বরগুনায় ডেঙ্গু পরিস্থিতি ক্রমেই ভয়াবহ হয়ে উঠছে। রোগীর সংখ্যা বাড়ছে প্রতিদিন, বাড়ছে মৃত্যুও। গত ২৪ ঘণ্টায় জেলায় নতুন করে ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে বিভিন্ন হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন ৬৭ জন। এছাড়া গত ১২ দিনে হাসপাতালে ভর্তি আছেন ১৯৩ জন। এ বছর শুধু সদর হাসপাতালে ৫ জনের মৃত্যু হয়েছে। এ নিয়ে চলতি বছর বরগুনায় ডেঙ্গুতে মৃত্যুর সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১৩ জনে।
Advertisement
এদিকে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত রোগিদের চিকিৎসায় চরম অব্যবস্থাপনা দেখা দিয়েছে বরগুনা জেনারেল হাসপাতালে। হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ বলছে, ডেঙ্গু মহামারি রূপ নিচ্ছে। পরিস্থিতি সম্পূর্ণ বিপর্যয়ের মুখে। ডেঙ্গুর প্রকোপ হাসপাতালে বিদ্যমান সক্ষমতাকেও ছাড়িয়ে গেছে।
সিভিল সার্জন কার্যালয়ের তথ্য মতে, বরগুনা জেনারেল হাসপাতালসহ জেলার বিভিন্ন হাসপাতালে এখন পর্যন্ত ভর্তি রয়েছেন ১৯৩ জন রোগী। আর জানুয়ারি থেকে ১৩ জুন পর্যন্ত বরগুনায় মোট ডেঙ্গু আক্রান্তের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে এক হাজার ৬৩১ জন। মৃত্যু হয়েছে ৫ জনের। সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরেছেন এক হাজার ৪৩৮ জন। তবে বাসা-বাড়িতে ও জেলার বাইরে চিকিৎসা নিতে গিয়ে মৃত্যুর সংখ্যা অন্তত ১৩ জন।
অন্যদিকে একই সময়ে বরিশাল বিভাগে আক্রান্তের সংখ্যা দুই হাজার ২৭৫ জন। সে অনুযায়ী বিভাগের মধ্যে শুধু বরগুনা জেলায় আক্রান্ত হয়েছে ৬১ দশমিক ৮০ ভাগ।
Advertisement
হাসপাতালের তথ্য অনুযায়ী, ৫৫ জন চিকিৎসকের পদ থাকলেও বর্তমানে কর্মরত আছেন ১৯ জন। অপরদিকে দেড় শতাধিক নার্স থাকার কথা থাকলেও কর্মরত নার্সের সংখ্যা মাত্র ৬৬ জন। ফলে হঠাৎ ডেঙ্গু রোগীদের জন্য নির্ধারিত ৫৫টি বেডের বিপরীতে প্রতিদিন প্রায় ১৫০-২০০ জন ডেঙ্গু রোগী ভর্তি হচ্ছেন হাসপাতালে। এছাড়াও ২৫০ শয্যা বিশিষ্ট হাসপাতালটিতে বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত মিলিয়ে বর্তমানে প্রতিদিন প্রায় ৫ শতাধিক রোগী ভর্তি থাকেন। আউটডোরেও প্রায় প্রতিদিন ৫ শতাধিক রোগীকে চিকিৎসা দিতে হচ্ছে চিকিৎসকদের। ফলে চিকিৎসক ও নার্স সংকটে হাসপাতালে আসা ভর্তি রোগীদের চিকিৎসা সেবা দিতে হিমশিম খাচ্ছেন দায়িত্বরত চিকিৎসক ও নার্সরা।
এদিকে বৃহস্পতিবারের (১২ জুন) এলাকা ভিত্তিক একটি পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, বরগুনা জেনারেল হাসপাতালে জেলায় প্রায় ১৬০০ ডেঙ্গু আক্রান্তের মধ্যে ৪১৪ জনই সদর উপজেলার গৌরীচন্না ইউনিয়নের। যার মধ্যে ইউনিয়নের লাকুরতলা গ্রামেই ১৩৬ জন।
