জন্য পারফেক্ট হলেও শিক্ষার জন্য নয়। পড়াশোনার জন্য ভালো পরিবেশ বা হলের বিকল্প নেই।’
Advertisement
আক্ষেপ করে জাগো নিউজকে কথাগুলো বলছিলেন জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের ছাত্র মোস্তাকিম আহমেদ। তিনি বলেন, এ বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীদের দুর্ভোগের শেষ নেই। এটি একটি সরকারি বিশ্ববিদ্যালয় হলেও তার চরিত্র বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের। মাত্র ১১ একর জায়গার ওপর বিশ্ববিদ্যালয়টি দাঁড়িয়ে আছে। অথচ শিক্ষার্থীর সংখ্যা প্রায় ১৯ হাজার। ফলে সকাল থেকে বিকেল পর্যন্ত ক্যাম্পাসে দাঁড়ানো বা বসার জায়গা পাওয়া যায় না। ক্লাসের বাইরে শিক্ষার্থীরা গ্রুপ স্টাডি করবে, তার সুযোগও নেই। এ কারণে বিশ্ববিদ্যালয়টি প্রতিষ্ঠার ২০ বছরেও তার শিক্ষার মান কাঙ্ক্ষিত পর্যায়ে পৌঁছাতে পারেনি।
জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় আগে সরকারি কলেজ ছিল। ২০০৫ সালের ২০ অক্টোবর বাংলাদেশের জাতীয় সংসদে ‘জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় আইন, ২০০৫’ পাসের মাধ্যমে জগন্নাথ কলেজ একটি পূর্ণাঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে অনুমোদিত হয়। বর্তমানে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে সাতটি অনুষদ, দুটি ইনস্টিটিউট এবং ৩৮টি বিভাগ রয়েছে। শিক্ষার্থীর সংখ্যা প্রায় ১৯ হাজার। এর মধ্যে নারী শিক্ষার্থী প্রায় আট হাজার। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়টিতে একটি ছাত্রী হল (১২০০ জনের) ছাড়া আর কোনো আবাসিক সুবিধা নেই। ফলে প্রায় সব শিক্ষার্থীকে ঢাকার বিভিন্ন এলাকায় বাসা ও মেস ভাড়া করতে থাকতে হয়।
আরও পড়ুন
Advertisement
সম্প্রতি আবাসন সংকট দূর করতে কাকরাইলে প্রধান উপদেষ্টার বাসভবন যমুনার সামনে লাগাতার আন্দোলন করেছিলেন জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা। এই আন্দোলনে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে আবাসনব্যবস্থা নিশ্চিত না হওয়া পর্যন্ত ৭০ শতাংশ শিক্ষার্থীর জন্য আবাসন বৃত্তি ২০২৫-২৬ অর্থবছর থেকে কার্যকর করা, বিশ্ববিদ্যালয়ের ২০২৫-২৬ অর্থবছরের জন্য প্রস্তাবিত পূর্ণাঙ্গ বাজেট অনুমোদন করা এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের দ্বিতীয় ক্যাম্পাসের কাজ পরবর্তী একনেক সভায় অনুমোদন করে অগ্রাধিকার প্রকল্পের আওতায় বাস্তবায়নের দাবি করা হয়েছিল। পরে আন্দোলনের মুখে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের দাবি পূরণের সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার।
আবাসন সংকটের মধ্যে কীভাবে শিক্ষার্থীরা তাদের শিক্ষা কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছেন তা নিয়ে বেশ কয়েকজন শিক্ষার্থীর সঙ্গে কথা বলেছেন জাগো নিউজের এই প্রতিবেদক।
জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের তৃতীয় সেমিস্টারের ছাত্র ফারহান ফাহিম। তিনি জাগো নিউজকে বলেন, পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে আবাসিক কোনো হল থাকবে না, এটা হতে পারে না। ন্যূনতম এই সুবিধাও যদি নিশ্চিত করা না যায়, তা হলে জগন্নাথকে বিশ্ববিদ্যালয় করারই দরকার ছিল না। এখন এই বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রায় সব শিক্ষার্থীকে মেস ভাড়া করে থাকতে হয়। অথচ বিশ্ববিদ্যালয়ে হল থাকলে শিক্ষার্থীদের পড়াশোনার মান আরও কতো ভালো হতো।
আরও পড়ুন
Advertisement
