দেশজুড়ে

অবহেলা-উত্তেজনায় ঝরনায় ঝরছে পর্যটকের প্রাণ

অবহেলা-উত্তেজনায় ঝরনায় ঝরছে পর্যটকের প্রাণ

* বেপরোয়া আচরণে প্রাণ হারান পর্যটকরা* গাইড নিতে অনাগ্রহী পর্যটকরা* ফায়ার সার্ভিস নির্দেশনা দিলেও পদক্ষেপ নেয়নি বন বিভাগ

Advertisement

চট্টগ্রামের মিরসরাই ও সীতাকুণ্ড উপজেলার পাহাড়ি প্রাকৃতিক ঝরনাগুলোতে নির্দেশনা মানছেন না পর্যটকরা। দুই উপজেলায় বিগত ৫ বছরে ঝরনাগুলোতে ২২ পর্যটকের মৃত্যু হয়েছে। মারা যাওয়াদের বেশিরভাগ শিক্ষার্থী ও যুবক।

সর্বশেষ ১৫ জুন মিরসরাইয়ের রূপসী ঝরনার কূপে ডুবে আসিফ উদ্দিন (২৪) নামে এক শিক্ষার্থীর মৃত্যু হয়েছে। নিহত আসিফ চট্টগ্রাম শহরের সদরঘাট থানার পূর্ব মাদারবাড়ি কামাল গেইট এলাকার মো. সরওয়ার কামাল গোলাপের ছেলে। তিনি চট্টগ্রাম ইসলামিয়া ডিগ্রি কলেজের ফিন্যান্স অ্যান্ড ব্যাংকিং বিভাগের ৪র্থ বর্ষের শিক্ষার্থী ছিলেন।

এর আগে ১৪ জুন সীতাকুণ্ডের সহস্রধারা ঝরনায় পা পিছলে পড়ে নিহত হয় তাহসিন আনোয়ার (১৭)। সে চট্টগ্রাম ক্যান্টনমেন্ট পাবলিক স্কুল অ্যান্ড কলেজ থেকে এবার এসএসসি পরীক্ষায় অংশ নেয়। তাহসিন কেইপিজেডের প্রকৌশলী মো. আনোয়ার কবির ও জীবন বীমা করপোরেশনের মহাব্যবস্থাপক লুৎফর নাহারের একমাত্র ছেলে।

Advertisement

আরও পড়ুন-

মাথা গোঁজার ঠাঁইয়ের কাছে তুচ্ছ প্রাণের মায়া ঝরনা ও পাহাড় ভ্রমণে যেসব সতর্কতা জরুরি

একের পর এক পর্যটকের মৃত্যুতে পর্যটকদের নিরাপত্তায় বন বিভাগকে বেশ কয়েকটি পরামর্শ দিয়েছিল ফায়ার সার্ভিস। কিন্তু তার অনেকগুলো পরামর্শ বাস্তবায়ন করেনি বন বিভাগ। ফলে আবারো ঘটছে দুর্ঘটনা।

ফায়ার সার্ভিস ও বন বিভাগের কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে দুর্ঘটনায় পর্যটকদের হতাহতের বেশ কয়েকটি কারণ জানা গেছে। এর মধ্যে পর্যটকদের নির্দেশনা অমান্য করা, নিষিদ্ধ স্থানে গিয়ে ছবি তোলা, সাঁতার না জেনে ঝরনার কূপে নামা, অতিরিক্ত আত্মবিশ্বাস, পর্যটন স্পটে নিরাপত্তার অভাব, অভিভাবকদের উদাসীনতা, পর্যটন স্পটে মাদক গ্রহণ ও ঝরনায় যাওয়ার পথে গাইড না নিয়ে যাওয়া অন্যতম।

‘পর্যটকরা ঝরনায় গিয়ে কাণ্ডজ্ঞানহীন আচরণ করেন। ফলে দুর্ঘটনা রোধ করা যাচ্ছে না।’

Advertisement

সরেজমিনে রূপসী ঝরনায় দেখা গেছে, ঝরনার পাশে একটি গাছের সঙ্গে ফেস্টুন লাগানো আছে। সেখানে লেখা আছে, ‘বিপজ্জনক স্থান, সামনে যাওয়া নিষেধ’, ‘মাদককে না বলি, মাদক সেবনকারী ও বহনকারীকে পুলিশে সোপর্দ করা হবে’। একই রকম কয়েকটি ফেস্টুন টিকিট কাউন্টারের পাশে লাগানো। পর্যটকরা ঝরনায় যাওয়ার জন্য অপেক্ষা করছেন। ইজারাদারের লোকজন টিকিট কেটে পর্যটকদের ভেতরে ঢোকাচ্ছেন।

আরও পড়ুন-

ভাসমান পাহাড়ি ফলের হাটে কোটি টাকার বিক্রি উপকূলের প্লাস্টিক-পলিথিনের শেষ গন্তব্য সুন্দরবন

