কৃষি ও প্রকৃতি

এআই চালিত কৃষি ও অর্থনীতি: নতুন দিগন্তে বাংলাদেশ

এআই চালিত কৃষি ও অর্থনীতি: নতুন দিগন্তে বাংলাদেশ

বর্তমান বিশ্বে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা বা এআই (আর্টিফিসিয়াল ইনটেলিজেন্স) প্রযুক্তি আর কেবল বিজ্ঞান কল্পকাহিনির বিষয় নয়। এটি এখন বাস্তবতার অংশ, যা বিশ্বব্যাপী অর্থনীতিকে নতুন আকার দিতে শুরু করেছে। এআই প্রযুক্তি উৎপাদন, স্বাস্থ্য, কৃষি, শিক্ষা, সেবা ও ব্যবসা ক্ষেত্রে বিপ্লব ঘটাচ্ছে। যার প্রভাব সরাসরি অর্থনীতিতে দৃশ্যমান হচ্ছে। বাংলাদেশসহ উন্নয়নশীল দেশগুলোর জন্য এটি এক সম্ভাবনার দুয়ার উন্মোচন করছে। এ প্রবন্ধে আমরা পর্যালোচনা করবো, কীভাবে এআই অর্থনীতিকে শক্তিশালী করতে পারে এবং এর সুবিধা, চ্যালেঞ্জ ও ভবিষ্যৎ দিকনির্দেশনা কী হতে পারে।

Advertisement

উৎপাদন খাতে দক্ষতা ও মুনাফা বৃদ্ধিউৎপাদন শিল্পে এআই ব্যবহারের মাধ্যমে সময়, খরচ ও শ্রমের অপচয় রোধ সম্ভব হচ্ছে। রোবটিক অটোমেশন ও মেশিন লার্নিং মডেল ব্যবহার করে শিল্প প্রতিষ্ঠানগুলো এখন দ্রুত উৎপাদনে যাচ্ছে এবং পণ্যের মানোন্নয়ন করছে। ‘স্মার্ট ফ্যাক্টরি’ বা বুদ্ধিমান কারখানা এখন বাস্তব, যেখানে এআই ডেটা বিশ্লেষণ করে মেশিনের কার্যকারিতা বাড়ায়, সমস্যার পূর্বাভাস দেয় এবং মেরামতের পূর্বপরিকল্পনা করতে সাহায্য করে। এর ফলে উৎপাদনের ধারাবাহিকতা বজায় থাকে, যা অর্থনীতিতে নিরবচ্ছিন্ন প্রবাহ সৃষ্টি করে।

কৃষিতে বৈপ্লবিক পরিবর্তন বাংলাদেশের অর্থনীতি কৃষিনির্ভর। এখানে এআই, আইওটি এবং বিগ ডেটা প্রযুক্তি প্রয়োগ করে স্মার্ট কৃষি গড়ে তোলা সম্ভব। যেমন—ড্রোন দ্বারা জমির পর্যবেক্ষণ, আবহাওয়ার পূর্বাভাস অনুযায়ী ফসল বপন, মাটির গুণাগুণ বিশ্লেষণ করে সার প্রয়োগের নির্দেশনা ইত্যাদি। এতে ফসলের ফলন বাড়ে, সময় ও টাকা বাঁচে, রোগবালাই শনাক্ত করা, সমাধান সহজ এবং কৃষক লাভবান হন। প্রযুক্তি ব্যবহার করলে কৃষকের আর্থিক নিরাপত্তা নিশ্চিত হয়, যার প্রভাব সামগ্রিক জিডিপিতে পড়ে।

কৃষি এবং শিক্ষায় প্রযুক্তির ব্যবহারকৃষি এবং শিক্ষায় প্রযুক্তির ব্যবহার একটি যুগান্তকারী পরিবর্তনের সূচনা করেছে।

Advertisement

ড্রোন ও স্যাটেলাইট প্রযুক্তিফসলের বৃদ্ধি পর্যবেক্ষণ, পোকামাকড়ের আক্রমণ নির্ণয় ও কীটনাশক প্রয়োগে ব্যবহৃত হচ্ছে। জমির মানচিত্র তৈরি করে সার ও পানি ব্যবহারে সঠিকতা আনা সম্ভব হচ্ছে।

স্মার্ট সেচ ব্যবস্থাস্বয়ংক্রিয় সেন্সর ব্যবহার করে জমিতে পানির প্রয়োজন অনুযায়ী সেচ দেওয়া যায়, যা পানি সাশ্রয় করে।

ডিজিটাল কৃষি পরামর্শ মোবাইল অ্যাপ বা এসএমএসের মাধ্যমে কৃষকেরা আবহাওয়ার পূর্বাভাস, সার প্রয়োগ, বীজ বপনের সময় সম্পর্কে তথ্য পাচ্ছেন।