এলাকাবাসী জানায়, শহরের খুব কাছাকাছি হলেও ইউনিয়নের আওতায় থাকায় পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার দায়িত্বে কেউ নেই। ফলে ঝোপঝাড়, আবর্জনা ও জমে থাকা পানিতে ডেঙ্গুর ভয়াবহ বিস্তার ঘটছে।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, গত বৃহস্পতিবার সকালে বরগুনা শহরের কলেজ ব্রাঞ্চ রোড এলাকা থেকে ঢাকায় নেওয়ার পথে মারা যান ডেঙ্গু আক্রান্ত পাপড়ি বেগম (৬৫)। তিনি বরগুনা জেনারেল হাসপাতালে কয়েকদিন চিকিৎসা নেওয়ার পর অবস্থার অবনতি হলে তাকে ঢাকায় নেওয়া হচ্ছিলো। এর আগে বরগুনার খামারবাড়ি এলাকার স্কুলছাত্র ৯ বছরের ওমর আল আরাবিকে ঢাকায় একটি বেসরকারি হাসপাতালের আইসিইউতে নেওয়া হয়। সে এখন মৃত্যুর সঙ্গে লড়ছে। একইভাবে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যু হয়েছে আজমেরী মোনালিসা জেরিন (২৭) নামের এক নারী উদ্যোক্তার।
Advertisement
ডেঙ্গু আক্রান্ত দেড় বছরের শিশু আবদুল্লাহ নামের এক শিশুর মা শিল্পী বেগম জাগো নিউজকে বলেন, আমি ও আমার ছেলে দুজনই ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে বরগুনা সদর হাসপাতালে ভর্তি হয়েছি। হাসপাতালে রক্ত পরীক্ষা ও ওষুধ কিছুই পাইনি, সবকিছু বাইরে থেকে কিনতে হচ্ছে। আমার স্বামী রিকশা চালায়, এত খরচ কীভাবে চালাবো?
অন্য দিকে ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে জেনারেল হাসপাতালে ভর্তি হওয়া মিজান রানা নামে এক রোগী অভিযোগ করে বলেন, চারদিন পর্যন্ত ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি আছি কিন্তু হাসপাতালে একটি নরমাল স্যালাইনও স্টকে নাই। এমনকি বাজারের কোনো ফার্মেসিতেও কিনতে পাওয়া যাচ্ছে না। এছাড়াও ডাক্তারও ঠিকমতো পাওয়া যায় না।
ডেঙ্গু আক্রান্তের তালিকায় এগিয়ে থাকা গৌরিচন্না এলাকার বাসিন্দা আব্দুল আলিম জাগো নিউজকে বলেন, আমাদের এ এলাকাটি বরগুনা পৌরসভার একদম কাছাকাছি হওয়ায় ঘনবসতি হলেও এই ইউনিয়নের কোনো পরিচ্ছন্নতা কর্মী নেই। এছাড়াও প্রয়োজনীয় ড্রেনেজ ব্যবস্থা না থাকায় বৃষ্টি হলেই এলাকার বিভিন্ন জায়গার ডোবা, নালা ও নিচু জমিতে পানি জমে থাকে। আমার পরিবারে আমিসহ ৫ জন ডেঙ্গু আক্রান্ত হই। সবশেষ আমি ঢাকা পর্যন্ত চিকিৎসা নিয়ে সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরি।
বরগুনা জেনারেল হাসপাতালের সিনিয়র স্টাফ নার্স ইশরাত জাহান বলেন, বর্তমানে আমাদের জনবল অনেক কম। প্রতিদিন যে হারে আক্রান্ত রোগী ভর্তি হচ্ছে তা সামাল দেওয়া আমাদের পক্ষে খুবই কঠিন হয়ে পড়েছে। আমরা এবার কোরবানির ঈদেও ছুটি পাইনি। পরিবার রেখে রোগীদের সেবায় নিয়োজিত রয়েছি। একজন রোগীর কাছে গিয়ে আরেক জনের কাছে যেতে দেরি হলে অনেক সময় শুনতে হয় নার্সদের ব্যবহার ভালো না। বরগুনায় ২৫০ শয্যা বিশিষ্ট হাসপাতাল হলেও ১০০ শয্যার নার্স দিয়ে চলছে হাসপাতালের কার্যক্রম। এতে প্রায় প্রতিদিন পাঁচ শতাধিক ভর্তি রোগীদের সামাল দিতে হিমশিম খেতে হয় আমাদের।
