রংপুরে সমন্বিত শিশু পুনর্বাসন কেন্দ্র থেকে চার কিশোরী নিখোঁজের ঘটনায় তোলপাড় শুরু হয়েছে। এ ঘটনায় রোববার (১৫ জুন) পুলিশ দুজনকে উদ্ধার করলেও এখনো নিখোঁজ রয়েছে দুই কিশোরী।
Advertisement
উদ্ধার হওয়া দুই কিশোরী পুনর্বাসন কেন্দ্রে শিশু-কিশোরীদের শারীরিক, মানসিক ও যৌন নির্যাতনের ভয়াবহ তথ্য দিয়েছে। জীবন বাঁচাতে তারা পালিয়ে আসার কথা জানিয়েছে।
তবে এসব ঘটনায় মুখ খুলতে নারাজ সমাজসেবা অধিদপ্তরের রংপুর জেলা কার্যালয়ের উপপরিচালক অনিল চন্দ্র বর্ম্মন। অবিলম্বে ঘটনার সুষ্ঠু তদন্তসহ দোষীদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়ার দাবি জানিয়েছেন মানবাধিকার কর্মীরা।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ১০০ শয্যা বিশিষ্ট সমন্বিত শিশু পুনর্বাসন কেন্দ্রটি রংপুর নগরীর দেওডোবা ডাংগীরপাড় এলাকায় অবস্থিত। এতে বর্তমানে প্রায় ৬৮ জন নিবাসী রয়েছে। এখানে হারিয়ে যাওয়া, প্রতিবন্ধী, এতিম ও মামলা সংক্রান্ত কারণে আদালত থেকে পাঠানো শিশু-কিশোরীরা থাকে। ১২ জুন রাতে এ কেন্দ্র থেকে নিতু, স্মৃতি, কৃতি ও আশা নামের চার কিশোরী নিখোঁজ হয়। পরে পরিবারের অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে দুদিন পর রোববার (১৫ জুন) স্মৃতি ও কৃতিকে উদ্ধার করে পুলিশ। পরে পুলিশ তাদের আদালতের মাধ্যমে পুনরায় সমন্বিত শিশু পুনর্বাসন কেন্দ্রে (বালিকা) পাঠায়। কিন্তু আদালতের বারান্দায় থাকা স্মৃতির মা মুক্তি বেগম মেয়েকে পুনর্বাসন কেন্দ্রে পাঠাতে পুলিশের কাছে আপত্তি জানায়।
Advertisement
আপত্তির কারণ হিসেবে পুনর্বাসন কেন্দ্রে মেয়ের ওপর নির্যাতন ও তার জীবনের নিরাপত্তা নিয়ে শঙ্কা প্রকাশ করেন তিনি। মেয়েকে থানার ভিকটিম সাপোর্ট সেন্টারে রাখতে পুলিশের কাছে আবেদন করেন মুক্তি বেগম। কিন্তু আদালতের আদেশ ছাড়া এটি সম্ভব নয় বলে জানায় পুলিশ। মুক্তি বেগম অভিযোগ করে বলেন, পুনর্বাসন কেন্দ্রে নিবাসীদের শারীরিক-মানসিক নির্যাতন, রাতের বেলায় পুরুষ মানুষের আসা-যাওয়াসহ নানা অনিয়ম চলে।
তিনি আরও জানান, পুনর্বাসন কেন্দ্র থেকে স্মৃতি নিখোঁজ হলে থানায় সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করতে চান তিনি। কিন্তু ঘটনাকে ধামাচাপা দিতে থানায় জিডি করতে দেননি সমাজসেবার কর্মকর্তারা। পরে অবস্থা বেগতিক দেখে সমাজসেবা কর্মকর্তারা নড়েচড়ে বসেন এবং জিডি করেন। স্মৃতিকে খুঁজে পাওয়ার পর তাকে বাড়ি নিয়ে যেতে চাইলে বাধা দেন পুনর্বাসন কেন্দ্রের দায়িত্বরতরা।
পুনর্বাসন কেন্দ্র থেকে পালিয়ে কিশোরীদের একজন (১৭) জানায়, পুনর্বাসন কেন্দ্রে নিবাসীদের নানা ধরনের শারীরিক-মানসিক ও যৌন নির্যাতন করা হয়। প্রতি রোববার একজন পুরুষ মানুষ পুনর্বাসন কেন্দ্রে আসেন এবং যৌন হয়রানি করেন। এরইমধ্যে এক মেয়ে গর্ভবতী হয়ে পড়ে। তাকে এখন কেন্দ্রে দেখা যাচ্ছে না।
