উচ্চ মূল্যস্ফীতি, উচ্চ হারের ভ্যাট, সম্পূরক শুল্ক ও রাজনৈতিক পটপরিবর্তনসহ সার্বিক বিবেচনায় মোবাইল অপারেটরগুলোর গ্রাহক কমছে। গত বছরের জুন থেকে এ বছরের মার্চ পর্যন্ত ১০ মাসে দেশে মোবাইল অপারেটরগুলো প্রায় এক কোটির মতো (৯৮ লাখ ৬০ হাজার) গ্রাহক হারিয়েছে। এরমধ্যে সবচেয়ে বেশি গ্রাহক হারিয়েছে দেশের অন্যতম টেলিযোগাযোগ সেবাদাতা প্রতিষ্ঠান বাংলালিংক।
Advertisement
বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশনের (বিটিআরসি) তথ্যমতে, ২০২৪ সালের জুন থেকে চলতি বছরের মার্চ পর্যন্ত ১০ মাসে দেশে মোবাইল ফোন গ্রাহক কমেছে প্রায় ৯৮ লাখ ৬০ হাজার। এর মধ্যে গ্রামীণফোনের গ্রাহক কমেছে প্রায় ১৪ লাখ ৪৪ হাজার, রবি আজিয়াটার প্রায় ৩১ লাখ ৫০ হাজার আর বাংলালিংকের গ্রাহক কমেছে প্রায় ৬২ লাখ ৫০ হাজার। এসময়ে রাষ্ট্রায়ত্ত অপারেটর টেলিটকের গ্রাহক কমেছে ২০ হাজার। অপারেটরগুলোর মধ্যে গ্রাহক কমার শীর্ষে রয়েছে বাংলালিংক।
রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা, ক্রমাগত উচ্চ মুদ্রাস্ফীতি এবং টেলিকম পরিষেবার ওপর বিশ্বের সর্বোচ্চ করের বোঝার কারণে বাংলাদেশের টেলিকম শিল্প তীব্র প্রতিকূলতার মুখোমুখি হয়েছে। এই চাপগুলো ভোক্তাদের ক্রয়ক্ষমতা হ্রাস করেছে।- গাজী তাওহীদ আহমেদ
বিটিআরসির তথ্য বলছে, ২০২৪ সালের জুনে গ্রামীণফোনের গ্রাহক ছিল ৮ কোটি ৫৫ লাখ ৩০ হাজার। জুলাইতে তা কমে দাঁড়ায় ৮ কোটি ৫২ লাখ ৪০ হাজার। এরপর আগস্টে ৮ কোটি ৫০ লাখ ৮০ হাজার, সেপ্টেম্বরে ৮ কোটি ৪৮ লাখ ৩০ হাজার, অক্টোবরে ৮ কোটি ৪৭ লাখ ৪০ হাজার, নভেম্বরে ৮ কোটি ৪৫ লাখ ৫০ হাজার, ডিসেম্বরে তা আরও কমে ৮ কোটি ৪৫ লাখ ২০ হাজারে দাঁড়ায়।
Advertisement
চলছি বছরের জানুয়ারিতে গ্রামীণফোনের গ্রাহক দাঁড়ায় ৮ কোটি ৪৫ লাখ ৮০ হাজার। পরের দুই মাস ফেব্রুয়ারিতে ৮ কোটি ৪৯ লাখ আর মার্চে গ্রাহক দাঁড়ায় ৮ কোটি ৪০ লাখ ৯০ হাজার। অর্থাৎ, ১০ মাসে গ্রামীণফোনের গ্রাহক কমেছে প্রায় ১৪ লাখ ৪৪ হাজার।
জীবনযাত্রার ব্যয় বাড়ায় প্রয়োজনে বিকল্প সংযোগ নেওয়ার ক্ষেত্রেও অনেকে পিছিয়ে যাচ্ছেন। সাশ্রয়ের বিষয়টি মাথায় রেখে অনেকে একাধিক সিম ব্যবহার করছেন না। এসব কারণে মোট সংযোগের সংখ্যা কমে যাচ্ছে।- রবির কর্মকর্তা সাহেদ আলম
একই সময়ে অর্থাৎ ২০২৪ সালের জুন মাসে রবি আজিয়াটার গ্রাহক ছিল প্রায় ৫ কোটি ৯৫ লাখ ১০ হাজার, জুলাইতে এসে গ্রাহক দাঁড়ায় ৫ কোটি ৮৯ লাখ ২০ হাজার, আগস্টে অপারেটরটির গ্রাহক দাঁড়ায় ৫ কোটি ৮৩ লাখ ৬০ হাজার, সেপ্টেম্বরে ৫ কোটি ৭৮ লাখ ৮০ হাজার, অক্টোম্বরে ৫ কোটি ৭৬ লাখ, নভেম্বরে ৫ কোটি ৭১ লাখ ৪০ হাজার, ডিসেম্বরে গ্রাহক দাঁড়ায় ৫ কোটি ৬৭ লাখ ৩০ হাজার।
