প্রবাস

জার্মানি-জাপান-কোরিয়া: বাংলাদেশের উন্নয়নে অংশীদার হওয়ার সম্ভাবনা

জার্মানি-জাপান-কোরিয়া: বাংলাদেশের উন্নয়নে অংশীদার হওয়ার সম্ভাবনা

বাংলাদেশের অর্থনীতি এখন এক সংবেদনশীল মোড় পার করছে। এলডিসি থেকে উত্তরণের প্রস্তুতি, চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের অভিঘাত, বিশ্ব রাজনীতির দ্বিধাবিভক্ত বাস্তবতা এবং জলবায়ু পরিবর্তনের চাপ—সব মিলিয়ে উন্নয়ন কৌশলে নতুন মাত্রা দরকার।

Advertisement

এই মুহূর্তে সবচেয়ে বড় প্রশ্ন: কোনো দেশের সঙ্গে কৌশলগত এবং অর্থনৈতিক অংশীদারত্ব আরও গভীর করা উচিত?অনেক বিশ্লেষক মনে করেন, জার্মানি, জাপান ও দক্ষিণ কোরিয়ার সঙ্গে সম্পর্ক সম্প্রসারণ এই প্রশ্নের একটি যথার্থ উত্তর হতে পারে। তিনটি দেশই উন্নত প্রযুক্তি, অর্থনৈতিক সক্ষমতা এবং নৈতিক ও কৌশলগত ভারসাম্যের ব্যতিক্রমী এক মিশ্রণ উপস্থাপন করে, যা বাংলাদেশের জন্য লাভজনক হতে পারে দীর্ঘমেয়াদে।

প্রেক্ষাপট: বিশ্ব রাজনীতির দ্বান্দ্বিক বাস্তবতা

বর্তমান বিশ্বের ভূ-রাজনৈতিক বাস্তবতা ক্রমশ জটিল হয়ে উঠছে। যুক্তরাষ্ট্র-চীন প্রতিযোগিতা শুধু সামরিক বা কূটনৈতিক নয়, প্রযুক্তি, সরবরাহ চেইন ও বাজারে আধিপত্য নিয়েও চলছে। এই প্রতিযোগিতার মাঝে দাঁড়িয়ে বাংলাদেশের মতো উদীয়মান অর্থনীতি সম্পূর্ণ নিরপেক্ষ থাকা কঠিন হলেও, ভারসাম্য রক্ষা করাটা এখন কৌশলগত বাধ্যবাধকতা।

এমন বাস্তবতায় উন্নয়ন অংশীদার নির্বাচনে শুধু অর্থনৈতিক প্রণোদনা নয়, রাজনৈতিক নিরপেক্ষতাও গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। এই দৃষ্টিকোণ থেকেই জার্মানি, জাপান ও দক্ষিণ কোরিয়ার প্রাসঙ্গিকতা বাড়ছে।

Advertisement

অর্থনৈতিক ও প্রযুক্তিগত প্রাসঙ্গিকতা

জাপান: দীর্ঘমেয়াদি কৌশলগত বিনিয়োগকারী

জাপান বাংলাদেশের অন্যতম প্রধান উন্নয়ন সহযোগী। মেট্রোরেল, মাতারবাড়ি গভীর সমুদ্রবন্দর, ঢাকা-ইস্টার্ন বাইপাসসহ বেশ কয়েকটি অবকাঠামোগত প্রকল্পে জাপানি বিনিয়োগ ও কারিগরি সহায়তা রয়েছে। জাপান আন্তর্জাতিক সহযোগিতা সংস্থা (জাইকা) গত এক দশকে প্রায় ২ বিলিয়ন ডলারের বেশি অনুদান ও সহজ ঋণ দিয়েছে।

এছাড়া, জাপান বাংলাদেশে ‘জাপান ইন্ডাস্ট্রিয়াল টাউনশিপ’ গঠনের পরিকল্পনা করছে, যেখানে উন্নত প্রযুক্তির শিল্পপ্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা হবে। জাপানি কোম্পানিগুলোর জন্য বাংলাদেশের বাজার শুধু উৎপাদনের খরচ কমানোর জায়গা নয় বরং দক্ষিণ এশিয়ার প্রবেশদ্বার হিসেবেও ব্যবহৃত হচ্ছে।

জার্মানি: বাংলাদেশে টেকসই বাণিজ্যের অন্যতম গন্তব্য

Advertisement

জার্মানি ইউরোপীয় ইউনিয়নের (ইউ) সবচেয়ে বড় অর্থনীতি এবং বাংলাদেশের পণ্য রপ্তানির অন্যতম প্রধান বাজার। বিশেষত তৈরি পোশাক খাতের জন্য জার্মানি একা ১৫ শতাংশের বেশি রপ্তানি আয়ের উৎস। কিন্তু এই সম্পর্কের পরিধি এখনো পণ্যভিত্তিক; বহুমাত্রিক অর্থনৈতিক সহযোগিতা এখনো সীমিত।

