আবাসন খাতে স্থবিরতার জন্য ড্যাপকে (বিশদ অঞ্চল পরিকল্পনা) দুষছেন ব্যবসায়ীরা। ঢাকা শহরের জমির মালিকরাও ব্যবসায়ীদের সঙ্গে একমত। ফ্ল্যাট-অ্যাপার্টমেন্ট ব্যবসায় নেমেছে ধস। রাজস্ব হারাচ্ছে সরকার। অনেক প্রতিষ্ঠান বাধ্য হচ্ছে কর্মী ছাঁটাইয়ে।
Advertisement
এসব বিষয় নিয়ে কথা বলেন রিয়েল এস্টেট অ্যান্ড হাউজিং অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (রিহ্যাব) সহ-সভাপতি লিয়াকত আলী ভূঁইয়া। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক ইয়াসির আরাফাত রিপন।
জাগো নিউজ: বর্তমানে আবাসন খাতের সার্বিক পরিস্থিতি কেমন?
লিয়াকত আলী ভূঁইয়া: প্রায় সবাই একমত যে বৈষম্য ও অসঙ্গতিপূর্ণ ড্যাপের (২০২২-৩৫) কারণে আবাসন সেক্টরে স্থবিরতা বিরাজ করছে। সংকট দেখা দিয়েছে আবাসন খাতসংশ্লিষ্ট লিংকেজ শিল্পেও। বিক্রি নেই। লোকসান কমাতে অনেকে উৎপাদন কমিয়ে দিয়েছেন। অনেকেই আবার জনবলও ছাঁটাই করেছেন সংকট মোকাবিলায়। ড্যাপ কেন্দ্র করে আবাসন খাতে এ অচলাবস্থার প্রভাব পড়বে দেশের অর্থনীতিতে।
Advertisement
দিন যত যাচ্ছে কর্মসংস্থানের আশায় নতুন নতুন মানুষের প্রবেশ ঘটছে এ শহরে। এ শহরকে বাসযোগ্য করে তুলতে হলে সু-উচ্চ ভবনের প্রয়োজন পড়বে। ভবন ছোট হলে কৃষিজমির ওপরে ভবন তৈরি হবে, নদী-নালা ভরাট হবে
প্ল্যান পাস না থাকায় বিল্ডিংয়ের কাজ হচ্ছে না, যেখানে সরকারও রাজস্ব হারাচ্ছে। বিপরীতে কর্মসংস্থান কমছে। কারণ যে কোনো প্রতিষ্ঠানে কাজ না থাকলে কর্মী ছাঁটাই করতে বাধ্য হন তারা। এ অবস্থায় দেশের অর্থনীতির চাকা সচল রাখতে, কর্মসংস্থান বাড়াতে এবং জিডিপিতে নেতিবাচক প্রভাব এড়াতে সরকারকে দ্রুত পদক্ষেপ নেওয়ার দাবি জানাই আমরা।
জাগো নিউজ: কেন ড্যাপের বিরোধিতা করছেন?
লিয়াকত আলী ভূঁইয়া: দিন যত যাচ্ছে কর্মসংস্থানের আশায় নতুন নতুন মানুষের প্রবেশ ঘটছে এ শহরে। এ শহরকে বাসযোগ্য করে তুলতে হলে সু-উচ্চ ভবনের প্রয়োজন পড়বে। ভবন ছোট হলে কৃষিজমির ওপরে ভবন তৈরি হবে, নদী-নালা ভরাট হবে, যা পরিবেশের জন্য বিপর্যয় ডেকে আনবে।
Advertisement
যেহেতু জমির স্বল্পতা আছে, সেই বিবেচনায় ঢাকা মহানগরের ড্যাপ ২০২২-৩৫ এর বিতর্কিত বিধি-বিধানগুলো স্থগিত করে মহল্লার রাস্তা প্রশস্ত ও জনস্বার্থে মহানগর ইমারত নির্মাণ বিধিমালা ২০০৮ এর বিধি-বিধান অনুসারে ভবন নির্মাণের অনুমতি দিতে হবে। পাশাপাশি বৈষম্য ও অসঙ্গতিপূর্ণ ড্যাপ (২০২২-৩৫) বাতিল করতে হবে। কারণ, এই ড্যাপের কারণে কৃষিজমি ধ্বংস হবে, জলাধার আইন ভঙ্গ করে প্রণীত এ ড্যাপ বাতিল করতে হবে। বাতিল বা সংশোধন করা না হলে জলাধার থাকবে না।
ড্যাপকে আমরা বৈষম্যমূলক বলছি। ড্যাপের জন্য এখনো সুবিধাবাদি কয়েকজন নগর পরিকল্পনাবিদ মায়াকান্না করছেন। এটা তাদের নিজস্ব স্বার্থ হাসিলের জন্য করছেন। এর মাধ্যমে ঢাকা থেকে নাগরিকদের বের করে দিতে চাচ্ছেন তারা
এই ড্যাপে ফার কমিয়ে দেওয়ার ফলে ভূমি মালিকরা ভবন নির্মাণে নিরুৎসাহিত হচ্ছেন। ফলে পাড়া-মহল্লার রাস্তা-ঘাটগুলো অপ্রশস্ত থেকে যাচ্ছে। পুরাতন ও জরাজীর্ণ ভবনগুলো অস্বাস্থ্যকরই থেকে যাচ্ছে। ফারের কারণে পাশের দুই বাড়ি ১০ তলা মাঝের বাড়িটা কেন পাঁচতলা হবে? আমাদের দাবির মূল কারণ হলো আমরা বৈষম্যমুক্ত দেশ চাই এবং ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য আবাসন নিশ্চিত করতে চাই।
জাগো নিউজ: এ খাতের সংকট কি তাহলে ড্যাপ?
