মওলবি আশরাফ
Advertisement
হাজরে আসওয়াদ—পবিত্র কাবার গায়ে বসানো কালো একটি পাথর। কাবার অংশ হওয়া ছাড়াও এ পাথরের আলাদা মর্যাদা ও গুরুত্ব আছে। তাওয়াফের সময় হাজরে আসওয়াদের সামনে থেকে তাওয়াফ শুরু করা এবং হাজরে আসওয়াদে চুমু খাওয়া সুন্নত। নবিজি (সা.) কাবা তাওয়াফ শুরু করতেন হাজরে আসওয়াদের সামনে থেকে এবং প্রতি চক্করের শুরুতে হাজরে আসওয়াদে চুমু খেতেন বা সেদিকে ইশারা করতেন।
সহিহ বুখারিতে এসেছে—নবিজি (সা.) কাবা ঘরের চারপাশে উটের পিঠে তাওয়াফ করেছিলেন এবং যখনই তিনি হাজরে আসওয়াদ বরাবর পৌঁছতেন, তখন তার হাতে থাকা একটি লাঠি দিয়ে সেদিকে ইশারা করতেন এবং ‘আল্লাহু আকবার’ বলতেন। (সহিহ বুখারি)
হজরে আসওয়াদের আকৃতিহাজরে আসওয়াদের ওপরের অংশ কালো, কিন্তু এর ভেতরের অংশ সাদা। দৈর্ঘ্য আনুমানিক এক হাত। কারও কারও মতে, পাথরটি পনের টুকরো, যার মধ্যে সাত বা আট টুকরো বাইরে থেকে দেখা যায়। পাথরটির দিকে গভীরভাবে তাকালে বাদামি রঙ দেখা যায়, এটি মূলত এক ধরনের আঠা। কারণ বেশ কয়েকবার পাথরটি ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে গেছিল, তারপর আঠা দিয়ে জোড়া লাগানো হয়েছে।
Advertisement
হাদিসে এই পাথরকে ‘জান্নাতের অংশ’ বলা হয়েছে। নবিজি (সা.) বলেন, হাজরে আসওয়াদ জান্নাত থেকে নাজিল হয়, এবং এটি ছিল দুধের চেয়েও সাদা। এরপর আদমসন্তানের পাপই একে কালো বানিয়ে দিয়েছে। (সুনানে তিরমিজি: ৮৭৭)
আরেকটি হাদিসে এসেছে, এটি বরফের চেয়েও সাদা ছিল, কিন্তু মুশরিকদের গুনাহ একে কালো বানিয়ে ফেলেছে। (মুসনাদে আহমদ: ২৭৯৫)
অন্য একটি হাদিসে এসেছে, হাজরে আসওয়াদ ও মাকামে ইবরাহিম—দুটোই জান্নাতের ইয়াকুত পাথর। (সহিহুল জামে’: ১৬৩৩)
ইতিহাসে হাজরে আসওয়াদইসলামপূর্ব কোরাইশদের যুগে একটি দুর্ঘটনায় কাবা শরিফের গিলাফ যখন পুড়ে গিয়েছিল, তখন হাজরে আসওয়াদও পুড়ে যায় এবং আরও বেশি কালো হয়ে যায়।
Advertisement
নবিজির (সা.) নবুয়্যতপ্রাপ্তির আগে কুরাইশরা যখন কাবা পুনর্নির্মাণ করে, তখন কোন গোত্র কাবার দেয়ালে হজরে আসওয়াদ স্থাপনের সৌভাগ্য অর্জন করবে—এ নিয়ে তাদের মধ্যে ঝগড়া শুরু হয়। এক আশ্চর্য ঘটনার মধ্য দিয়ে যুবকবয়সী নবিজি (সা.) এই ঝগড়ার মীমাংসার জন্য দায়িত্বপ্রাপ্ত হন। তিনি তাদের বিরোধ মিটানোর জন্য একটি চাদরে পাথরটি রেখে প্রত্যেক গোত্রের প্রতিনিধিকে সেই চাদর ধরতে বলেন, এবং নিজ হাতে এটি স্থাপন করেন।