মিরসরাই ও সীতাকুণ্ড উপজেলায় ১৬টি পাহাড়ি ঝরনা রয়েছে। ঝরনাগুলো হলো খৈয়াছড়া ঝরনা, রূপসী ঝরনা, নাপিত্তাছরা ঝরনা, সোনাইছড়ি ঝরনা, বোয়ালিয়া ঝরনা, বাওয়াছরা ঝরনা, মেলখুম গিরিপথ, মহামায়া ঝরনা, ঝরঝরি ঝরনা, মধুখায়া ঝরনা, সহস্রধারা ১ ঝরনা, সহস্রধারা ২ ঝরনা, সুপ্তধারা ঝরনা, অগ্নিকুণ্ড ও বিলাসী ঝরনা। সবচেয়ে বেশি পর্যটক যায় খৈয়াছড়া ঝরনায়।

এর মধ্যে দুই উপজেলায় ৭টি ঝরনা ইজারা দিয়েছে বনবিভাগ। ইজারা দেওয়া ঝরনাগুলো হলো খৈয়াছরা ঝরনা, রূপসী ঝরনা, নাপিত্তাছড়া ঝরনা, বাওয়াছরা ঝরনা সহস্রধারা ১ ঝরনা, সহস্রধারা ২ ও সুপ্তধারা ঝরনা।

‘একজন গাইড নিতে গেলে কমপক্ষে ২০০ থেকে ৩০০ টাকা দিতে হয়। যেখানে দর্শনার্থীরা ২০ টাকা দিয়ে টিকিট কাটতে চান না, সেখানে ২০০ টাকা দিয়ে গাইড নেবেন কেন।’

দুর্ঘটনার কারণ অনুসন্ধানে জানা গেছে, বর্ষায় অসতর্কতা ও সাঁতার না জানার কারণে বেশিরভাগ দুর্ঘটনা ঘটে থাকে। এখানকার প্রাকৃতিক সৌন্দর্য উপভোগ করতে প্রকৃতিপ্রেমীরা জীবনের ঝুঁকি নেন। এছাড়া গাইড ছাড়া বিভিন্ন ঝরনায় যাওয়ার সময় পথ হারিয়ে গভীর জঙ্গলে চলে যাওয়া শতাধিক পর্যটককে উদ্ধার করেছে জোরারগঞ্জ থানা, মিরসরাই থানা ও সীতাকুণ্ড থানা পুলিশসহ ফায়ার সার্ভিসের টিম। তবুও এতে টনক নড়েনি বন বিভাগসহ সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের।

রূপসী ঝরনায় বেড়াতে আসা বেসরকারি চাকরিজীবী ইকবাল কবির জুয়েল বলেন, ঝরনার যে স্থানগুলো ঝুঁকিপূর্ণ সেখানে ইজারাদার অথবা বন বিভাগের পক্ষ থেকে সার্বক্ষণিক দায়িত্বশীল ব্যক্তি নিয়োগ করা প্রয়োজন।

খৈয়াছরা ঝরনায় আসা চট্টগ্রাম সরকারি সিটি কলেজের ছাত্র আব্দুল আউয়াল তুহিন বলেন, এখানে স্থানীয় দোকানদাররা পর্যটকদের হয়রানি করে। যেকোনো জিনিসের দাম বেশি রাখে। কিছু বলাও যায় না। স্থানীয় প্রশাসন ও বন বিভাগের এ ব্যাপারে পদক্ষেপ গ্রহণ করা প্রয়োজন।

আরও পড়ুন-

দেশি-বিদেশি পর্যটকে মুখর পানাম সিটি ঈদে সিলেটে পর্যটক সমাগম নিয়ে শঙ্কা

দুর্ঘটনা প্রতিরোধে বন বিভাগকে বেশ কিছু পরামর্শও দিয়েছিল ফায়ার সার্ভিস। এগুলো হলো, যেসব পর্যটক একদম সাঁতার জানেন না কিংবা কম সাঁতার জানেন, তাদের অবশ্যই পানিতে নামতে না দেওয়া, বিপজ্জনক গর্ত কিংবা বেশি গভীরতার জলাশয়ের সামনে সতর্কতামূলক সাইনবোর্ড স্থাপন, ইজারাদারের লোক বাড়ানো ও অনুমোদনহীন পর্যটন স্পট বন্ধ করে দেওয়া।

সীতাকুণ্ড ফায়ার সার্ভিসের সিনিয়র কর্মকর্তা মচিন্দ্র লাল ত্রিপুরা বলেন, দুর্ঘটনা প্রতিরোধে বন বিভাগকে আমাদের পক্ষ থেকে বেশ কিছু পরামর্শ দেওয়া হয়। কিন্তু বনবিভাগ এ বিষয়ে তেমন পদক্ষেপ নেয়নি। পদক্ষেপ গ্রহণ করলে হয়ত দুর্ঘটনা কমে আসত।

