জাতীয়

দখল-ভগ্নদশায় শ্রীহীন ঢাকার যাত্রী ছাউনি, যেখানে দরকার সেখানে নেই

দখল-ভগ্নদশায় শ্রীহীন ঢাকার যাত্রী ছাউনি, যেখানে দরকার সেখানে নেই

• ডিএনসিসি-ডিএসসিসিতে দেড় শতাধিক যাত্রী ছাউনি • হকার, টিকিট কাউন্টারের দখলে বেশকিছু• অধিকাংশ ছাউনিই ব্যবহার অনুপযোগী

Advertisement

ঢাকার বনানীর কাকলী পদচারী সেতুর পূর্বপাশের ফুটপাতে দাঁড়িয়ে মগবাজারগামী বাসের অপেক্ষা করছিলেন নাজমুল হুদা। বাস আসার আগেই আচমকা শুরু হয় ঝুম বৃষ্টি। দৌড়ে পাশের একটি যাত্রী ছাউনিতে গিয়ে দাঁড়ান। কিন্তু ছাউনিতে অসংখ্য ফুটো। ভিতরে আর বাইরে খুব পার্থক্য রইলো না। ভিজে হলেন একাকার।

তেঁজগাও সাতরাস্তা মোড়ের যাত্রী ছাউনির চিত্রটি আবার ভিন্ন। মোড়ের পূর্ব-উত্তর কোণে রয়েছে একটি কংক্রিটের পুরোনো যাত্রী ছাউনি। এর একাংশ দখল করে গড়ে উঠেছে একটি দোকান। আরেকাংশে যাত্রীদের বসা বা দাঁড়ানোর কোনো সুযোগ নেই। যাত্রী ছাউনি থেকে খসে পড়ছে পলেস্তরা। ফলে যাত্রীদের বাইরে দাঁড়িয়েই গাড়ির জন্য অপেক্ষা করতে দেখা যায়।

মৎস্য ভবনের পশ্চিম পাশে তথা রমনা পার্কের দক্ষিণ-পূর্ব পাশের ফুটপাতটি মাত্র আট ফুট চওড়া। এরই মাঝ বরাবর ৬ ফুট চওড়া স্টিলের যাত্রী ছাউনি। তার মধ্যে বসানো হয়েছে বেঞ্চ। অথচ এখানে কোনো বাস যাত্রী তুলতে দেখা যায়নি। ছাউনিতে বিভিন্ন রঙের ফুলের পসরা সাজিয়ে বসেছেন এক হকার।

Advertisement

ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন (ডিএনসিসি) ও ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের (ডিএসসিসি) অধিকাংশ যাত্রী ছাউনির চিত্র এমনই। যেখানে যাত্রী ছাউনি দরকার, সেখানে নেই। আবার যেখানে ছাউনি আছে, সেখানে দাঁড়ানো বা বসার ব্যবস্থা নেই। যেগুলোতে বসার ব্যবস্থা আছে তাও আবার হকার, ভাসমান লোকজনের দখলে।

ঢাকা শহরে দুই কোটির বেশি মানুষের বাস। কিন্তু তাদের জন্য শহরে পর্যাপ্ত যাত্রী ছাউনি নেই। যেগুলো আছে, তা আবার বেদখলে। অনেকগুলো যাত্রী ছাউনি ব্যবহার অনুপযোগী। ফলে এটি নাগরিকদের প্রতিদিনের ভোগান্তি।- বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতির মহাসচিব মোজাম্মেল হক চৌধুরী

নগরবাসীর অভিযোগ, নগরে মানুষের তুলনায় যাত্রী ছাউনির সংখ্যা খুবই কম। আবার যে কয়েকটি যাত্রী ছাউনি আছে, তা নাগরিক সুরক্ষায় তেমন কোনো ভূমিকা রাখছে না। অথচ চলার পথে রোদ-বৃষ্টি থেকে বাঁচতে যাত্রী ছাউনি খুবই জরুরি। এ দুর্ভোগ লাঘবে নগর কর্তৃপক্ষের কোনো ভূমিকাই যেন নেই। উল্টো তাদের নজরদারির অভাবে অনেক যাত্রী ছাউনি দখল হয়ে গেছে। বিষয়টি ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনকে গুরুত্ব দিতে হবে।

মিরপুরের আনসার ক্যাম্প, মতিঝিল, বাড্ডা, রামপুরাসহ শহরের বিভিন্ন লোকেশনে যাত্রী ছাউনির প্রয়োজনীয়তা থাকলেও সেখানে নেই। আবার এমন কিছু স্থানে ছাউনি তৈরি করা হয়েছে যেখানে মানুষজনের আনাগোনা কম কিংবা বাস দাঁড়ায় না।

Advertisement

গুলশান-১ থেকে সড়কের উত্তর পাশের ফুটপাত দিয়ে এগোলেই লেকপাড়ে রয়েছে একটি যাত্রী ছাউনি। সরেজমিনে দেখা যায়, যাত্রী ছাউনির ওপর লেখা- ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন। কিন্তু ভেতরে হরেক রকম পণ্যের পসরা সাজিয়ে বসে আছেন হকার। তাদের কারণে সামনের ফুটপাত দিয়েই পথচারীরা হাঁটাচলা করতে পারছেন না। আবার কোনো যাত্রীকে বাসে ওঠার জন্য এখানে দাঁড়াতেও দেখা যায়নি।