জার্মান প্রতিষ্ঠানগুলো সবুজ প্রযুক্তি, নবায়নযোগ্য জ্বালানি, স্মার্ট শহর এবং শিল্প ৪.০-এর ক্ষেত্রে অগ্রগামী। বাংলাদেশে এদের উপস্থিতি বাড়লে জলবায়ু সহনশীল অবকাঠামো ও শিল্পায়নে ব্যাপক গতি আসতে পারে।

দক্ষিণ কোরিয়া: প্রযুক্তির মাধ্যমে অংশীদারত্ব

স্যামসাং, এলজি, হুন্দাই—এই ব্র্যান্ডগুলো শুধু পরিচিত নাম নয় বরং দক্ষিণ কোরিয়ার প্রযুক্তিনির্ভর শিল্পের প্রতীক। এরই মধ্যে দক্ষিণ কোরিয়ার কিছু প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশে মোবাইল ফোন অ্যাসেম্বলি ও ইলেকট্রনিকস উৎপাদনে বিনিয়োগ করেছে। কোরিয়ানের টেক্সটাইল ও গার্মেন্টস খাতেও বিনিয়োগ উল্লেখযোগ্য।

এই সম্পর্ককে এখন গভীর করতে হবে প্রযুক্তি হস্তান্তরের মাধ্যমে। উদাহরণস্বরূপ, দক্ষ মানবসম্পদ উন্নয়ন, ডিজিটাল স্বাস্থ্যসেবা, স্মার্ট ম্যানুফ্যাকচারিং এবং অ্যাডভান্সড রোবোটিক্স খাতে যৌথ উদ্যোগ গড়ে তোলা যেতে পারে।

বাণিজ্য ও বিনিয়োগের সম্ভাবনা

বাংলাদেশ ২০২৬ সালের পর এলডিসি থেকে উত্তরণ ঘটাবে। তখন বর্তমান প্রাধান্যপ্রাপ্ত বাণিজ্য সুবিধাগুলো (যেমন জিএসপি বা ডিউটি ফ্রি এক্সেস) বন্ধ হয়ে যাবে। এ ধরনের বাস্তবতায় নতুন বাজার খোঁজা ও পুরোনো অংশীদারদের সঙ্গে সম্পর্ক আরও গভীর করার গুরুত্ব আরও বেড়েছে।

জাপান ও দক্ষিণ কোরিয়া ফ্রি ট্রেড অ্যাগ্রিমেন্ট (এফটিএ) বা ইকোনমিক পার্টনারশিপ অ্যাগ্রিমেন্ট (ইপিএ)-এর জন্য আগ্রহ দেখিয়েছে। বাংলাদেশ যদি সময়োপযোগীভাবে (এফটিএ) করতে পারে, তবে রপ্তানিতে প্রতিযোগিতা বজায় রাখা সহজ হবে।একইসঙ্গে জার্মানি ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের সঙ্গে জিএসপি প্লাসের জন্য প্রস্তুতি নিতে হবে, যার জন্য শ্রম অধিকার, পরিবেশ সুরক্ষা ও গণতান্ত্রিক স্বচ্ছতা নিশ্চিত করাও দরকার।

প্রযুক্তি হস্তান্তর ও শিল্পায়ন: এক নতুন দিগন্ত

তিনটি দেশেরই একটি অভিন্ন বৈশিষ্ট্য হচ্ছে: তারা ‘সোফিস্টিকেটেড ম্যানুফ্যাকচারিং’ এবং ‘উচ্চমূল্য সংযোজনযুক্ত’ প্রযুক্তিপণ্য উৎপাদনে অগ্রগামী। বাংলাদেশের জন্য এই দেশগুলোর প্রযুক্তি ও জ্ঞান হস্তান্তর উন্নয়নের গতি বহুগুণ বাড়াতে পারে।

বিশেষত, নিম্নলিখিত খাতগুলোতে তিন দেশ থেকে জ্ঞান ও প্রযুক্তি আনা যেতে পারে:

