ঈদুল আজহার আগে ও পরে ১২ দিনে (৩-১৪ জুন) দেশে ৩৪৭টি সড়ক দুর্ঘটনায় ৩১২ জন নিহত হয়েছেন। গুরুতর আহত হয়েছেন এক হাজার ৫৭ জন। নিহতদের মধ্যে শিশু ৬৩ আর নারী ৪৭ জন। ১২১টি মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় নিহত হয়েছেন ১০৭ জন, যা মোট নিহতের ৩৪.২৯ শতাংশ। মোটরসাইকেল দুর্ঘটনার হার ৩৪.৮৭ শতাংশ। দুর্ঘটনায় ৪৪ জন পথচারী নিহত হয়েছেন, যা মোট নিহতের ১৪.১০ শতাংশ। যানবাহনের চালক ও সহকারী নিহত হয়েছেন ৫১ জন অর্থাৎ ১৬.৩৪ শতাংশ। এ সময়ে ৯টি নৌদুর্ঘটনায় ১০ জন নিহত ও ৮ আহত হয়েছেন। ৩২টি রেলপথ দুর্ঘটনায় ২১ জন নিহত এবং ১৭ জন আহত হয়েছেন। রোড সেফটি ফাউন্ডেশন ৯টি জাতীয় দৈনিক, ৭টি অনলাইন নিউজ পোর্টাল, ইলেক্ট্রনিক মাধ্যম এবং নিজস্ব তথ্যের ভিত্তিতে প্রতিবেদন তৈরি করে। বুধবার (১৮ জুন) গণমাধ্যমে পাঠানো রোড সেফটি ফাউন্ডেশনের নির্বাহী পরিচালক সাইদুর রহমানের সই করা বিবৃতিতে এসব তথ্য জানানো হয়।
Advertisement
দুর্ঘটনায় যানবাহনভিত্তিক নিহতের পরিসংখ্যানে দেখা যায়, মোটরসাইকেল চালক ও আরোহী ১০৭ জন (৩৪.২৯%), বাস যাত্রী ৩৩ জন (১০.৫৭%), ট্রাক-কাভার্ডভ্যান-পিকআপ আরোহী ১৮ জন (৫.৭৬%), প্রাইভেটকার-মাইক্রোবাস-অ্যাম্বুলেন্স আরোহী ১১ জন (৩.৫২%), থ্রি-হুইলার যাত্রী (ইজিবাইক-সিএনজি-অটোরিকশা-অটোভ্যান) ৭৩ জন (২৩.৩৯%), স্থানীয়ভাবে তৈরি যানবাহনের যাত্রী (নসিমন-পাখিভ্যান-মাহিন্দ্র-টমটম-বিভাটেক) ২০ জন (৬.৪১%) এবং বাইসাইকেল আরোহী ৬ জন (১.৯২%) নিহত হয়েছেন।
দুর্ঘটনা সংঘটিত সড়কের ধরনরোড সেফটি ফাউন্ডেশনের পর্যবেক্ষণ ও বিশ্লেষণ বলছে, দুর্ঘটনাগুলোর মধ্যে ১৩৬টি (৩৯.১৯%) জাতীয় মহাসড়কে, ১২১টি (৩৪.৮৭%) আঞ্চলিক সড়কে, ৩৪টি (৯.৭৯%) গ্রামীণ সড়কে এবং ৫৬টি (১৬.১৩%) শহরের সড়কে সংঘটিত হয়েছে।
দুর্ঘটনার ধরনদুর্ঘটনাসমূহের ৮১টি (২৩.৩৪%) মুখোমুখি সংঘর্ষ, ১৬৩টি (৪৬.৯৭%) নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে, ৪৬টি (১৩.২৫%) পথচারীকে চাপা/ধাক্কা দেওয়া, ৫১টি (১৪.৬৯%) যানবাহনের পেছনে আঘাত করা এবং ৬টি (১.৭২%) অন্যান্য কারণে ঘটেছে।
Advertisement