ওই কিশোরী আরও বলে, ‘প্রায় সময় মেয়েদের সঙ্গে এমন ঘটে। আমি এর প্রতিবাদ জানালে আমাকে গালিগালাজ করে। আদালত আমার ভালোর জন্য পুনর্বাসন কেন্দ্রে রেখেছিল। কিন্তু সেখানকার অবস্থা দেখে জীবন বাঁচাতে পালিয়ে গিয়েছিলাম। কেন্দ্রের আশা ও মীম নামের দুই কিশোরীও শারীরিক-মানসিক নির্যাতনের শিকার হয়েছে। এছাড়া অনেক মেয়েরা নির্যাতনের শিকার হয়ে পুনবার্সন কেন্দ্রে থাকতে চায় না, প্রায় সময় কান্নাকাটি করে।’
Advertisement
ওই কিশোরী যখন এসব কথা বলছিল তখন পুনর্বাসন কেন্দ্রের দায়িত্বরত এক নারী মিডিয়া থেকে আড়াল করতে উদ্ধার হওয়া অপর কিশোরীকে টেনে নিয়ে দ্রুত আদালতপাড়া ত্যাগের চেষ্টা করেন। এসময় গণমাধ্যমকর্মীরা কিশোরীকে কেন নিয়ে পালিয়ে যাচ্ছেন, এমন প্রশ্ন করলে পুনর্বাসন কেন্দ্রের দায়িত্বরত ওই নারী এ বিষয়ে তিনি কিছু বলতে পারবেন না বলে জানান। তাৎক্ষণিকভাবে বক্তব্য নিতে চাইলে ওই কিশোরী পুনর্বাসন কেন্দ্রে নির্যাতনের ভয়ে মুখ খোলেনি।
পরে সমন্বিত শিশু পুনর্বাসন কেন্দ্রে (বালিকা) সরেজমিনে দেখা যায়, পরিদর্শনের জন্য গণমাধ্যমকর্মী পরিচয় দিলেও কেন্দ্রটির গেট খুলতে বিলম্ব করেন দায়িত্বপ্রাপ্তরা। পরে গেট খুলে গণমাধ্যমকর্মীরা তাদের সঙ্গে কথা বলেন। কেন্দ্রের নিচতলায় নিবাসীদের সঙ্গে কথা বলার একপর্যায়ে এক নিবাসী জানায়, গত ১২ জুন চার কিশোরী এ কেন্দ্র থেকে পালিয়ে গেছে। পরে দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তাদের এ বিষয়ে জানতে চাইলে তারা স্বীকার করেন।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একাধিক কর্মকর্তা-কর্মচারী বলেন, কঠোর নিরাপত্তার মধ্যে নিবাসীদের রাখা সত্ত্বেও মাঝে মধ্যে এমন দু-একটা ঘটনা ঘটে যায়। তবে ভবিষ্যতে যেন এমনটি না হয় সেদিকে বিশেষ নজর রয়েছে। এটি পুনর্বাসন কেন্দ্র, শিশু-কিশোরী সংশোধনাগার না। যে কারণে অনেক সময় দুর্ঘটনা ঘটে যায়।
তারা আরও জানান, চলতি বছরে পুনর্বাসন কেন্দ্রে চার শিশু মারা গেলে একজনের মরদেহ ময়নাতদন্ত করা হয়। বাকিদের ময়নাতদন্ত ছাড়াই দাফন করা হয়।
এ বিষয়ে রংপুর জেলা সমাজসেবা অধিদপ্তরের উপপরিচালক অনিল চন্দ্র বর্ম্মনের সাক্ষাৎকার নিতে তার কার্যালয়ে গেলে তিনি বলেন, ‘এ বিষয়ে আমি কোনো কথা বলতে চাই না। আমি বলছি না, আপনার ক্যামেরা বন্ধ করেন। আমি কিছু বলতে পারবো না।’ মানবাধিকারকর্মী ও আইনজীবী এএএম মুনীর চৌধুরী বলেন, সমাজসেবা কর্মকর্তা গণমাধ্যমের সামনে কথা না বললে তার বিরুদ্ধে অভিযোগের প্রাথমিক সত্যতা রয়েছে বলে প্রমাণিত হয়। কারণ তার সৎ সাহস নেই অভিযোগের বিষয়টি প্রকাশ করা। তাই অভিযুক্ত ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে দ্রুত তদন্তসহ আইনগত ব্যবস্থা নিতে সংশ্লিষ্টদের দৃষ্টি আকর্ষণ করছি।
জিতু কবীর/এসআর/এমএস