আরও পড়ুন একজনের নামে ১০টির বেশি সিম দেওয়া যাবে না স্টারলিংক নিয়ে যত প্রশ্ন টেলিকম শিল্পে নিরাপত্তাঝুঁকি এড়াতে উত্তম নীতির বিকল্প নেই২০২৫ সালের জানুয়ারিতে এসে রবি আজিয়াটার গ্রাহক দাঁড়ায় ৫ কোটি ৬৪ লাখ, ফেব্রুয়ারিতে ৫ কোটি ৬৩ লাখ ৯০ হাজার আর মার্চে এসে গ্রাহক দাঁড়ায় ৫ কোটি ৬৩ লাখ ৬০ হাজার। অর্থাৎ গত ১০ মাসে রবি আজিয়াটার গ্রাহক কমে প্রায় ৩১ লাখ ৫০ হাজার।
Advertisement
বাংলালিংকের ২০২৪ সালের জুনে গ্রাহক সংখ্যা ছিল প্রায় ৪ কোটি ৪৪ লাখ ৮০ হাজার। জুলাইতে এসে অপারেটরটির গ্রাহক দাঁড়ায় ৪ কোটি ৩৫ লাখ ৬০ হাজার, আগস্টে ৪ কোটি ২৪ লাখ ৭০ হাজার, সেপ্টেম্বরে ৪ কোটি ১৬ লাখ ৩০ হাজার, অক্টোম্বরে ৪ কোটি ১০ লাখ ৭০ হাজার, নভেম্বরে দাঁড়ায় ৪ কোটি ৫ লাখ ৩০ হাজার আর ডিসেম্বরে গ্রাহক আরও কমে দাঁড়ায় ৩ কোটি ৯৭ লাখ ৭০ হাজারে।
আওয়ামী লীগের বড় অংশের নেতাকর্মীরা এখন বেশিরভাগই পলাতক। অনেকের সিম বন্ধ। যারা বিভিন্ন গ্রুপ পরিচালনা করতেন, নানান রকম নম্বর ব্যবহার করে দল ও সরকারের বিভিন্ন এজেন্ডা বাস্তবায়নে কাজ করতেন, তাদের সিমগুলোও এখন বন্ধ।- বলছেন খাত সংশ্লিষ্টরা
নতুন বছরে অর্থাৎ ২০২৫ সালের জানুয়ারিতে এসে বাংলালিংকের গ্রাহক দাঁড়ায় ৩ কোটি ৯০ লাখ ৫০ হাজার, ফেব্রুয়ারিতে ৩ কোটি ৮৬ লাখ ৪০ হাজার আর মার্চে এসে অপারেটরটির গ্রাহক দাঁড়ায় ৩ কোটি ৮২ লাখ ৩০ হাজার। অর্থাৎ গত ১০ মাসে রবি আজিয়াটার গ্রাহক কমেছে প্রায় ৬২ লাখ ৫০ হাজার।
অপারেটরগুলোর ধারবাহিকভাবে গ্রাহক কমার কারণ জানতে বাংলালিংকের যোগাযোগপ্রধান (হেড অব কমিউনিকেশনস) গাজী তাওহীদ আহমেদ জাগো নিউজকে বলেন, ২০২৪ সালের চতুর্থ প্রান্তিকে রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা, ক্রমাগত উচ্চ মুদ্রাস্ফীতি এবং টেলিকম পরিষেবার ওপর বিশ্বের সর্বোচ্চ করের বোঝার কারণে বাংলাদেশের টেলিকম শিল্প তীব্র প্রতিকূলতার মুখোমুখি হয়েছে। এই চাপগুলো ভোক্তাদের ক্রয়ক্ষমতা হ্রাস করেছে, ফলে এই খাতে গ্রাহক বৃদ্ধি এবং ব্যবহারও কমেছে।
তিনি বলেন, চাপ আরও বাড়িয়ে আঞ্চলিক বাজারের তুলনায় বাংলাদেশে স্পেকট্রাম খরচ অসামঞ্জস্যপূর্ণভাবে বেশি রয়েছে। যার ফলে অপারেটরদের জন্য সাশ্রয়ী মূল্যের এবং ধারাবাহিক সংযোগ নিশ্চিত করা ক্রমশ কঠিন হয়ে পড়েছে। এই চ্যালেঞ্জগুলি সত্ত্বেও বাংলালিংক ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মগুলোতে বিনিয়োগ, নেটওয়ার্ক ক্ষমতা সম্প্রসারণ এবং উদ্ভাবন অনুসরণ করে চলেছে।
‘টেকসই শিল্প বৃদ্ধি এবং ডিজিটাল বৈষম্য দূর করতে কোম্পানিটি আরও সুষম এবং দূরদর্শী নিয়ন্ত্রক কাঠামোর বিষয়টিকে সক্রিয়ভাবে সমর্থন করছে’- বলেন এ কর্মকর্তা।