দুর্ঘটনায় সম্পৃক্ত যানবাহনের মধ্যে-ট্রাক-কাভার্ডভ্যান-পিকআপ-ট্রাক্টর-ট্রলি-ড্রাম ট্রাক ১৮%, বাস ১৯.৩৫%, মাইক্রোবাস-প্রাইভেটকার-অ্যাম্বুলেন্স ৮.৩১%, মোটরসাইকেল ২১.৭৩%, থ্রি-হুইলার (ইজিবাইক-সিএনজি-অটোরিকশা-অটোভ্যান) ২১.৩৯%, স্থানীয়ভাবে তৈরি যানবাহন (নসিমন-পাখিভ্যান-মাহিন্দ্র-টমটম-বিভাটেক) ৬.৯৬%, বাইসাইকেল-রিকশা ২.২০% এবং অজ্ঞাত যানবাহন ২.০৩%।
দুর্ঘটনায় সম্পৃক্ত যানবাহনের সংখ্যাদুর্ঘটনায় সম্পৃক্ত যানবাহনের সংখ্যা ৫৮৯টি। বাস ১১৪, ট্রাক ৬৬, কাভার্ডভ্যান ১১, পিকআপ ১২, ট্রাক্টর ৪, ট্রলি ৬, ড্রাম ট্রাক ৭, মাইক্রোবাস ১৭, প্রাইভেটকার ২৯, অ্যাম্বুলেন্স ৩, মোটরসাইকেল ১২৮, থ্রি-হুইলার ১২৬ (ইজিবাইক-সিএনজি-অটোরিকশা-অটোভ্যান), স্থানীয়ভাবে তৈরি যানবাহন ৪১ (নসিমন-পাখিভ্যান-মাহিন্দ্র-টমটম-বিভাটেক), বাইসাইকেল-রিকশা ১৩ এবং অজ্ঞাত যানবাহন ১২টি।
দুর্ঘটনার সময় বিশ্লেষণসময় বিশ্লেষণে দেখা যায়, দুর্ঘটনাসমূহ ঘটেছে ভোরে ৪.০৩%, সকালে ২৫.৬৪%, দুপুরে ১৮.৪৪%, বিকেলে ২১.৬১%, সন্ধ্যায় ১২.৩৯% এবং রাতে ১৭.৮৬%।
দুর্ঘটনার বিভাগীয় পরিসংখ্যানদুর্ঘটনার বিভাগওয়ারী পরিসংখ্যান বলছে, ঢাকা বিভাগে দুর্ঘটনা ৩৩.৪২%, প্রাণহানি ২৭.৮৮%, রাজশাহী বিভাগে দুর্ঘটনা ১২.৬৮%, প্রাণহানি ১২.৮২%, চট্টগ্রাম বিভাগে দুর্ঘটনা ১৫.৮৫%, প্রাণহানি ১৪.১০%, খুলনা বিভাগে দুর্ঘটনা ১২.১০%, প্রাণহানি ১৩.১৪%, বরিশাল বিভাগে দুর্ঘটনা ৬.০৫%, প্রাণহানি ৫.১২%, সিলেট বিভাগে দুর্ঘটনা ৩.৭৪%, প্রাণহানি ৪.৪৮%, রংপুর বিভাগে দুর্ঘটনা ৯.৫১%, প্রাণহানি ১২.১৭% এবং ময়মনসিংহ বিভাগে দুর্ঘটনা ৬.৬২%, প্রাণহানি ১০.২৫% ঘটেছে। ঢাকা বিভাগে সবচেয়ে বেশি দুর্ঘটনা ও প্রাণহানি ঘটেছে। ১১৬টি দুর্ঘটনায় ৮৭ জন নিহত। সিলেট বিভাগে সবচেয়ে কম ১৩টি দুর্ঘটনায় ১৪ জন নিহত। একক জেলা হিসেবে ফরিদপুর জেলায় সবচেয়ে বেশি ২৭টি দুর্ঘটনায় ১৯ জন নিহত হয়েছেন। সবচেয়ে কম চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলায়। এখানে কয়েকটি দুর্ঘটনা ঘটলেও প্রাণহানি ঘটেনি।
Advertisement
গণমাধ্যমে প্রকাশিত তথ্যের ভিত্তিতে জানা যায়, পুলিশ সদস্য ১ জন, সেনা সদস্য ১ জন, শিক্ষক ৩ জন, ইন্টার্ন চিকিৎসক ১ জন, পল্লী চিকিৎসক ১ জন, সাংবাদিক ২ জন, আইনজীবী ১ জন, ব্যাংক কর্মকর্তা ২ জন, এনজিও কর্মী ৩ জন, বিক্রয় প্রতিনিধি ৬ জন, গরু ব্যবসায়ী ৮ জন, ইউপি সদস্য ১ জন, পোশাক শ্রমিক ৪ জন, রাজমিস্ত্রি ২ জন, রঙ মিস্ত্রি ১ জন, থাই মিস্ত্রি ১ জন, প্রতিবন্ধী ২ জন এবং ৪৬ জন শিক্ষার্থী নিহত হয়েছেন।
