চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডে বিভিন্ন শিক্ষা ও ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানসহ উপকূলীয় এলাকায় বহুতল ভবনের ছাদে বসানো হয়েছে ৪৯টি সৌরচালিত পানি বিশুদ্ধকরণ ব্যবস্থা বা সোলার পাওয়ার্ড ডিস্যালাইনেশন ইউনিট। তবে রক্ষণাবেক্ষণের অভাব ও যন্ত্রাংশ নষ্ট হওয়ার কারণে এরইমধ্যে ৩৫টিরও বেশি প্রকল্প বন্ধ হয়ে গেছে। যে কয়েকটি চালু আছে তাও বন্ধ হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা করছেন উপকারভোগীরা।
Advertisement
সরকারি নথিপত্র পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, প্রতিটি প্রকল্পে সরকারিভাবে ব্যয় হয়েছে চার লাখ ৮০ হাজার টাকা। সে হিসেবে পুরো প্রকল্পে খরচ হয়েছে ২৩ কোটি ৫ লাখ ২০ হাজার টাকা। প্রকল্প স্থাপনকারী ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান চলে যাওয়ার পর আর দেখা মিলেনি তাদের। রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে একের পর এক বন্ধ হয়ে যাচ্ছে প্রকল্পগুলো। মিলছে না সুফল।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, রক্ষণাবেক্ষণের প্রশিক্ষণ প্রাপ্ত ব্যক্তিদের মধ্যে মুরাদপুর মাহামুদাবাদ উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক হাবিবুর রহমানসহ কয়েকজন এরইমধ্যে মারা গেছেন। এছাড়া এ প্রকল্পের বিষয়ে ধারণা নেই বলে জানিয়েছেন উপজেলা জনস্বাস্থ্য কর্মকর্তাও।
সীতাকুণ্ড উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সেও বসানো হয় সোলার পাওয়ার্ড ডিস্যালাইনেশন ইউনিট। তবে সরেজমিনে দেখা গেছে, দীর্ঘদিন ধরে বন্ধ রয়েছে এই প্রকল্প। ফলে দোকান থেকে কিনে পানি পান করতে হচ্ছে রোগী ও স্বজনদের।
Advertisement
চিকিৎসা নিতে আসা নুরুল আবছার বলেন, সরকারিভাবে স্থাপিত প্রকল্পে পানি পাওয়া যাচ্ছে না। হাসপাতালের গণশৌচাগারের অবস্থাও শোচনীয়। দোকান থেকে কিনে পানি পান করতে হচ্ছে।
এ প্রকল্পের আওতায় সীতাকুণ্ডে বগাচতর গণিউল উলুম ইসলামিয়া ফাজিল মাদরাসার বহুতল ভবনের ছাদে ২০২০ সালে বসানো হয় একটি ইউনিট। প্রশিক্ষণ নেন মাদরাসার অধ্যক্ষ এইচ এম সলিমউল্ল্যাহ। তিনি বলেন, গত এক বছর ধরে এই প্রকল্পের কোনো সুপেয় পানি মিলছে না। স্থানীয় মার্কেটে নষ্ট হওয়া যন্ত্রাংশ পাওয়া যাচ্ছে না।
এই প্রকল্পের প্রশিক্ষণ নেওয়া ফৌজদারহাট কে এম উচ্চ বিদ্যালয়ের শিক্ষক কামরুল হাসান সজিব বলেন, প্রকল্পটি যখন চালু হয়েছিল, তখন ৭০-১০০ লিটার পানি পাওয়া যেত। বর্তমানে পানি গতি কমে গেছে। সরকারি এই প্রকল্প বাস্তবায়নকারী প্রতিষ্ঠানের কোনো যোগাযোগ নেই বলেও জানান তিনি।
