ইসরায়েল ও ইরানের মধ্যে পাল্টাপাল্টি ক্ষেপণাস্ত্র হামলার পর আশঙ্কা দেখা দিয়েছে যে, ইরান হরমুজ প্রণালি বন্ধ করে দিতে পারে। বিশ্বজুড়ে তেল সরবরাহের জন্য কৌশলগতভাবে খুবই গুরুত্বপূর্ণ এই প্রণালি। সবচেয়ে সংকীর্ণ অংশে হরমুজ প্রণালি মাত্র ৪০ কিলোমিটার প্রশস্ত যেখান দিয়ে পৃথিবীর প্রায় এক-পঞ্চমাংশ অপরিশোধিত তেল পারাপার হয়।
Advertisement
ইরানের নৌবাহিনীর কমান্ডারের মতে, ইরান এই প্রণালি বন্ধ করার কথা বিবেচনা করতে পারে। যুক্তরাজ্যের গোয়েন্দা সংস্থা এমআইসিক্স-এর সাবেক প্রধান স্যার অ্যালেক্স ইয়োঙ্গার বিবিসিকে বলেছেন, সবচেয়ে খারাপ পরিস্থিতির ক্ষেত্রে যা হতে পারে তা হলো ওই চ্যানেল অবরোধ করা। তার কথায়, এই প্রণালি বন্ধ করা স্পষ্টতই একটা অবিশ্বাস্য অর্থনৈতিক সমস্যা হয়ে দাঁড়াবে। কারণ এর প্রভাব পড়বে তেলের দামের ওপর।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের এনার্জি ইনফরমেশন অ্যাডমিনিস্ট্রেশনের (ইআইএ) অনুমান, ২০২৩ সালের প্রথমার্ধে প্রতিদিন প্রায় দুই কোটি ব্যারেল তেল এই প্রণাণি দিয়ে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। প্রতি বছর সমুদ্রপথে পরিবহন করা প্রায় ৬০ হাজার কোটি ডলার মূল্যের জ্বালানি বাণিজ্যের সমতুল্য এটি।
মার্কিন কংগ্রেসনাল রিসার্চ সার্ভিসের ২০১২ সালের এক প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছিল যে, ইরান তাদের উদ্দেশ্যে সফল হতে ধীরে ধীরে পদক্ষেপ নিতে পারে। সেই পদক্ষেপগুলোর তালিকায় রয়েছে- লঙ্ঘনের পরিণতি স্পষ্টভাবে উল্লেখ না করেই হরমুজ প্রণালিতে নৌযান চলাচল নিষিদ্ধ ঘোষণা করা, যাত্রীবাহী জাহাজ পরিদর্শন বা বাজেয়াপ্ত করা হতে পারে বলে ঘোষণা করা, সামরিক শক্তি ব্যবহার করে নির্দিষ্ট জাহাজকে লক্ষ্যবস্তু হিসাবে নিশানা করা, হরমুজ প্রণালি এবং পারস্য উপসাগরে ন্যাভাল মাইন স্থাপন করা, বাণিজ্যিক ও সামরিক জাহাজকে লক্ষ্যবস্তু হিসেবে নিশানা করতে সাবমেরিন এবং ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবহার করা।
Advertisement
ইরান-ইরাক যুদ্ধের সময় ইরান তেল ট্যাংকারগুলোতে ‘সিল্কওয়ার্ম ক্ষেপণাস্ত্র’ মোতায়েন করার পাশাপাশি উপসাগরীয় জলসীমায় ন্যাভাল মাইন স্থাপন করেছিল। এই মাইনগুলোর মধ্যে একটি ‘ইউএসএস স্যামুয়েল বি রবার্টস’-এ আঘাত হানে। এরপর মার্কিন সামরিক বাহিনীও এর পাল্টা প্রতিশোধ নেয়।
