মাদারীপুর রাজৈরের কদমবাড়ীতে চার দিনব্যাপী কুম্ভমেলা শুরু হয়েছে। নেপাল, ভারত, শ্রীলঙ্কা ও ভুটান থেকে সাধুরাও মেলায় অংশ নিচ্ছেন। পুণ্য অর্জনের উদ্দেশ্যে আসা ভক্তদের পদচারণায় মুখর হয়ে উঠেছে মেলা প্রাঙ্গণ।
Advertisement
বুধবার (২৮ মে) সকাল থেকে মেলা শুরু হয়। আগামী শনিবার পর্যন্ত চলবে। এর আগে মঙ্গলবার (২৭ মে) রাত থেকে দলে দলে জয় ডংকা ও নানা রকমের বাদ্যযন্ত্র বাজিয়ে জয় হরিবল ও জয়বাবা গণেশ পাগল ধ্বনি করতে করতে দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে সাধু সন্ন্যাসী ও ভক্তরা বাসে, ট্রাকে, ট্রলারে ও হেঁটে মেলা প্রাঙ্গণে আসতে শুরু করেন।
ধারণা করা হচ্ছে, প্রতি বছরের মতো এবারও মেলায় ১৫ লাখের মতো ভক্তদের আগমন ঘটবে। তাই মেলাকে ঘিরে ব্যাপক নিরাপত্তার ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। এছাড়াও মেলাকে ঘিরে পুরো মাঠ জুড়ে বসেছে সারি সারি দোকান। এসব দোকানে পাওয়া যাচ্ছে পছন্দের সব সামগ্রী।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, শত বছর ধরে মাদারীপুরের রাজৈরের কদবাড়ির দিঘীরপাড় এলাকার শ্রী শ্রী গণেশ পাগল সেবাশ্রমে দেশের ঐতিহ্যবাহী এই কুম্ভ মেলা অনুষ্ঠিত হয়ে আসছে। এই কুম্ভ মেলাকে অনেকে কামনার মেলাও বলে থাকেন। হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের শাস্ত্রমতে সত্য যুগে দেবতা ও অসুরদের মধ্যে সমুদ্র মন্থনে যে অমৃত সুধা উঠেছিল, তা চারটি কুম্ভ পাত্রে হরিদ্বার, প্রয়াগ, উজ্জয়িনী ও নাসিক নামে চার স্থানে রাখা হয়েছিল। এ ঘটনার পর থেকে ভারতীয় মুনি ঋষিরা কুম্ভমেলার আয়োজন করে আসছেন।
Advertisement
শত বছর আগে জ্যৈষ্ঠ মাসের ১৩ তারিখে ১৩ জন সাধু ১৩ সের চাল ও ১৩ টাকা নিয়ে রাজৈর উপজেলার কদমবাড়ীর দীঘিরপাড় এলাকায় ভারতের কুম্ভমেলাকে অনুসরণ করে এ মেলার আয়োজন করেন। সেই থেকে এখানে শ্রী শ্রী গণেশ পাগল সেবাশ্রমে এ মেলা অনুষ্ঠিত হয়ে আসছে। মূল মেলা হয় এক রাতের জন্য। তবে এই মেলা চার দিন চলবে। কখনও কখনও সপ্তাহব্যাপীও হয়ে থাকে। এখানে বিভিন্ন দেব-দেবতার ১০৮টি মন্দির রয়েছে। আয়োজকরা ধারণা করছেন প্রতিবছরের মতো এবারও ১৫ লক্ষাধিক ভক্তবৃন্দের উপস্থিতি ঘটেবে।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, খুলনা, বরিশাল, পিরোজপুর, ঝালকাঠি, সাতক্ষীরা, রাজশাহী, বগুড়া, চট্টগ্রাম, রংপুর, যশোর, খুলনা, ফরিদপুর, রাজবাড়ী, নারায়ণগঞ্জ, গোপালগঞ্জ, গৌরনদীসহ দেশের বিভিন্ন জেলা থেকে দলে দলে মানুষ আসেন এ মেলায়। এছাড়াও পার্শ্ববর্তী দেশ ভারত, নেপাল, শ্রীলঙ্কা ও ভুটান থেকেও বহু ভক্তবৃন্দ আসেন। মেলায় আসা হাজার হাজার সাধু সন্ন্যাসী ও ভক্তরা একতারা-দোতারায় সুর দিয়ে সারা রাত মেতে থাকেন। আয়োজন করা হয় ছোট-বড় অর্ধশতাধিক প্যান্ডেলে বাউল ও ধর্মীয় সঙ্গীতানুষ্ঠান। গভীর রাত পর্যন্ত চলে ভক্তদের মধ্যে ভক্তসেবা কমিটির প্রসাদ বিতরণ।
