ঢাকার অপরাধ জগতের আলোচিত নাম ছিল সুব্রত বাইন ওরফে ফতেহ আলী। তালিকাভুক্ত এই শীর্ষ সন্ত্রাসী তার সহযোগী মোল্লা মাসুদ, আরাফাত ও শরিফসহ গ্রেফতার হয়েছেন। আগেও গ্রেফতার হয়েছিলেন সুব্রত বাইন। কিন্তু জামিনে বেরিয়ে এসে আবারও জড়িয়ে পড়েন অপরাধ জগতে।
Advertisement
আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর একাধিক সূত্র জানায়, সম্প্রতি ঢাকার হাতিরঝিল ও গুলশান এলাকার তিনটি খুনের ঘটনায় সুব্রত বাইনের নাম আসে। খুন ছাড়াও জমি, ফ্ল্যাট দখল ও চাঁদাবাজির একাধিক ঘটনায় সুব্রত বাইন ও তার অনুসারীদের সংশ্লিষ্টতা পাওয়া গেছে।
পুলিশের একটি সূত্র বলছে, রাজধানীর হাতিরঝিলে ২১ এপ্রিল সুব্রত বাইনের অনুসারীদের গুলিতে ওয়ার্ড যুবদলের সদস্য আরিফ সরদার (৩৫) মারা যান। সীমান্ত দিয়ে ভারত থেকে বেশ কিছু অস্ত্র এনেছেন সুব্রত বাইন। সেই অস্ত্র ব্যবহার করে খুনসহ নানা অপরাধ করছে তার বাহিনী।
কুষ্টিয়ার এই বাড়ি থেকে গ্রেফতার হন সুব্রত বাইন
Advertisement
আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর বিভিন্ন সূত্র থেকে সুব্রত বাইনের অপরাধ জগতে জড়ানোর তথ্য পাওয়া যায়।
নব্বই দশক থেকে শুরু
সূত্রগুলো বলছে, নব্বইয়ের দশকে ঢাকায় আধিপত্য বিস্তার করে দরপত্র নিয়ন্ত্রণ ও বিভিন্ন স্থানে চাঁদাবাজিতে সুব্রত বাইনের নাম আসা ছিল তখনকার নিয়মিত ঘটনা। এসব কাজ করতে গিয়ে অসংখ্য খুন-জখমের ঘটনাও ঘটেছে। একাধিকবার আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হাতে গ্রেফতার হয়ে কারাগারেও গেছেন তিনি। তবে জামিনে বেরিয়ে আবারও যুক্ত হয়েছেন বিভিন্ন অপরাধে।
সুব্রতর জন্ম
Advertisement
সুব্রত বাইনের পুরো নাম ত্রিমাতি সুব্রত বাইন। জন্ম ১৯৬৭ সালে, ঢাকার হলি ফ্যামিলি হাসপাতালে। বরিশালের আগৈলঝাড়া উপজেলার জোবারপাড় গ্রামের সন্তান সুব্রত বাইনের বাবা বিপুল বাইন ছিলেন একটি এনজিওর গাড়িচালক। মা ও তিন বোনকে নিয়ে মগবাজারে ভাড়া বাসায় বসবাস করতেন। সুব্রত ছিলেন পরিবারের বড় সন্তান।
কলেজে ওঠার পর অপরাধ জগতে সুব্রত
ছেলেবেলায় পড়াশোনা শুরু বরিশালের অক্সফোর্ড মিশন স্কুলে। পরে ঢাকায় শেরেবাংলা স্কুলে নবম শ্রেণিতে ভর্তি হন সুব্রত। সেখান থেকেই এসএসসি পাস। কলেজে ওঠার পর সুব্রতের অপরাধ জগতে প্রবেশ। সিদ্ধেশ্বরী কলেজে ভর্তি হতে গিয়ে এক নেতার সঙ্গে পরিচয় হয় তার, আর সেই সূত্র ধরে অস্ত্র হাতে নেওয়া। পরে মগবাজারে গড়ে তোলেন নিজস্ব সন্ত্রাসী বাহিনী।
