সিঙ্গাপুরের বিপক্ষে বাংলাদেশের ম্যাচ হয়েছে ১০ জুন। এক সপ্তাহ আগে হওয়া এই ম্যাচটি এখনো দেশের ফুটবল অঙ্গনে আলোচনার তুঙ্গে। ফুটবলারদের পারফম্যান্স আর কোচের কৌশল নিয়ে চলছে কাটাছেঁড়া।
Advertisement
সাবেক-বর্তমান ফুটবলার, স্থানীয় কোচরা ম্যাচটিকে আতশি কাচের নিচে রেখে জিততে না পারার কারণগুলো বের করার চেষ্টা করছে। সেই সাথে আলোচনায় আছে অনেকদিন পর ফুটবল ঘিরে আলোচনা, উত্তেজনা আর উন্মাদনার বিষয়টি। ফুটবলের এই যে ক্রেজ, সেটা থাকবে? নাকি আবার হারিয়ে যাবে? এই যে উৎসবমুখর পরিবেশ তৈরি হয়েছিল একটি ম্যাচ ঘিরে, তা ধরে রাখতেইবা কী করতে হবে? আলোচনার মূল বিষয় এগুলোই।
‘বাংলার ম্যারাডোনা’খ্যাত রুম্মান বিন ওয়ালি সাব্বির অনেকদিন পর ফুটবল ঘিরে ব্যাপক আলোচনা ও উন্মাদনা দেখে বেজায় খুশি। সাব্বিররা ফুটবল খেলেছেন ভরা গ্যালারির সামনে। এখন দর্শকদের সেই ঢেউ দেখা যায় না ফুটবলে। লম্বা একটা সময় পর ফুটবল নিয়ে এমন মাতামাতি, সেটা সাব্বিরদের চেয়ে কাদেরইবা বেশি আনন্দ দেবে!
সিঙ্গাপুরের বিপক্ষে ম্যাচটি সাব্বির স্টেডিয়ামে বসেই দেখেছেন। তবে ম্যাচ দেখতে গিয়ে বিড়ম্বনার শিকার হয়েছিলেন এই ফুটবল সুপারস্টার। সাবেক ফুটবলারদের টিকিট দেওয়া হয়েছিল প্রেসবক্সের সামনের গ্যালারিতে। সেখানেই সাধারণ কয়েকজন দর্শক খারাপ আচরণ করেছেন সাব্বিরসহ সাবেক কয়েকজন ফুটবলারের সাথে। ফুটবলার ও সাধারণ দর্শকের মধ্যে ধাক্কাধাক্কির মতো ঘটনাও ঘটেছিল সেদিন। যার একটি ভিডিও ক্লিপ ভাইরাল হয়েছে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে।
Advertisement
কী ঘটেছিল সেদিন? জানতে চাইলে সাব্বির ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, ‘বাফুফে সাবেক ফুটবলারদের কোনো মূল্যই দেয়নি। আমাদের যেখানের টিকিট দিয়েছিল, সেখানে শুধু ফুটবলার থাকলে কথা ছিল না। সেখানে সাধারণ দর্শক ঢুকিয়েই ঝামেলা পাকিয়েছে বাফুফে। প্রেসবক্সের ওপরে যে জায়গাটা ছিল, ওখানে আমাদের জায়গা দিলে এমন অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা ঘটতো না। আমাদের যদি টিকিট কিনে নিতে বলতো, আমরা কিনেই নিতাম। অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা ঘটেছে কয়েকজন দর্শকের কারণে। হঠাৎ কয়েকজন দর্শক এসে সাবেক ফুটবলার ব্রাদার্সের নান্নুকে বলেন সিট ছাড়তে। তারা নান্নুকে ধমক ও ধাক্কা দিয়ে ছিট ছাড়তে বলে। একজন সাবেক খেলোয়াড়কে এমন অপমান আমি নিতে পারিনি। তাই আমি দর্শককে বলি-আপনি যাকে ধাক্কা দিলেন তিনি কে জানেন? আপনাদের সাহস হলো কী করে? আমিও তাকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দিই।’
সাব্বির বাফুফের সার্বিক কাজকর্মে চরমভাবে অসন্তুষ্ট। বলছিলেন, ‘দেখুন শুধু মুখে বড় বড় কথা। ৮ মাস হয়ে গেলো বাফুফের কোনো পরিকল্পনা নেই। আমরা মনপ্রাণ দিয়ে কামনা করি ফুটবল এগিয়ে যাক। তবে তার জন্য দরকার সঠিক পরিকল্পনা। পরিকল্পনার মাধ্যমেই ফুটবল উন্নয়ন করতে হবে, স্ট্যান্ডবাজি দিয়ে নয়। আপনি হামজাকে এনেছেন। দেশের খেলোয়াড় কোথায়? শুধু হামজাকে দিয়ে হাইপ তুলে লাভ নেই। আপনাকে ডেভেলপমেন্ট করতে হবে। হামজার মতো আরও পাঁচজন ফুটবলার লাগবে দলে। তাছাড়া হামজা তো ডিফেন্ডার। এই দলের নাম্বার নাইন, নাম্বার টেন কোথায়। গোল কে করবেন? হামজা তো গোল করে দেবেন না। সেটপিস থেকে হয়তো গোলের সুযোগ কাজে লাগাতে পারবেন। আপনাকে তো গোল দেওয়ার প্রকৃত লোক লাগবে। সিঙ্গাপুরের বিপক্ষে ম্যাচে বাংলাদেশের জেতা উচিত ছিল। সিঙ্গাপুর তেমন কোনো দলই না।’