এছাড়াও মেলা উপলক্ষে প্রায় ৯ বর্গকিলোমিটার এলাকাজুড়ে বসেছে সারি সারি নানা রকমের দোকান। মেলার সাতদিন আগে থেকেই দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে আসেন দোকানিরা। বাঁশ-বেতের শিল্প কারুকাজ খচিত গৃহস্থালি মালামাল, মৃৎ শিল্প বা মাটির তৈরি তৈজসপত্র, বাহারী মিষ্টি, আকর্ষণীয় খেলনা ও বাহারি প্রসাধনী পণ্য দিয়ে সাজিয়ে ছোট-বড় দুই সহস্রাধিক বিভিন্ন ধরনের স্টল বসেছে।
মেলায় ঘুরতে আসা দর্শনার্থী প্রীতম ঘোষ বলেন, আমি শরীয়তপুর থেকে এসেছি। প্রতিবছরই আসি। এখানে এসে পূজা আর্চনা করি এবং ঘুরে ঘুরে সব দেখি। আমার খুব ভালো লাগে।
Advertisement
খুলনা থেকে আসা প্রদীপ সাহা বলেন, পরিবারকে সঙ্গে নিয়ে মেলায় ঘুরতে আসি। এটি আমাদের কাছে দেশের সবচেয়ে বৃহৎ মেলা বলে মনে করি। তাছাড়া গনেশ পাগলের কাছে মানত করলে মনের বাসনা পূর্ণ হয়। তাই এখানে এসেছি।
ব্যবসায়ী মনোষ সাহা বলেন, প্রতিবছরই এই কুম্ভুমেলায় দোকান নিয়ে আসি। আমার প্রসাধনী ও কসমেটিকসের দোকান। মেলায় বেচাকেনা অনেক ভালো হয়। লাভও ভালো হয়।
গনেশ পাগল সেবাশ্রম ও মেলা কমিটির সাধারণ সম্পাদক নীল রতন সরকার বলেন, ধারণা করা হচ্ছে এবারও মেলায় ১৫ থেকে ২০ লাখ মানুষের আগমন হবে। আবহাওয়া ও পরিস্থিতি স্বাভাবিক থাকায় আগেভাগে চলে এসেছেন অনেক ভক্ত। এছাড়া এক কিলোমিটার এলাকাজুড়ে নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সংযোগ রয়েছে। শান্তিপূর্ণভাবে মেলা শেষ করতে সবাই আন্তরিক আছেন। আশা করছি সুন্দর পরিবেশের মধ্য দিয়ে মেলা শেষ হবে।
রাজৈর থানার পরিদর্শক (তদন্ত) সঞ্জয় কুমার ঘোষ বলেন, ‘মাদারীপুরের পুলিশ সুপার স্যারের নির্দেশনায় মেলার চারদিকে পুলিশ নিরাপত্তা আছে। বাড়ানো হয়েছে গোয়েন্দা নজরদারি। প্রায় ২০০ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্য কাজ করছেন। উৎসব শান্তিপূর্ণ করতে তিনস্তরের নিরাপত্তাব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে। এছাড়া একটি কন্ট্রোল রুম খোলা হয়েছে ও টাওয়ার নির্মাণ করা হয়েছে। যা থেকে মেলার মাঠ সার্বক্ষণিক মনিটরিং করা হচ্ছে।
আয়শা সিদ্দিকা আকাশী/এমএন/এমএস