নবায়নযোগ্য জ্বালানি

স্মার্ট ম্যানুফ্যাকচারিং

ডিজিটাল হেলথটেক ও টেলিমেডিসিন

আর্টিফিশিয়াল ইনটেলিজেন্স ও ডেটা অ্যানালাইটিক্স

গ্রিন কনস্ট্রাকশন ও আরবান প্ল্যানিং

মানবসম্পদ উন্নয়ন ও দক্ষতা রপ্তানির সম্ভাবনা

জার্মানি, জাপান ও দক্ষিণ কোরিয়া—তিন দেশেই জনসংখ্যা সংকট প্রকট আকার ধারণ করছে। উচ্চ বয়সভিত্তিক সমাজ কাঠামো, কম জন্মহার এবং দক্ষ জনশক্তির ঘাটতি পূরণে তারা বিদেশি কর্মীদের দিকে ঝুঁকছে। বাংলাদেশের বিশাল যুবসমাজ যদি দক্ষতা ও ভাষাগত প্রস্তুতি অর্জন করতে পারে, তাহলে এই চাহিদার একটি বড় অংশ পূরণ সম্ভব। এই লক্ষ্যে নিচের উদ্যোগগুলো নেওয়া যেতে পারে:

জাপানি, জার্মানি ও কোরিয়ান ভাষা শিক্ষা কেন্দ্র বিস্তার করা

টেকনিক্যাল ট্রেনিং ইনস্টিটিটিউট আধুনিকায়ন

কো-অপারেটিভ স্কিমের আওতায় বিনিময় কর্মসূচি চালু করা

বদলি কর্মসংস্থানের মাধ্যমে অভিজ্ঞতা সংগ্রহের সুযোগ

এভাবে বিদেশি মুদ্রা রেমিট্যান্স ছাড়াও প্রযুক্তি ও ব্যবস্থাপনা জ্ঞান দেশে ফিরে আসবে।

কৌশলগত ভারসাম্য: এক অনিবার্য দিক

বাংলাদেশ এখনো পর্যন্ত ‘ফ্রি অ্যান্ড ওপেন ইন্ডো-প্যাসিফিক’ (এওআইপি) বা ‘বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ’ (বিআরআই)—এই দুই ব্লকের মাঝে ভারসাম্য রক্ষা করছে। এই ভারসাম্য রক্ষা করতে গিয়ে উন্নয়ন অংশীদারদের রাজনৈতিক শর্ত আরোপ না করাই বড় প্রাধান্য পায়।

জাপান ও দক্ষিণ কোরিয়া এফওআইপির পক্ষে হলেও তাদের কূটনীতি তুলনামূলকভাবে নমনীয় ও নন-কনফ্রন্টেশনাল। জার্মানি ইউরোপীয় ইউনিয়নের একটি ভারসাম্যদায়ী শক্তি, যারা কৌশলগত স্থিতিশীলতা ও মানবাধিকারকেন্দ্রিক উন্নয়নের পক্ষে।

তাই বাংলাদেশের মতো উদীয়মান কিন্তু মাঝারি ক্ষমতার রাষ্ট্রের জন্য এ ধরনের অংশীদারত্ব দীর্ঘমেয়াদে নিরাপদ ও লাভজনক।

প্রতিবন্ধকতা ও করণীয়

কিছু প্রতিবন্ধকতাও বিদ্যমান:

অর্থনৈতিক কূটনীতির দুর্বলতা

নিয়মনীতি ও অবকাঠামোগত সীমাবদ্ধতা

দক্ষ মানবসম্পদের অভাব

ইনস্টিটিউশনাল সমন্বয়ের ঘাটতি

এই বাধাগুলো কাটাতে চাই:

একটি জাতীয় উন্নয়ন কৌশল যার কেন্দ্রে থাকবে ‘উন্নয়ন অংশীদার বিবেচনা’

বহুপাক্ষিক সম্পর্ক জোরদারে ‘ইকোনমিক ডিপ্লোমেসি সেল’

উন্নয়ন প্রকল্পে দেশভিত্তিক কারিগরি সমীক্ষা ও ট্র্যাকিং সিস্টেম

বিনিয়োগবান্ধব নীতিমালা ও ফাস্ট-ট্র্যাক কর্ম।

বাংলাদেশের জন্য এখনই সময়, যখন উন্নয়ন অংশীদারদের সঙ্গে সম্পর্ককে নতুন মাত্রায় উন্নীত করা প্রয়োজন। শুধু আর্থিক সহযোগিতা নয় বরং কৌশলগত ভারসাম্য, প্রযুক্তি হস্তান্তর ও দক্ষ মানবসম্পদ উন্নয়ন—সব মিলিয়ে সমন্বিত কৌশল দরকার। জার্মানি, জাপান ও দক্ষিণ কোরিয়ার সঙ্গে এ ধরনের অংশীদারত্ব গড়তে পারলে বাংলাদেশের প্রবৃদ্ধি শুধু টেকসইই হবে না, বরং বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে আত্মনির্ভর উন্নয়নের পথও তৈরি হবে।

লেখক: সাংবাদিক ও গবেষক, জার্মানি

এমআরএম/এমএস