কেবল প্রবাসীদের ওপর নির্ভরশীল না হয়ে স্থানীয় মানসম্মত খেলোয়াড় বাড়ানোর ওপর জোর দেন সাব্বির। তিনি বলেন, ‘এখন তো একটা জাতীয় দল করলেই খেলোয়াড় পাওয়া যায় না। এভাবে চলবে না। তিনটি জাতীয় দল করা যায় এমন ৬০ থেকে ৭০ জন মানসম্মত খেলোয়াড় রাখতে হবে। একটি ম্যাচ ঘিরে যে আলোড়ন হলো, সেটা ধরে রাখতে ব্যাপক উদ্যোগ নিতে হবে। হাত-পা ছেড়ে বসে থাকলে হবে না।’
খেলোয়াড় হিসেবে ফুটবলের রমরমা অবস্থা দেখেছেন। এখন সংগঠক হিসেবে দেখছেন। কী করলে ফুটবলের মান ও জাঁকজমক দুটোই বাড়বে? সাব্বিরের কথা, ‘ফুটবলের জাঁকজমক ধরে রাখতে হলে কয়েকটি কাজ করতেই হবে। ঘরোয়া ফুটবল ঢাকা জাতীয় স্টেডিয়ামেও রাখতে হবে। লিগকে গুরুত্ব দিতে হবে। বাফুফেতে যারা আছেন তাদের বেশিরভাগই জানেন না, একটা ক্লাবের এক মৌসুমে কত টাকার বাজেট থাকে। মোহামেডান ও আবাহনী এই দুই ক্লাবের ইতিবাচক ভূমিকা পালন করতে হবে। ভালো দল গঠন করতে হবে দেশের জনপ্রিয় এই দুই ক্লাবকে। আর বাফুফেকে জাতীয় দলে বেশি নজর দিতে হবে। আরও ভালো মানের কোচ আনতে হবে।’
Advertisement
বলছিলেন ভালো কোচ আনতে হবে। তো এই কোচ দিয়ে কি তাহলে আর হবে না? ‘এই কোচকে তো দেখা হলো লম্বা একটা সময়। তাকে দিয়ে আসলেই হবে না। এতদিনেও তিনি একটা স্কোয়াড তৈরি করতে পারলেন না, একাদশ তৈরি করতে পারলেন না। ভারতের বিপক্ষে ম্যাচের আগে থেকেই ক্যাবরেরাকে বিদায়ের দাবি উঠেছে। এখনো আছে। কোচ পরিবর্তনের প্রয়োজন আছে। বাংলাদেশ ফুটবল দলের বর্তমানে যে মান, তাতে এই কোচ পরিবর্তন দরকার। সিঙ্গাপুরের বিপক্ষে বাংলাদেশ ম্যাচটি হেরেছে কোচের ভুল কৌশলে’-বলেন বাংলার ম্যারাডোনা।
কোচের কি ভুল আপনার চোখে পড়েছে? সাব্বির বলেন, ‘ফাহামিদুলকে কেন শুরু থেকে খেলালেন, বুঝলাম না। রাকিবকেই বা কেন তার পজিশনে খেলালেন না? তাকে রাখা হলো সেন্টার ফরোয়ার্ডে। কিন্তু রাকিব তো বারবার ডান দিক দিয়ে ওপরে ওঠার চেষ্টা করলেন। তাহলো গোল কে করবেন? আবার অবাক করার বিষয় হলো, যখন আপনার গোল দরকার তখন গোলদাতা রাকিবকে নামিয়ে নেওয়া হলো রাইট ব্যাকে। এর কোনো ব্যাখ্যা আছে কোচের কাছে?’
সাব্বির যোগ করেন, ‘খেলোয়াড় পরিবর্তন নিয়ে যে অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা ঘটলো, সময় নষ্ট হলো, তাতে খেলার ছন্দপতনও হয়েছে। ওই সময় বাংলাদেশের খেলায় একটা গতি ছিল, সেটা নষ্ট হয়েছে। এখানে টিম ম্যানেজমেন্ট অদক্ষতার পরিচয় দিয়েছে। খেলোয়াড় বদলের কাজটি কোচের নির্দেশনায় করেন ম্যানেজার। কোচ যেভাবে বলেন, সেভাবে ম্যানেজার চতুর্থ রেফারিকে বলেন। দেখুন মোরসালিন মাঠে নেমে গেছেন তখনো বদলি খেলোয়াড়ের নাম্বার দেখানো হয়নি। তখন কিন্তু হামজা সেখানে এসে দ্রুত বদলের ঝামেলা অবসানের তাগাদা দেন। এ সময় তাকে বিরক্তও মনে হয়েছে। এমন ঘটনা কাম্য ছিল না।’
টিম ম্যানেজমেন্টের আরও দুর্বলতাও চোখে পড়েছে সাব্বিরের। সিঙ্গাপুর ম্যাচের আগে টিম হোটেলে দুই তারকা ফুটবলার হামজা ও শামিতকে নিয়ে ইন্টারভিউ ও ছবি তোলা নিয়ে যে হেনস্তা করা হয়েছে, তা ভালোভাবে নিচ্ছেন না এই তারকা ফুটবলার। তার কথা, ‘বাফুফের এসব বন্ধ করা উচিত। তারকা ফুটবলারদের আরও বিশ্রামে থাকার ব্যবস্থা করা উচিত ছিল। ফুটবল ম্যাচের আগে মানসিক প্রস্তুতিরও একটা বিষয় থাকে। হামজাদের বিরক্ত করে মনোসংযোগ নষ্ট করা হয়েছে। ফেডারেশন ও টিম ম্যানেজমেন্টের চরম ব্যর্থতায় এসব ঘটেছে।’
আরআই/এমএমআর/এএসএম