সচেতন নাগরিক কমিটির বরগুনা শাখার সভাপতি কামাল হোসেন জাগো নিউজকে বলেন, বৃষ্টির পর শহরের অর্ধেক রাস্তাই পানিতে তলিয়ে যায়। জলাবদ্ধ পানি আর অপরিকল্পিত ড্রেন শহরকে মৃত্যু ফাঁদে পরিণত করেছে। এ বিষয়ে দ্রুত পদক্ষেপ নেওয়া জরুরি।
বর্তমানে ডেঙ্গু পরিস্থিতির বিষয়ে বরগুনা জেনারেল হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়ক ডা. মো. রেজওয়ানুর আলম জাগো নিউজকে বলেন, বরগুনাতে ডেঙ্গুর পিক সিজন চলছে। ৫৫ বেডের অনুকূলে ভর্তির রোগীর সংখ্যা অনেক বেশি। সেক্ষেত্রে আমাদের চিকিৎসকসহ নার্স সংখ্যাও কম। হাসপাতালে রোগীদের চিকিৎসা দিতে হিমশিম খেতে হচ্ছে। আমার মনে হচ্ছে, প্রতি ঘরেই ডেঙ্গু রোগী আছে। দিন দিন এটি মহামারি আকার ধারণ করতে শুরু করেছে। আমরা বর্তমানে মহা বিপর্যয়ের সম্মুখীন, চিকিৎসা সেবা আমাদের সক্ষমতার বাইরে চলে গেছে।
ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগী বেড়ে যাওয়ার বিষয়ে জানতে চাইলে বরগুনার সিভিল সার্জন মোহাম্মদ আবুল ফাত্তাহ্ জাগো নিউজকে বলেন, হঠাৎ করে কেন বরগুনায় এত ডেঙ্গু আক্রান্ত, এ ব্যাপারে সুনির্দিষ্টভাবে বলা কঠিন। তবে সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগনিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউট (আইইডিসিআর) ডেঙ্গু বা এ ধরনের রোগের গবেষণামূলক কাজ করে। তারা হয়ত এ বিষয়ে সুনির্দিষ্ট কিছু বলতে পারবেন। শহরে পর্যাপ্ত পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা না থাকা, রোগীদের অসচেতনতা ও চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী না চলার কারণেও অনেকটা রোগীর সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে।
তার দাবি, হাসপাতালে ভর্তি হওয়া রোগীদের মশারি ব্যবহার করতে বললেও তারা গুরুত্ব দেন না। ফলে একজনের থেকে অন্য জনের রোগের সৃষ্টি হয়। তাছাড়া বরগুনা ডায়রিয়া প্রবণ এলাকা হওয়ায় প্রচুর ডাবের খোসা যত্রতত্র ফেলে রাখা হয়। যে কারণে বর্ষার মৌসুমে পানি জমে এডিস মশার জন্ম বৃদ্ধি পায়।
এ বিষয়ে বরগুনা জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ শফিউল আলম বলেন, গত দুই মাস ধরে বরগুনায় ডেঙ্গু রোগে আক্রান্তের সংখ্যা বাড়ছে। বেশ কয়েকজনের মৃত্যুর ঘটনাও ঘটেছে। এরই প্রেক্ষিতে আমরা কয়েকটি সভা করেছি। মশক নিধনে প্রয়োজনীয় কার্যক্রম পৌরসভা কর্তৃপক্ষ অব্যাহত রেখেছে। হাসপাতালের সঙ্গে আমাদের সার্বক্ষণিক যোগাযোগ রয়েছে। বিশেষ করে হাসপাতালে চিকিৎসক এবং নার্স সংকটের বিষয়টি ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে অবহিত করা হয়েছে। আশা করি খুব দ্রুত সময়ের মধ্যে ডেঙ্গু পরিস্থিতি বিবেচনায় তারা প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করবেন।
নুরুল আহাদ অনিক/এমএন/এএসএম