আরও পড়ুন পরিত্যক্ত পণ্য কিনে ডিএনসিসির ডেঙ্গু প্রতিরোধ কার্যক্রম বন্ধ ঘোষিত ‘নীরব এলাকায়’ হর্নে কান ঝালাপালা ঢাকার জলাবদ্ধতা নিরসনে মাস্টারপ্ল্যান তৈরির কাজ চলছে গণবিজ্ঞপ্তি দিয়েই দায়সারা পুলিশের, আন্দোলনে নগরবাসীর ভোগান্তি

এ যাত্রী ছাউনির ভেতর ঝুড়িতে ফলের দোকান দিয়েছেন মনির হোসেন। এখানে দোকান বসানোর কারণ জানতে চাইলে মনির বলেন, ‘এ যাত্রী ছাউনিতে কখনোই যাত্রী দাঁড়ায় না। বাস থামে গুলশান-১ নম্বর মোড়ে। তাই ফাঁকা যাত্রী ছাউনিতে যে যখন পারছে দোকান বসায়। এ নিয়ে সিটি করপোরেশনের লোকজন নিষেধ করেনি।’

গুলশান-১ মোড় থেকে ডেমরা স্টাফ কোয়ার্টার যাওয়ার জন্য দাঁড়িয়ে ছিলেন লতিফুল ইসলাম। যাত্রী ছাউনিতে না দাঁড়িয়ে মোড় থেকে বাসে ওঠার কারণ জানতে চাইলে লতিফুল বলেন, ‘ওই যাত্রী ছাউনি হকারদের দখলে। সেখানে বাস থামে না। সব যাত্রী গুলশান মোড়েই দাঁড়ায়। এ নগরে সব কিছুই অপরিকল্পিত। এর মধ্যে গণপরিবহন ব্যবস্থাপনা সবচেয়ে নাজুক।’

জানতে চাইলে বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতির মহাসচিব মোজাম্মেল হক চৌধুরী জাগো নিউজকে বলেন, ‘ঢাকা শহরে দুই কোটির বেশি মানুষের বাস। এর মধ্যে প্রায় অর্ধকোটি মানুষ প্রয়োজনে নগরের এক জায়গা থেকে আরেক স্থানে বাসে যাতায়াত করেন। কিন্তু তাদের জন্য শহরে পর্যাপ্ত যাত্রী ছাউনি নেই। যেগুলো আছে, তা আবার বেদখলে। আবার অনেকগুলো যাত্রী ছাউনি ব্যবহার অনুপযোগী। ফলে এটি নাগরিকদের প্রতিদিনের ভোগান্তি।’

এখন ডিএসসিসি এলাকায় নতুন-পুরোনো মিলে ৬০টির বেশি যাত্রী ছাউনি আছে। এগুলোর মধ্যে যেগুলো ভাড়া তা পুনর্নির্মাণ করা হবে। আর কোথায়ও কোনো যাত্রী ছাউনি বেদখল হয়ে থাকলে অবৈধ দখলদারদের উচ্ছেদ করা হবে।-ডিএসসিসির তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী (ট্রাফিক ইঞ্জিনিয়ারিং সার্কেল) রাজীব খাদেম

তিনি বলেন, ‘সিটি করপোরেশন একটি জনসেবামূলক সংস্থা। তাদের উচিত, মানুষের ভোগান্তির জায়গাগুলো পর্যবেক্ষণ করা। নগরে ফুটপাতেও পথচারীরা ঠিকমতো চলতে পারছে না। অথচ ফুটপাত দখলমুক্ত থাকলে অনেকে যানজট এড়াতে হেঁটেই অল্প দূরত্বের গন্তব্যে যেতে পারেন। এজন্য মানুষের নির্বিঘ্নে যাতায়াত নিশ্চিত করতে হবে।’

ঢাকায় কত যাত্রী ছাউনি?

ডিএনসিসি ও ডিএসসিসি সূত্র জানায়, দুই বছর আগে রাজধানীতে যাত্রীসেবা বৃদ্ধি ও গণপরিবহনের নৈরাজ্য ঠেকাতে রাস্তার পাশে ঢাকার দুই সিটি করপোরেশন আলোচনা করে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় এবং ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের সঙ্গে। তখন ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের চাহিদা মোতাবেক ঢাকা দক্ষিণকে ৭০টি ও উত্তরকে ৬০টি বাস স্টপেজ এবং যাত্রী ছাউনি নির্মাণের জন্য তালিকা দেওয়া হয়। এ তালিকা অনুযায়ী ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন দুটি প্রকল্পের আওতায় মাত্র ৪০টির নির্মাণকাজ শেষ করেছে। উত্তর সিটি করপোরেশন তৈরি করেছে মাত্র ৯টি। এছাড়া পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়ের নির্মল বায়ু ও টেকসই পরিবেশ (কেইস) প্রকল্পের অধীনে যাত্রী ছাউনি প্রকল্পটির ১৯টি নির্মাণ করা হয়েছিল।