হজরত আবদুল্লাহ ইবনে যুবায়েরের (রা.) শাসনকালে উমাইয়ারা যখন মক্কা আক্রমণ করে, তখন কাবায় আগুন ধরে যায় এবং হাজরে আসওয়াদ ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে যায়। আব্দুল্লাহ ইবনে জুবায়ের (রা.) সেগুলো জোড়া লাগিয়ে রুপার ফ্রেমে বাঁধিয়ে পাথরটি আবার কাবার গায়ে স্থাপন করেন।
প্রাচ্যবিদদের সন্দেহপশ্চিমারা যখন ইসলাম নিয়ে গবেষণা শুরু করে, বিশেষ করে হাজরে আসওয়াদ সম্পর্কিত হাদিস খুঁজে পায়, তখন তারা একে বিজ্ঞান দিয়ে ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করে। তাদের ধারণা—এটা কোনো আসমানি নিদর্শন নয়, বরং আশপাশের আগ্নেয়গিরি থেকে আসা একখণ্ড ব্যাসল্ট পাথর (Basalt), যেটা বন্যা বা অন্য কোনোভাবে মক্কায় এসেছে।
শুধু প্রাচ্যবিদরা নন, মুসলমানদের মধ্যেও কেউ কেউ ছিলেন যারা হাজরে আসওয়াদ সম্পর্কে হাদিস মানেননি। যেমন বিখ্যাত মুতাজিলি ইমাম জাহিজ। তিনি হাজরে আসওয়াদ সম্পর্কিত হাদিসটিকে জাল হাদিস সাব্যস্ত করে বলেন, এই পাথরটি যদি সত্যিই গুনাহের কারণে কালো হয়ে গিয়ে থাকে, তাহলে মানুষ যখন ইসলামে দীক্ষিত হয়ে পাপমুক্ত হলো, পাথর তো আবার সাদা হয়ে যাওয়ার কথা, হলো না কেন?
বৈজ্ঞানিকরা যা বলেনবৈজ্ঞানিকদের মতে হাজরে আসওয়াদ একটি Tektite বা প্রাকৃতিক কাঁচ জাতীয় পদার্থ, যা সাধারণত নীলাভ-কালো, বাদামি বা ধূসর হয়।
এই পাথর তৈরি হয় নক্ষত্র পতনের ফলে। যখন কোনো বিশাল উল্কা বা নক্ষত্র বালুকাময় মরুভূমিতে পতিত হয়, তখন এর ফলে সৃষ্ট তাপ ও চাপের ফলে বালি গলে কাঁচের মতো বস্তুতে পরিণত হয়। একে বলে Natural Glass বা ‘প্রাকৃতিক কাঁচ’। অনেক সময় একে burnt sand বলেও ডাকা হয়।
আমাদের বিশ্বাসআমাদের বিশ্বাস অনুযায়ী হাজরে আসওয়াদ জান্নাতের একটি অলৌকিক পাথর। এই পাথর মানুষকে আল্লাহর দিকে ফিরিয়ে আনে। এটি মানুষের পাপ নিজের মধ্যে ধারণ করে এবং কেয়ামতের দিন আল্লাহর দরবারে সাক্ষ্য দেবে।
এর গঠন-উপাদান যা-ই হোক না কেন, এটি জান্নাতের পাথর হতে পারে। পৃথিবী ও সমগ্র বিশ্বজগতের সব কিছুই আল্লাহ তাআলার সৃষ্টি। এই দুনিয়ার কাঁচ, মাটি ও পাথর—সবকিছুই আল্লাহরই সৃষ্টি। জান্নাত-জাহান্নামও আল্লাহ তাআলার সৃষ্টি। তাই জান্নাতের কোনো পাথরের উপাদান এই দুনিয়ার বিশেষ কোনো রকম পাথরের উপাদানের মতো হলে এতে আশ্চর্যের কিছু নেই এবং আমরা গ্রহণযোগ্য সূত্রে বর্ণিত হাদিসের আলোকে যে বিশ্বাস লালন করি, তার সাথে উল্লিখিত বৈজ্ঞানিক তথ্য সাংঘর্ষিক নয়।
ওএফএফ/এমএস