হল না থাকায় পড়াশোনায় অনেক ব্যাঘাত ঘটছে বলে জানান প্রাণিবিজ্ঞান বিভাগের ছাত্র বোরহান উদ্দিন। তিনি বলেন, ‘বিশ্ববিদ্যালয়টিতে শিক্ষার্থীদের জন্য আবাসিক হল নেই, এ তথ্য আগেই জানতাম। তখন ভেবেছিলাম বিশ্ববিদ্যালয়ের আশপাশে কোনো মেসে উঠে পড়াশোনা চালিয়ে যাব। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার পর ঘটে বিপত্তি। ক্যাম্পাসের কাছাকাছি মেস নেই। যে দুই-একটি মেস পেয়েছি, সেখানে ভাড়া বেশি। আবার খাবার খরচ, পানি-বিদ্যুৎ, গ্যাস ও বুয়া বিল সাধ্যের বাইরে। তখন বাধ্য হয়ে কেরানীগঞ্জের জিনজিরায় হাজার টাকা ভাড়ায় মেসে উঠি।’
বোরহান উদ্দিন বলেন, ‘দেড় বছর ধরে সেখানেই অবস্থান করছি। কিন্তু মেসে পড়াশোনার তেমন পরিবেশ নেই। আবার জিনজিরা থেকে বুড়িগঙ্গা নদী নৌকায় পাড় হয়ে ক্যাম্পাসে যাতায়াতে অন্তত দুই ঘণ্টা লাগে। বিশ্ববিদ্যালয়ে আবাসিক হলে থাকলে এই সময়টা পড়াশোনায় ব্যয় করতে পারতাম।’
মিরপুর-১৪ নম্বর সেকশনে দুই কক্ষের একটা ভাড়া বাসায় থাকেন জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যবস্থাপনা বিভাগের শিক্ষার্থী মাঈনুল ইসলাম। তার সঙ্গে একই বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন বিভাগের আরও পাঁচজন থাকেন। এজন্য তাদের প্রত্যেককে মাসে চার হাজার টাকা করে ভাড়া দিতে হয়। এর বাইরে মেসের অন্যান্য খরচ রয়েছে।
আরও পড়ুন
৩ দফা দাবিতে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীদের বিক্ষোভ জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে চালু হচ্ছে শিক্ষক মনিটরিং পদ্ধতি যমুনা অভিমুখী লংমার্চে টিয়ারগ্যাস-লাঠিপেটা, শিক্ষকসহ আহত অর্ধশতআলাপকালে মাঈনুল ইসলাম বলেন, ‘পুরান ঢাকার ঘিঞ্জি এলাকায় জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের অবস্থান। এর মধ্যে সেখানে হল নেই। আশপাশে ভালো বাসা বা মেস নেই। এ ছাড়া টিউশনি করে যে নিজের পড়ার খরচ চালাবো, সে সুযোগও কম। তাই বাধ্য হয়ে দূরে বাসা নিয়েছি। এ দিকে দুই-তিনটা টিউশনি করালে মাসে চলার খরচ হয়ে যায়। অথচ বিশ্ববিদ্যালয়ের হল থাকলে বাসা, খাবার, টিউশনি নিয়ে চিন্তা করতে হতো না।’
মোহাম্মদপুরের একটি মেসে ভাড়া থাকেন নৃবিজ্ঞান বিভাগের ছাত্রী তাসমিয়া ইসলাম। এ এলাকা থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ের বাসে সকাল ৮টায় ক্যাম্পাসে যান তিনি। আবার বিকেল ৪টার বাসে করে মেসে ফিরেন। এ কারণে দিনের একটা বড় সময় তার যাতায়াতেই চলে যায়।
জানতে চাইলে তাসমিয়া ইসলাম বলেন, ‘বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রায় আট হাজার ছাত্রী রয়েছে। এ শিক্ষার্থীদের জন্য মাত্র একটি আবাসিক হল রয়েছে। যেখানে মাত্র ৭০০ জনের থাকার ব্যবস্থা আছে। কিন্তু গাদাগাদি করে থাকেন ১২শ জন। বাকি সব ছাত্রীকে বাসা বা মেস ভাড়া থাকতে হয়। এ কারণে অনেক সময় নিজের নিরাপত্তা নিয়ে দুশ্চিন্তা করতে হয়। আবার পড়াশোনার খরচ চালাতে পরিবারকে হিমশিম খেতে হয়।’
আরও পড়ুন
পুলিশের ব্যারিকেড ভেঙে যমুনা অভিমুখে জবি শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা অস্থায়ী আবাসনের দাবিতে গণঅনশনে জবি শিক্ষার্থীরা অনশনে বসা জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ১৩ শিক্ষার্থী অসুস্থবাংলাদেশ ছাত্র অধিকার পরিষদের জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সভাপতি এ কে এম রাকিব। তিনি জাগো নিউজকে বলেন, ‘পুরান ঢাকার এই ঘিঞ্জি এলাকায় থাকার পরিবেশ নেই। অধিকাংশ শিক্ষার্থী ঝুঁকিপূর্ণ বাড়ি বা ভবনে ভাড়া থাকেন, যেখানে আলো-বাতাস ঢুকে না। আবার ক্যাম্পাসে যাতায়াতে শিক্ষার্থীদের জন্য পর্যাপ্ত বাস নেই। ফলে বাসের ফটকে ঝুলে থাকেন শিক্ষার্থীরা। এখন কেরানীগঞ্জে দ্বিতীয় ক্যাম্পাসের কাজ দ্রুত সময়ে শুরু এবং অস্থায়ীভাবে আবাসিক হল করলে শিক্ষার্থীদের অনেক সমস্যার সমাধান হবে। আশা করি সরকার জগন্নাথের বিষয়টি গুরুত্ব দিয়ে দেখবে।’
এমএমএ/এমএমএআর/এমএস