ঈদযাত্রা ও দুর্ঘটনা পর্যালোচনা২০২৪ সালের ঈদুল আজহার আগে ও পরে ১৩ দিনে ২৬২ জন নিহত হয়েছিলেন। প্রতিদিন গড়ে নিহত হয়েছিলেন ২০.১৫ জন। এবছর প্রতিদিন গড়ে নিহত হয়েছেন ২৬ জন। এ হিসেবে গত বছরের তুলনায় প্রাণহানি বেড়েছে ২৯.০৩ শতাংশ। ঈদ উদযাপনকালে মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় ব্যাপক প্রাণহানি ঘটেছে। কিশোর-যুবকরা বেপরোয়া মোটরসাইকেল চালিয়ে দুর্ঘটনায় আক্রান্ত হয়েছে। বেপরোয়া মোটরসাইকেলের ধাক্কায় ৯ জন পথচারী নিহত হয়েছেন। মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় আক্রান্তদের মধ্যে ৫৪.২০ শতাংশের বয়স ১৪ থেকে ২০ বছর। ঈদযাত্রায় ১টি পরিবারের সবাই নিহত হয়েছেন। পিতা-পুত্র নিহতের ঘটনা ঘটেছে ৬টি। স্বামী-স্ত্রী নিহতের ঘটনা ঘটেছে ৩টি এবং মা-ছেলে নিহতের ঘটনা ঘটেছে ১টি। এবারের ঈদুল আজহায় রাজধানী ঢাকা থেকে কমবেশি ১ কোটি ৪০ লাখ মানুষ যাত্রা করেছেন এবং দেশের অভ্যন্তরে প্রায় সাড়ে ৪ কোটি মানুষ যাতায়াত করেছেন। ঈদের আগে ঘরমুখী যাত্রায় ছুটি কম থাকায় এক সঙ্গে বহু মানুষের যাত্রার কারণে যানবাহনের ব্যাপক সংকট সৃষ্টি হয়েছে। ফলে দরিদ্র ও নিম্নবিত্ত মানুষ বাসের ছাদে, ট্রেনের ছাদে, খোলা ট্রাকে, পিকআপে, ছোট ও স্বল্পগতির নানা প্রকার অনিরাপদ যানবাহনে যাত্রা করেছে। এই অবস্থা ঈদের ফিরতি যাত্রাতেও অব্যাহত ছিল। সড়কে ফিটনেসবিহীন যানবাহন বিকল হওয়া, দুর্ঘটনায় পতিত হওয়া এবং বৃষ্টিতে সড়ক নষ্ট হওয়ার কারণে তীব্র যানজটের সৃষ্টি হয়েছে। ফলে যাত্রীদের চরম ভোগান্তি হয়েছে। চালকরা বিশ্রামহীনভাবে যানবাহন চালানোর কারণে যানবাহন নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে খাদে পড়ে এবং সড়কে দাঁড়ানো ট্রাকের পেছনে ধাক্কা দিয়ে বেশ কয়েকটি দুর্ঘটনা ঘটিয়েছে। এসব দুর্ঘটনায় হতাহত বেশি হয়েছে। যানবাহনের চাকা ফেটে দুর্ঘটনার সংখ্যা বেড়েছে। ঢাকা-মাওয়া এক্সপ্রেসওয়েতে দুর্ঘটনা বেড়েছে। ঈদযাত্রায় অতিরিক্ত ভাড়া আদায় এবং পথে পথে যাত্রী হয়রানিও ছিল।
এফএইচ/এসএনআর/এমএস