ইরানের সামরিক ক্ষমতাতেহরানে ইসরায়েলি বিমান হামলায় নিহত হওয়ার দু’দিন আগে, ইরানের ইসলামিক রেভুলিউশনারি গার্ড কোর (আইআরজিসি)-এর তৎকালীন কমান্ডার মেজর জেনারেল হোসেইন সালামি হরমুজ প্রণালীতে অবস্থিত ন্যাভাল ইউনিটগুলো পরিদর্শন করতে গিয়েছিলেন।
তিনি পারস্য উপসাগর এবং এর আশেপাশের অঞ্চলগুলোকে ইসলামি প্রজাতন্ত্রের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রতিরক্ষামূলক অঞ্চলগুলোর মধ্যে একটা হিসেবে বর্ণনা করেছিলেন। বিশেষত উচ্চ-গতির ক্ষেপণাস্ত্র-নিক্ষেপকারী জাহাজগুলোর দিকে ইঙ্গিত করেছিলেন যে, জাহাজগুলো তিন মিনিটেরও কম সময়ে ১০ কিলোমিটার ভ্রমণ করতে সক্ষম।
জেনারেল সালামি জানিয়েছিলেন, এই দ্রুত আক্রমণকারী জাহাজ, ভারী যুদ্ধজাহাজ এবং ক্ষেপণাস্ত্রকে প্রতিরক্ষামূলক অভিযানের সময় ব্যবহার করা হবে। তিনি অ্যান্টি-শিপ ন্যাভাল মাইনকে নৌ যুদ্ধের সবচেয়ে নির্ণায়ক অস্ত্রগুলোর একটা হিসেবেও তুলে ধরেছিলেন। তার কথায়, পরিসর, ক্ষমতা ও অভিযানের বৈচিত্র্যের দিক থেকে ন্যাভাল ড্রোনগুলোর বিস্তৃতি ঘটেছে।
Advertisement
বিশেষজ্ঞরা কী বলছেন?বিশেষজ্ঞরা ভবিষ্যদ্বাণী করেছেন যে, প্রতি মাসে জলপথে চলাচলকারী প্রায় তিন হাজারের মতো জাহাজকে থামানোর জন্য ইরান যেসব উপায়ের সাহায্য নিতে পারে, তারমধ্যে সবচেয়ে কার্যকর উপায় হলো ‘ফাস্ট অ্যাটাক বোট’ (দ্রুত আক্রমণকারী নৌযান) এবং সাবমেরিন ব্যবহার করে মাইন মোতায়েন করে রাখা।
ইরানের নৌবাহিনী এবং ইসলামিক রেভুলিউশনারি গার্ড কোর নৌবাহিনী বিদেশি যুদ্ধজাহাজ এবং বাণিজ্যিক জাহাজের ওপর আক্রমণ চালাতে পারে। তবে বড় সামরিক জাহাজগুলো আবার ইসরায়েলি বা মার্কিন বিমান হামলার সহজ লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত হওয়ার আশঙ্কা থেকে যায়।
ইরানের দ্রুতগামী নৌকাগুলোতে প্রায়ই জাহাজ-বিধ্বংসী ক্ষেপণাস্ত্র থাকে। শুধু তাই নয়, বিভিন্ন ধরনের ‘সার্ফেস ভেসেল’ (যুদ্ধকালীন পরিস্থিতিতে জলপৃষ্ঠের উপরে ব্যবহার করা যায়), অর্ধ-নিমজ্জনযোগ্য জাহাজ এবং সাবমেরিনও পরিচালনা করে।
বর্তমানে, মেরিটাইম ট্র্যাকিং ওয়েবসাইটগুলো স্যাটেলাইট চিত্র ব্যবহার করে ইরানের দক্ষিণ সামুদ্রিক সীমান্তের কাছে ইরানি সামরিক জাহাজের গতিবিধির কথা জানিয়েছে।
ইরান যদি হরমুজ প্রণালি বন্ধ করে দেয়, তবে তা বৈশ্বিক তেলের বাজারে ব্যাপক প্রভাব ফেলবে বলে সতর্ক করেছেন জ্বালানি বিশেষজ্ঞ ও যুক্তরাষ্ট্রের হিউস্টন বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক এড হির্স।
ইরানের রাষ্ট্রীয় সংবাদমাধ্যম আইআরআইএনএন জানিয়েছে, দেশটির পার্লামেন্টের নিরাপত্তা কমিশনের সদস্য এসমাইল কোসারি বলেন, ইসরায়েলের সামরিক হামলার জবাবে হরমুজ প্রণালি বন্ধের বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে পর্যালোচনা করছে তেহরান।