আইওটি ও সেন্সর প্রযুক্তিমাটি, আর্দ্রতা, তাপমাত্রা, পিএইচ ইত্যাদি পরিমাপ করে উপযুক্ত ফসল ব্যবস্থাপনায় সহায়তা করে।

Advertisement

কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাউৎপাদন পূর্বাভাস, কীটনাশক ব্যবস্থাপনা, বাজার বিশ্লেষণ ইত্যাদিতে ব্যবহৃত হচ্ছে।

অনলাইন শিক্ষা ও ডিজিটাল ক্লাসরুমই-লার্নিং প্ল্যাটফর্ম (যেমন- জুম, গুগল ক্লাসরুম, মুডল) ব্যবহার করে দূরশিক্ষা গ্রহণ সহজ হয়েছে। গ্রামীণ এলাকায়ও শিক্ষার্থীরা এখন অনলাইনে মানসম্পন্ন শিক্ষা পাচ্ছে।

ডিজিটাল কনটেন্ট ও মাল্টিমিডিয়া শিক্ষা ভিডিও, অ্যানিমেশন, ইন্টারঅ্যাকটিভ কুইজ ব্যবহার করে শিক্ষাকে আরও আকর্ষণীয় ও সহজবোধ্য করা হয়েছে।

এআই ও চ্যাটবট ভিত্তিক সহায়তা শিক্ষার্থীরা যে কোনো সময় প্রশ্ন করলে এআই সহায়ক উত্তর দিয়ে থাকে। ভাষা অনুবাদ, লেখার সহায়তা ইত্যাদিও পাওয়া যায়।

শিক্ষা বিশ্লেষণ ও ট্র্যাকিং শিক্ষার্থীর অগ্রগতি বিশ্লেষণ করে দুর্বলতা চিহ্নিত করা যাচ্ছে এবং সেই অনুযায়ী প্রশিক্ষণ দেওয়া সম্ভব হচ্ছে।

আরও পড়ুন পেঁপে গাছের ফলন বাড়াতে করণীয় গোলাপ কেন চাষ করবেন?

ভার্চুয়াল রিয়্যালিটি ও অগমেন্টেড রিয়ালিটিজ্যামিতি, অণুজীববিজ্ঞান, ইতিহাস ইত্যাদিতে বাস্তব অভিজ্ঞতা দেওয়া হচ্ছে প্রযুক্তির মাধ্যমে।

স্বাস্থ্যখাতে ব্যয় হ্রাস ও চিকিৎসা উন্নয়ন স্বাস্থ্যসেবায় এআই ব্যবহার রোগ নির্ণয়, চিকিৎসা পরিকল্পনা ও রোগীর পর্যবেক্ষণকে অনেক সহজ ও নির্ভুল করে তুলেছে। চিত্র বিশ্লেষণের মাধ্যমে ক্যানসার বা হৃদরোগের মতো জটিল রোগ দ্রুত শনাক্ত করা যাচ্ছে। রোবটিক সার্জারি ও টেলিমেডিসিন স্বাস্থ্যব্যবস্থার পরিধি ও গুণগতমান বাড়িয়েছে। ফলে কর্মক্ষমতা বাড়ে, অপচয় কমে এবং আর্থিকভাবে সাশ্রয় হয়। একটি সুস্থ জনগোষ্ঠীই শক্তিশালী অর্থনীতির ভিত্তি।

ব্যাংকিং ও আর্থিক খাতে স্বয়ংক্রিয়তা ও নিরাপত্তা ব্যাংকিং ও ফিন্যান্স খাতে এআই ব্যবহার আর্থিক লেনদেনকে নিরাপদ, দ্রুত এবং ঝুঁকিমুক্ত করেছে। ফ্রড ডিটেকশন অ্যালগরিদম দ্বারা প্রতারণা শনাক্ত করা যায়। এআই ক্রেডিট রেটিং, লোন ম্যানেজমেন্ট ও গ্রাহক সেবা প্রদানেও ব্যবহৃত হচ্ছে। ফিনটেক প্রতিষ্ঠানগুলো স্বয়ংক্রিয় লেনদেন, চ্যাটবট সেবা এবং ইনভেস্টমেন্ট অ্যানালাইসিসের মাধ্যমে নতুন প্রজন্মের গ্রাহকদের আকৃষ্ট করছে। ফলে বিনিয়োগ বাড়ছে ও অর্থনীতির প্রবৃদ্ধি ত্বরান্বিত হচ্ছে।