বন বিভাগের বারইয়াঢালা রেঞ্জ কর্মকর্তা আশরাফুল আলম বলেন, পর্যটকরা ঝরনায় গিয়ে কাণ্ডজ্ঞানহীন আচরণ করেন। ফলে দুর্ঘটনা রোধ করা যাচ্ছে না। ঝরনার সামনে সতর্কতামূলক সাইনবোর্ড না থাকার বিষয়টিও স্বীকার করেন তিনি।

‘বেশিরভাগ পর্যটক আসে সমতল থেকে। তাদের পাহাড় ও ঝরনার নিচের কূপের গভীরতা সর্ম্পকে ধারণা থাকে না। তাই না জেনে পর্যটকরা দুর্ঘটনায় পতিত হচ্ছে। ঝরনায় আসা সবাইকে আগে থেকে ধারণা নেওয়া উচিত।’

আশরাফুল আলম বলেন, রূপসী ঝরনার সামনে একটি ছোট্ট কুয়া আছে। সেটির গভীরতা অনেক। ফলে ছোট্ট কুয়াটি ঝুঁকিপূর্ণ। গত বছরের ৪ অক্টোবর সেখানে এক পর্যটক পড়ে মারা যান। তাকে রক্ষা করতে গিয়ে আরও একজন মারা যান। এ দুজনের মরদেহ উদ্ধার করতে ফায়ার সার্ভিসের চার ঘণ্টা সময় লেগেছিল। রোববার দুপুরেও পাহাড়ের ওপর থেকে ঝুঁকি নিয়ে একজন লাফ দেন। তিনি মারা যান।

আশরাফুল আলম আরও বলেন, দুর্ঘটনা বেড়ে যাওয়ায় তারা ইজারাদারের সঙ্গে যোগাযোগ করেছেন। সতর্কতামূলক ব্যবস্থা নিতে বলেছেন। ইজারাদাররা এ বছর কিছু সতর্কতামূলক ব্যবস্থা নিয়েছেন। বিশেষ করে লাইফ জ্যাকেট, লাইফ বয়া ও গাইড রাখছেন এখন, যা গত বছর ছিল না। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে, একজন গাইড নিতে গেলে কমপক্ষে ২০০ থেকে ৩০০ টাকা দিতে হয়। যেখানে দর্শনার্থীরা ২০ টাকা দিয়ে টিকিট কাটতে চান না, সেখানে ২০০ টাকা দিয়ে গাইড নেবেন কেন।

রেঞ্জ কর্মকর্তা আরও বলেন, অনেক পর্যটক মাদকাসক্ত হয়ে আসেন অথবা পাহাড়ের ভেতরে এসে মাদক নেন। তাদের অনেক জায়গায় যাওয়ার জন্য নিষেধ করলেও মানেন না। সবচেয়ে বেশি ক্ষতি করছে অতিরিক্ত আত্মবিশ্বাস। তরুণরা ঝোঁকের বশে হ্রদ কিংবা ঝরনায় সৃষ্ট কুয়ায় নেমে পড়েন। অনেক সময় পাহাড়ের ওপর থেকে লাফ দেন। এতেই বিপত্তি ঘটে।

বন বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, ২০২৫ সালে বারৈয়াঢালা জাতীয় উদ্যানের অধীনে ঝরনাগুলোর ইজারা দেয় বন বিভাগ। এ বছর ভ্যাটসহ প্রায় ৪৮ লাখ টাকায় ইজারা দেওয়া হয়। ইজারা নেন ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান এ.আর এন্টারপ্রাইজ।

এ বিষয়ে ঝরনা ইজারা নেওয়া ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান এ.আর এন্টারপ্রাইজের অন্যতম ইজারাদার এস.এম হারুন বলেন, এ বছর তারা সাঁতার কাটতে পানিতে নামতে নিরুৎসাহিত করেছেন। কিন্তু পর্যটকরা শুনতে চান না। বিভিন্ন ধরনের সচেতনতামূলক ফেস্টুন টাঙানো হয়েছে। গাইড নিয়ে যাওয়ার পরামর্শ দেওয়া হলেও তা তারা মানেন না। ফলে দুর্ঘটনা ঘটে যায়।

এ বিষয়ে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ফরেস্ট্রি বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক ড. কামাল হোসেন বলেন, বেশিরভাগ পর্যটক আসে সমতল থেকে। তাদের পাহাড় ও ঝরনার নিচের কূপের গভীরতা সর্ম্পকে ধারণা থাকে না। তাই না জেনে পর্যটকরা দুর্ঘটনায় পতিত হচ্ছে। ঝরনায় আসা সবাইকে আগে থেকে ধারণা নেওয়া উচিত।

এ বিষয়ে মিরসরাই উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) সোমাইয়া আক্তার বলেন, ঝরনায় প্রাণহানি রোধে বনবিভাগ ও ইজারাদারদের নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। তারা যেন পর্যটকদের নিরাপত্তায় পর্যাপ্ত ব্যবস্থা নেয়।

তিনি আরো বলেন, ঝরনায় আসা পর্যটকদের সচেতন করতে স্থানীয় স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের নেতৃবৃন্দের সঙ্গেও বসবো।

এফএ/জেআইএম