চাঁদাবাজির ঘটনায় নাম ছড়িয়ে পড়ে সুব্রত বাইনের
১৯৯৩ সালে রাজধানীর মধুবাজারের এক সবজি বিক্রেতা খুনের ঘটনায় পুলিশের নজরে আসেন সুব্রত বাইন। এরপর মগবাজারের বিশাল সেন্টার নির্মাণের সময় চাঁদাবাজির ঘটনায় তার নাম ছড়িয়ে পড়ে। এরপর দ্রুতই হয়ে ওঠেন ভয়ংকর অপরাধী। মগবাজার, রমনা, কারওয়ান বাজার, মধুবাগ—এসব এলাকা ছিল সুব্রত বাইনের দখলে। ১৯৯১ সালে জাসদ ছাত্রলীগ নেতা মুরাদ খুনের ঘটনায় সুব্রত বাইনের যাবজ্জীবন সাজা হয়।
আরও পড়ুন:
কুষ্টিয়ার যে বাড়ি থেকে গ্রেফতার শীর্ষ সন্ত্রাসী সুব্রত বাইন দীর্ঘদিনের গোয়েন্দা তৎপরতায় গ্রেফতার সুব্রত বাইন-মোল্লা মাসুদ সেনা অভিযানে শীর্ষ সন্ত্রাসী সুব্রত বাইন গ্রেফতাররাজনীতির সঙ্গেও ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ গড়ে তোলেন সুব্রত। ১৯৯১ সালের নির্বাচনে বিএনপির হয়ে মগবাজার এলাকায় কাজ করে তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর ঘনিষ্ঠ হয়ে ওঠেন। জন্মদিনের অনুষ্ঠানে বিএনপির শীর্ষ নেতাদের উপস্থিতি সুব্রতকে তারকা সন্ত্রাসীর তকমা দেয়। পরে যুবলীগের লিয়াকতের সঙ্গে মগবাজারের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে সংঘর্ষে জড়ান।
২০০১ সালে ইন্টারপোলে নাম ওঠে সুব্রত বাইনের
২০০১ সালে তার নামে ইন্টারপোলের নোটিশ জারি হয়। ইন্টারপোলের সেই নোটিশ এখনো জারি রয়েছে। ইন্টারপোলে নোটিশ জারির পর কলকাতায় পালিয়ে যান সুব্রত বাইন। সেখানেও অপরাধের জগতে সক্রিয় থাকেন। ২০০৮ সালে কলকাতা পুলিশ তাকে গ্রেফতার করে। পরে পালিয়ে যান নেপাল, আবার ধরা পড়েন। শেষবার ২০১২ সালে কলকাতায় গ্রেফতার হয়েছিলেন তিনি।
যেভাবে গ্রেফতার
দীর্ঘদিন ধরে পলাতক থাকার পর সেনাবাহিনীর বিশেষ অভিযানে ২৭ মে সকাল ৫টার পর কুষ্টিয়া থেকে গ্রেফতার করা হয় সুব্রত বাইন ও মোল্লা মাসুদকে। পরে তাদের দেওয়া তথ্যের ভিত্তিতে রাজধানীর হাতিরঝিল এলাকা থেকে সুব্রত বাইনের অপর দুই সহযোগী শুটার আরাফাত এবং শরীফকে গ্রেফতার করা হয়।
আইএসপিআরের সংবাদ সম্মেলনে বলা হয়, গ্রেফতার চারজনের নামে বিভিন্ন থানায় হত্যা, চাঁদাবাজিসহ বিভিন্ন নাশকতামূলক কর্মকাণ্ডের অভিযোগে মামলা রয়েছে। সুব্রত বাইন এবং মোল্লা মাসুদ সেভেন স্টার সন্ত্রাসী দলের নেতা এবং তালিকাভুক্ত ২৩ শীর্ষ সন্ত্রাসীদের অন্যতম। সুনির্দিষ্ট গোয়েন্দা তথ্যের ভিত্তিতে মঙ্গলবার সকালে অভিযানটি পরিচালনা করা হয়।
টিটি/জেডএইচ/