এ প্রসঙ্গে হির্স বলেন, এই প্রণালি দিয়ে প্রতিদিন প্রায় ১৮ থেকে ২০ মিলিয়ন ব্যারেল তেল পরিবহন হয়। অর্থাৎ বৈশ্বিক তেল সরবরাহের প্রায় ২০ শতাংশ এখান দিয়ে যায়। সৌদি আরব কিংবা কুয়েতের জন্য এই অঞ্চলের বাইরে তেল রপ্তানির বাস্তবিক বিকল্প রুট নেই।
তিনি আরও বলেন, যদি প্রণালি দিয়ে পরিবহন অর্ধেক পরিমাণেও কমে আসে, তাহলে বিশ্ববাজারে তেলের দাম ১২০ ডলার বা তারও বেশি হয়ে যেতে পারে, যার প্রভাব সারা বিশ্বে খুব দ্রুতই পড়বে।
বিশ্লেষকরা জানিয়েছেন, ইরানের কাছে হরমুজ প্রণালি বন্ধ করা অনেকটা পারমাণবিক অস্ত্র রাখার মতোই। একে ‘প্রতিরোধ ক্ষমতা’ হিসাবে বিবেচনা করা হয়।
আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় যেমন দীর্ঘদিন ধরে ইরানের সামরিক পারমাণবিক কর্মসূচির বিরোধিতা করে আসছে, তেমনই বৃহৎ শক্তিগুলো বারবার বলেছে যে, তারা তেহরানকে সে দেশের কৌশলগত ভৌগোলিক অবস্থান ব্যবহার করে বৈশ্বিক জ্বালানি সরবরাহ বন্ধ করতে দেবে না।
বিশেষজ্ঞরা প্রায়ই ভবিষ্যদ্বাণী করে থাকেন ইরান হয়তো সাময়িকভাবে এই প্রণালি বন্ধ করে দিতে পারবে। কিন্তু বিশেষজ্ঞদের অনেকেই এই কথাও বিশ্বাস করেন যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং তার মিত্ররা সামরিক উপায় ব্যবহার করে সামুদ্রিক যান চলাচল ব্যবস্থাকে দ্রুত পুনঃস্থাপন করতে পারবে।
হরমুজ প্রণালি ইরান ও ওমানের মধ্যে অবস্থিত একটা চ্যানেল বা খাল। এর প্রবেশ এবং প্রস্থানপথ প্রায় ৫০ কিলোমিটার প্রশস্ত। মধ্যবর্তী স্থানে এর সবচেয়ে সংকীর্ণ অংশ প্রায় ৪০ কিলোমিটার প্রশস্ত।
তবে এই প্রণালির কেন্দ্রীয় অংশ বড় জাহাজের চলাচল করার জন্য যথেষ্ট গভীর। সামুদ্রিক নেভিগেশন চার্টে একটা নিরাপদ ইনবাউন্ড লেন, একটা নিরাপদ আউটবাউন্ড লেন এবং এই দুইয়ের মাঝে একটা 'বাফার জোন' নির্ধারণ করা হয়েছে - বিশেষত ভারী তেল ট্যাংকারগুলোর কথা মাথায় রেখে। ফলে বড় জাহাজগুলোকে মাত্র ১০ কিলোমিটার প্রশস্ত একটা চ্যানেল ধরে চলাচল করতে হয়।
ট্যাংকারগুলো পারস্য উপসাগরে প্রবেশের সময়, ইরান এবং আরব দেশগুলোর মধ্যে বিতর্কিত অঞ্চল - গ্রেটার এবং লেসার তুন্ব দ্বীপপুঞ্জকে অতিক্রম করে।
বিশেষজ্ঞের অনেকেই মনে করেন সমুদ্রে যান চলাচল ব্যাহত করার সবচেয়ে সম্ভাব্য পদ্ধতি হলো সামরিক অভিযান, ঠিক যেমনটা ১৯৮০ থেকে ১৯৮৮ সাল পর্যন্ত ইরান-ইরাক যুদ্ধের সময় ঘটেছিল।
টিটিএন