অন্যদিকে, রাষ্ট্রায়ত্ত অপারেটর টেলিটকের ২০২৪ সালের জুনে গ্রাহক ছিল ৬৫ লাখ ৬০ হাজার, জুলাইতে এসে গ্রাহক সংখ্যা অপরিবর্তিত থাকে। এরপর আগস্টে অপারেটরটির গ্রাহক দাঁড়ায় ৬৫ লাখ ৩০ হাজার, সেপ্টেম্বরে ৬৫ লাখ ২০ হাজার, অক্টোম্বরে ৩০ হাজার গ্রাহক বেড়ে দাঁড়ায় ৬৫ লাখ ৫০ হাজার, নভেম্বরে আরও ১০ হাজার গ্রাহক বেড়ে দাঁড়ায় ৬৫ লাখ ৬০ হাজার, ডিসেম্বরে গ্রাহক অপরিবর্তিত থাকে।
২০২৫ সালের জানুয়ারিতে এসে টেলিটকের গ্রাহক আরও ১০ হাজার বেড়ে দাঁড়ায় ৬৫ লাখ ৭০ হাজার, ফেব্রুয়ারিতে গ্রাহক কমে দাঁড়ায় ৬৫ লাখ ৬০ হাজার আর মার্চ মাসে এসে গ্রাহক দাঁড়ায় ৬৫ লাখ ৪০ হাজার। অর্থাৎ গত ১০ মাসে টেলিটকের গ্রাহক কমে ২০ হাজার।
আরও পড়ুন বিদেশি মোবাইল অপারেটরদের হাতে ডিডব্লিউডিএম, সংকটে দেশীয় কোম্পানি মোবাইলে কথা বলার ওপর শুল্ক-কর কমানোর সুপারিশগ্রাহক কমার বিষয়ে জানতে চাইলে মোবাইল ফোন অপারেটরগুলো জানায়, জীবনযাত্রায় উচ্চ মূল্যস্ফীতির প্রভাব রয়েছে। সঙ্গে ভ্যাট ও সম্পূরক শুল্ক নিয়েও ব্যবসায়ীরা দিশেহারা। এর প্রভাব পড়ছে ডিজিটাল খাতে। বিভিন্ন খাতে অর্থনৈতিক বিরূপ প্রভাব পড়ায় মোবাইল অপারেটরগুলোর ওপরও এর নেতিবাচক প্রভাব লক্ষ্য করা যাচ্ছে।
খাত সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন, গ্রাহক কমার পেছনে উচ্চকর বা মূল্যস্ফীতি যতটা না প্রভাব ফেলছে তারচেয়েও বেশি প্রভাব রয়েছে সরকার পতনের মতো বৃহৎ ঘটনায়। দেশের বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে থাকা আওয়ামী লীগের বড় অংশের নেতাকর্মীরা এখন বেশিরভাগই পলাতক। অনেকের সিম বন্ধ। অনেক রাজনৈতিক নেতাকর্মী যারা বিভিন্ন গ্রুপ পরিচালনা করতেন, নানান রকম নম্বর ব্যবহার করে দল ও সরকারের বিভিন্ন এজেন্ডা বাস্তবায়নে কাজ করতেন, তাদের সিমগুলোও এখন বন্ধ।
জানতে চাইলে রবি আজিয়াটার চিফ করপোরেট অ্যান্ড রেগুলেটরি অফিসার সাহেদ আলম জাগো নিউজকে বলেন, গ্রাহক কমার পেছনে সার্বিক অর্থনৈতিক পরিস্থিতি, উচ্চ মূল্যস্ফীতি এবং ভ্যাট, সম্পূরক শুল্ক ও সিম কর ২০০ টাকা থেকে বাড়িয়ে ৩০০ টাকা করার সিদ্ধান্তকে অন্যতম কারণ হিসেবে বিবেচনা করা যায়। সিমের মূল্যবৃদ্ধির কারণে মানুষ নতুন কিংবা একাধিক সংযোগ নেওয়ার আগ্রহ হারাচ্ছেন।
‘জীবনযাত্রার ব্যয় বাড়ায় প্রয়োজনে বিকল্প সংযোগ নেওয়ার ক্ষেত্রেও অনেকে পিছিয়ে যাচ্ছেন। সাশ্রয়ের বিষয়টি মাথায় রেখে অনেকে একাধিক সিম ব্যবহার করছেন না। এসব কারণে মোট সংযোগের সংখ্যা কমে যাচ্ছে’- যোগ করেন তিনি।
জানতে চাইলে গ্রামীণফোনের হেড অব কমিউনিকেশনস শারফুদ্দিন আহমেদ চৌধুরী বলেন, সার্বিক অর্থনৈতিক পরিস্থিতি, উচ্চ মূল্যস্ফীতি এবং উচ্চ হারের ভ্যাট, সম্পূরক শুল্ক ও সিম ট্যাক্সের প্রভাবে গ্রাহক সংখ্যা কমেছে।
হামিদুর রহমান/এমডিএইচআর/এমকেআর/জিকেএস