এ প্রকল্পের প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত যুবক মোহাম্মদ ইকবাল বলেন, ২০২৩ সালে উপজেলা হলরুমে তিন ঘণ্টার প্রশিক্ষণ দেওয়া হলেও নষ্ট হওয়া সরঞ্জাম কোথায় পাওয়া তা জানায়নি। নষ্ট হওয়া যন্ত্রাংশের জন্য ১৫ থেকে ২০ হাজার টাকা পর্যন্ত দাবি করেন কয়েকজন টেকনিশয়ান (কারিগর)। তাতেও কোনো কাজ হচ্ছে না।
Advertisement
স্থানীয় কারিগর বিষু দেব বলেন, এ প্রকল্পের কোনো যস্ত্রাংশ দেশে নেই। অন্যান্য যন্ত্রাংশ থেকে মিলিয়ে প্রকল্প চালু রাখতে চেষ্টা চলছে।
এ বিষয়ে সীতাকুণ্ড উপজেলা জনস্বাস্থ্য কর্মকর্তা প্রণবেশ মহাজন বলেন, এটি পাইলট প্রকল্প ছিল। ২০২৪ সালে প্রকল্পটির কাজ শেষ হয়। প্রকল্প বাস্তবায়নকারী প্রতিষ্ঠানের প্রকল্পের উপকারভোগীদের প্রশিক্ষণ দিয়েছেন। প্রশিক্ষণপ্রাপ্তরা দেখাশোনা করছেন। এখন এ প্রকল্পে আমাদের দেখাশোনা করার দায়িত্ব নেই।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, সোলার ডিস্যালাইনেশন ইউনিট অস্ট্রেলিয়ার একটি পানি বিশুদ্ধকরণ প্রযুক্তি। বাংলাদেশে এ প্রযুক্তি নতুন। উপকূলীয়, বিশেষ করে লবণাক্তপ্রবণ স্থান বাছাই করে এই ব্যবস্থা বসানো হয়েছে।
প্রতিটি ইউনিটে নির্দিষ্ট আকারের একটি সৌরপ্যানেল স্থাপন করা হয়। প্যানেলের দুই পাশে দুটি পানির ট্যাংক বসানো হয়। পাশাপাশি দুই ট্যাংকের সংযোগ স্থাপনকারী একটি পাইপ থাকে।
একটি ট্যাংকে লবণাক্ত, আর্সেনিক, আয়রন বা অস্বাস্থ্যকর পানি দেওয়া হয়। এরপর সৌরচালিত বিদ্যুতের মাধ্যমে অস্বাস্থ্যকর সেই পানি টেনে নিয়ে যাওয়া হয় একটি চেম্বারে। এই চেম্বারে নির্দিষ্ট তাপমাত্রায় সেই পানি বিশুদ্ধ হয়ে চলে যায় অপর ট্যাংকে। এভাবে একটি ইউনিট থেকে দিনে ৫০ থেকে ৭০ লিটার পর্যন্ত বিশুদ্ধ পানি পাওয়ার কথা।
সৌরশক্তি ব্যবহার করে এ ব্যবস্থায় বাষ্পীভবন ও ঘনীভবন প্রক্রিয়ার মাধ্যমে পানি বিশুদ্ধিকরণ করা হয়। লবণ ও অন্যান্য দূষিত পদার্থ যেহেতু পানির সঙ্গে বাষ্পীভূত হয় না, তাই প্রক্রিয়াজাত পানি সম্পূর্ণ স্বাদহীন, গন্ধহীন ও দূষণমুক্ত হয়।
সীতাকুণ্ড উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মো. ফখরুল ইসলাম বলেন, লবণাক্ত পানি বিশুদ্ধকরণে এই প্রযুক্তি বাংলাদেশের জন্য নতুন। এই প্রযুক্তির টেকসই, স্থায়িত্ব, রক্ষণাবেক্ষণ ও সচল রাখার বিষয়টি সংশ্লিষ্ট দপ্তরে জানানো হয়েছে। এই প্রকল্পের মাধ্যমে স্থাপন করা ইউনিটগুলোর সচল রাখতে প্রয়োজনী ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
এম মাঈন উদ্দিন/এসআর/জেআইএম