লিয়াকত আলী ভূঁইয়া: ড্যাপকে আমরা বৈষম্যমূলক বলছি। ড্যাপের জন্য এখনো সুবিধাবাদি কয়েকজন নগর পরিকল্পনাবিদ মায়াকান্না করছেন। এটা তাদের নিজস্ব স্বার্থ হাসিলের জন্য করছেন। এর মাধ্যমে ঢাকা থেকে নাগরিকদের বের করে দিতে চাচ্ছেন তারা। একটা কথা বলা দরকার, এই আবাসন খাত ধ্বংস হলে বহু শিল্প প্রতিষ্ঠান বন্ধ হবে। বহু লোক বেকার হয়ে পড়বে। নির্মাণখাত ইতোমধ্যেই ব্যাপক ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছে। সরকারের রাজস্ব আয় কমে যাচ্ছে, বেকারত্বের হার দিন দিন বেড়েই যাচ্ছে। সব দিক বিবেচনায় নিয়ে বেআইনি ড্যাপ দ্রুত বাতিল করে জনবান্ধব নতুন ড্যাপ প্রণয়নের কথা আমরা বলছি।
জাগো নিউজ: নির্মাণশিল্পের সঙ্গে লিংকেজ শিল্পে স্থবিরতা দেখা দিয়েছে, প্রভাব কেমন হতে পারে?
লিয়াকত আলী ভূঁইয়া: বর্তমানে আবাসন শিল্পে ৪০ লাখেরও বেশি মানুষের কর্মসংস্থান আর প্রায় দুই কোটি মানুষের জীবিকা এর সঙ্গে জড়িত। সারাদেশে ফ্ল্যাট ও জমিবাবদ প্রায় ১৩ হাজার কোটি টাকা রাজস্ব পায় সরকার। তাছাড়া ২০০টির বেশি লিংকেজ শিল্প আবাসন ব্যবসার সঙ্গে জড়িত। এর মধ্যে অন্যতম রড, সিমেন্ট, ইট, ক্যাবল, রং, টাইলস, লিফট, থাই অ্যালুমিনিয়াম, স্যানিটারি সামগ্রী ইত্যাদি। এসবের বাজারে মারাত্মক মন্দাভাব চলছে।
যেখানে প্রায় দুই কোটি মানুষের জীবিকা জড়িত, দুইশর বেশি লিংকেজ কোম্পানি জড়িত সেই খাত বাঁচিয়ে রাখতে হবে অর্থনীতির স্বার্থে। একটা দেশের উন্নয়নে যে খাত সরাসরি জড়িত সেই খাতের সংকট দূর করা সরকারের দায়িত্ব
নির্মাণের প্রধান উপকরণ রডের চাহিদা ৫০ শতাংশ কমে গেছে। চাহিদা না থাকায় অনেক শিল্প প্রতিষ্ঠান উৎপাদন কমিয়ে দিয়েছে। লোকসান কমাতে অনেক প্রতিষ্ঠান শ্রমিক ছাঁটাইয়ে বাধ্য হচ্ছে, এটা দিন দিন বাড়ছে। এ অবস্থা চলতে থাকলে বড় বিপর্যয় নেমে আসবে, জাতীয় অর্থনীতিতেও এর প্রভাব পড়বে। আবাসন খাত ও সংশ্লিষ্ট শিল্পগুলোর সংকট নিরসনে জরুরি পদক্ষেপ না নিলে জাতীয় অর্থনীতিতে দীর্ঘমেয়াদি নেতিবাচক প্রভাব পড়বে, যা দেশের উন্নয়ন থমকে দিতে পারে।
জাগো নিউজ: সংকট নিরসনে রিহ্যাবের পক্ষে সরকারের উদ্দেশ্যে কি আহ্বান থাকবে?
লিয়াকত আলী ভূঁইয়া: যেখানে প্রায় দুই কোটি মানুষের জীবিকা জড়িত, দুইশর বেশি লিংকেজ কোম্পানি জড়িত সেই খাত বাঁচিয়ে রাখতে হবে অর্থনীতির স্বার্থে। একটা দেশের উন্নয়নে যে খাত সরাসরি জড়িত সেই খাতের সংকট দূর করা সরকারের দায়িত্ব। আমাদের এক ড্যাপ কেন্দ্র করে আবাসন খাতে এই অচলাবস্থা চলতে থাকলে অর্থনীতির চাকা থমকে যাবে। ফলে বেকারত্ব বাড়বে, কর্মসংস্থান কমবে এবং জিডিপিতে নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। স্থবিরতা প্রকট থেকে প্রকটতর হচ্ছে। সরকারকে দ্রুত পদক্ষেপ নিয়ে ড্যাপ বাতিল অথবা সংশোধনের আহ্বান জানাই। বৈষম্যমুক্ত দেশ আর ভবিষ্যৎ প্রজন্মের আবাসন নিশ্চিতে ড্যাপ সংশোধন জরুরি।
ইএআর/এএসএ/এমএফএ/জেআইএম