এসব যাত্রী ছাউনির পাশে উন্নত ফুটপাত, বিশুদ্ধ খাবার পানি, ওয়াইফাই, টি-স্টল ও মোবাইল ফোন চার্জের ব্যবস্থা থাকার কথা থাকলেও এমন কোনো কিছু দেখা যায়নি কোনো যাত্রী ছাউনিতে। এগুলোর মধ্যে বেশ কয়েকটিতে রয়েছে বাস কাউন্টার ও দোকান। অধিকাংশই ব্যবহার অনুপোযোগী।

সম্প্রতি সরেজমিনে দেখা যায়, রাজধানীর অধিকাংশ যাত্রী ছাউনিতেই যাত্রীদের বসার মতো অবস্থা নেই। ছাউনিগুলোর অধিকাংশের বেঞ্চ, ছাউনি কে বা কারা খুলে নিয়ে গেছে। কোনো কোনো যাত্রী ছাউনি পরিণত হয়েছে ময়লার ভাগাড় কিংবা মলমূত্র ত্যাগের স্থানে। এগুলো সব সময় অপরিচ্ছন্ন থাকায় স্থান করে নিয়েছে পাগল ও ভবঘুরেরা। কোনো কোনো যাত্রী ছাউনিতে রাতে বসে মাদকসেবীদের আড্ডা। আবার অনেকগুলো দখল করে কেউ কেউ বসিয়েছেন দোকান। ফলে যেখানে যাত্রীদের অবস্থান নেওয়ার কথা সেখানে আসতে যাত্রীরাই ভয় পাচ্ছেন কিংবা এ অব্যবস্থাপনার কারণে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছেন।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ডিএসসিসির প্রকৌশল বিভাগের এক কর্মকর্তা বলেন, ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনের প্রায় দেড় শতাধিক (পুরোনো ও নতুন মিলে) যাত্রী ছাউনি রয়েছে। যেগুলোর মধ্যে সিটি করপোরেশনের রয়েছে প্রায় ১০০টির মতো এবং বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান কিংবা অন্য কোনো বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের তৈরি করা যাত্রী ছাউনি রয়েছে ৫০টিরও বেশি। কিন্তু এগুলোর অধিকাংশই ব্যবহার করতে পারছে না সাধারণ যাত্রীরা।

ছয় বছর আগে পান্থকুঞ্জ পার্কের দক্ষিণ-পূর্ব কোণে একটি যাত্রী ছাউনি নির্মাণ করেছিল ডিএসসিসি। এখন সেখানে এর কোনো অস্তিত্ব নেই। স্টিলের কাঠামোর যাত্রী ছাউনিটি ভাসমান লোকজন খুলে নিয়ে গেছে বলে জানান স্থানীয় বাসিন্দারা। ফলে এখন এ জায়গা থেকে নগরের বিভিন্ন গন্তব্যে যাতায়াত করা যাত্রীদের রোদ-বৃষ্টিতে ভিজতে হয়।

ডিএসসিসির তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী (ট্রাফিক ইঞ্জিনিয়ারিং সার্কেল) রাজীব খাদেম জাগো নিউজকে বলেন, ‘এখন ডিএসসিসি এলাকায় নতুন-পুরোনো মিলে ৬০টির বেশি যাত্রী ছাউনি আছে। এগুলোর মধ্যে যেগুলো ভাড়া তা পুনর্নির্মাণ করা হবে। আর কোথায়ও কোনো যাত্রী ছাউনি বেদখল হয়ে থাকলে অবৈধ দখলদারদের উচ্ছেদ করা হবে।’

তিনি বলেন, ‘বাস রুট রেশনালাইজেশনের জন্য রুটভিত্তিক কিছু যাত্রী ছাউনি নির্মাণ করা হয়েছিল। কিন্তু এখন বাস রুট রেশনালাইজেশনের কার্যক্রম বন্ধ। তাই ঢাকা সড়ক পরিবহন মালিক সমিতি ও ঢাকা মহানগর পুলিশের চাহিদা অনুযায়ী প্রয়োজনীয় স্থানে আরও যাত্রী ছাউনি নির্মাণ করা হবে।’

ডিএনসিসির তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী (ট্রাফিক ইঞ্জিনিয়ারিং সার্কেল) খন্দকার মাহবুব আলম এ বিষয়ে আনুষ্ঠানিক কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি। তবে নাম প্রকাশ না করা শর্তে ট্রাফিক ইঞ্জিনিয়ারিং সার্কেলের এক কর্মকর্তা বলেন, ডিএনসিসিতে নতুন-পুরোনো মিলে ৫০টির মতো যাত্রী ছাউনি আছে। এর মধ্যে পুরোনো যাত্রী ছাউনির স্থলে নতুন করে নির্মাণের উদ্যোগ নিয়েছে ডিএনসিসি। ঈদুল আজহার পরপর এ বিষয়ে করণীয় নির্ধারণ করা হবে।’

এমএমএ/এএসএ/এমএফএ/এএসএম