শিক্ষা ও দক্ষ মানবসম্পদ উন্নয়ন এআই প্রযুক্তি শিক্ষাক্ষেত্রেও বিশাল পরিবর্তন আনছে। শিক্ষার্থীর প্রয়োজন অনুযায়ী ব্যক্তিকৃত পাঠদান, দুর্বলতা শনাক্তকরণ এবং ভার্চুয়াল শিক্ষক সহায়ক ভূমিকা পালন করছে। শিক্ষক ও ছাত্র উভয়েই এআই-এর মাধ্যমে মূল্যবান সময় ও শ্রম বাঁচাতে পারছে। একটি দক্ষ ও প্রযুক্তি-জ্ঞানসম্পন্ন কর্মবল তৈরি হলে তারা উৎপাদনশীল খাতে যুক্ত হয়ে জাতীয় আয় বৃদ্ধিতে ভূমিকা রাখে।

পরিসংখ্যান ও সিদ্ধান্ত গ্রহণে সহায়তানির্ভুল এবং দ্রুত সিদ্ধান্ত গ্রহণ এখন এআই-এর মাধ্যমে সহজতর হয়েছে। বড় পরিসরের তথ্য বিশ্লেষণ করে এআই ভবিষ্যৎ প্রবণতা, বাজার বিশ্লেষণ, চাহিদা ও সরবরাহের হিসাব দিতে পারে। উদ্যোক্তা, ব্যবসায়ী বা সরকার—সবার জন্যই এটি কার্যকরী একটি হাতিয়ার। এই ‘ডেটা-চালিত অর্থনীতি’ ভবিষ্যতের মূল ভিত্তি হয়ে উঠছে।

কর্মসংস্থান ও নতুন খাতের উদ্ভব অনেকেই মনে করেন এআই প্রযুক্তি মানুষের কর্মসংস্থান কেড়ে নেবে। কিন্তু বাস্তবতা হলো, নতুন প্রযুক্তি নতুন ধরনের কাজ তৈরি করে। যেমন- ডেটা অ্যানালিস্ট, মেশিন লার্নিং ইঞ্জিনিয়ার, এআই ট্রেইনার, রোবটিক মেইনটেন্যান্স স্পেশালিস্ট ইত্যাদি পেশা তৈরি হচ্ছে। সরকার ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠান যদি প্রশিক্ষণ ও রিস্ক স্কিলিং উদ্যোগ গ্রহণ করে, তাহলে কর্মসংস্থান বাড়বে এবং অর্থনীতি আরও গতিশীল হবে।

বাংলাদেশের সম্ভাবনা ও প্রস্তুতিবাংলাদেশ এরই মধ্যে ডিজিটাল বাংলাদেশ বাস্তবায়নের মধ্য দিয়ে প্রযুক্তিনির্ভর অর্থনীতির ভিত্তি তৈরি করেছে। ২০২৫ সালের মধ্যে স্মার্ট বাংলাদেশ গড়ার লক্ষ্যে এআই প্রযুক্তিকে অন্যতম স্তম্ভ হিসেবে ধরা হয়েছে। মেধাবী তরুণ, তথ্যপ্রযুক্তি খাতের দ্রুত অগ্রগতি এবং উদ্যোক্তাদের আগ্রহ—সব মিলিয়ে বাংলাদেশ এআই-এর সুবিধা নিতে প্রস্তুত। তবে এর জন্য দরকার হবে একটি জাতীয় কৌশল, শিক্ষা কারিকুলামে এআই অন্তর্ভুক্তি, অবকাঠামো উন্নয়ন এবং সাইবার নিরাপত্তা জোরদার করা।

চ্যালেঞ্জ ও সতর্কতা এআই প্রযুক্তির ব্যবহারে কিছু চ্যালেঞ্জও রয়েছে। যেমন- তথ্য গোপনীয়তা ও নিরাপত্তার হুমকি। কর্মসংস্থানে বৈষম্য ও অদক্ষতার সংকট। প্রযুক্তি নির্ভরতার ঝুঁকি। স্বল্প আয়ের জনগোষ্ঠী প্রযুক্তির বাইরে থেকে যেতে পারে। এ চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় সরকারকে দায়িত্বশীল ভূমিকা রাখতে হবে এবং নীতিমালা প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন নিশ্চিত করতে হবে।

এআই প্রযুক্তি নিঃসন্দেহে অর্থনীতিকে বহুগুণে শক্তিশালী করে তুলতে সক্ষম। এটি উৎপাদন বাড়ায়, ব্যয় হ্রাস করে, কর্মসংস্থান তৈরি করে এবং সেবা খাতকে দ্রুততর করে তোলে। তবে এ প্রযুক্তির সদ্ব্যবহার, উপযুক্ত নীতিমালা ও দক্ষ মানবসম্পদের সমন্বয় ছাড়া এটি একটি বিভ্রান্তির কারণও হতে পারে। সুতরাং বাংলাদেশসহ বিশ্বের সব দেশকে এআই প্রযুক্তিকে অর্থনৈতিক উন্নয়নের সহায়ক শক্তি হিসেবে গ্রহণ করতে হবে, যাতে মানবকল্যাণ ও অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা একসঙ্গে এগিয়ে যায়।

এসইউ/এএসএম