দেশীয় টেক্সটাইল খাতসহ সব শিল্প খাতের ন্যায্য স্বার্থ সংরক্ষণের লক্ষ্যে অবিলম্বে জ্বালানি এবং খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়ের প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী শিল্পখাতে অগ্রাধিকারের ভিত্তিতে গ্যাসের নিরবচ্ছিন্ন সরবরাহের ব্যবস্থা নিশ্চিত করার দাবি জানিয়েছেন বাংলাদেশ টেক্সটাইল মিলস অ্যাসোসিয়েশনের (বিটিএমএ) প্রেসিডেন্ট শওকত আজিজ রাসেল।
Advertisement
রোববার (২৫ মে) গুলশান ক্লাবে আয়োজিত যৌথ সংবাদ সম্মেলনে এ দাবি জানান তিনি।
সংবাদ সম্মেলনে এফবিসিসিআই, বিজিএমইএ, বিকেএমইএ, বিসিআই, আইসিসি বাংলাদেশ, এলএফএমইএবি, বিটিটিএলএমইএ, বিপিজিএমইএ’র প্রতিনিধিরা উপস্থিত ছিলেন।
এ সময় তিনি সরকারের কাছে শিল্পখাত ও ক্যাপটিভ পাওয়ার প্ল্যান্টগুলোয় গ্যাসের মূল্যবৃদ্ধির সিদ্ধান্ত স্থগিত করা এবং এই বিষয়ে সংশ্লিষ্ট অংশীজনদের সঙ্গে আলোচনার ভিত্তিতে একটি টেকসই নীতিমালা প্রয়োজন। শিল্পখাতে বিরাজমান গ্যাসের সংকট মোকাবিলায় জরুরি পদক্ষেপ গ্রহণ এবং নিরবচ্ছিন্ন গ্যাস সরবরাহ নিশ্চিত করার জন্য মধ্য-দীর্ঘমেয়াদি কৌশল ও কর্মপরিকল্পনা প্রণয়নের দাবি জানান।
Advertisement
শওকত আজিজ রাসেল বলেন, বাংলাদেশের অর্থনীতি তথা রপ্তানি আয়ের প্রধান চালিকা শক্তি দেশের টেক্সটাইল সেক্টর দীর্ঘদিন যাবত বিভিন্ন সমস্যার সম্মুখীন হয়েছে। এর মধ্যে গ্যাস ও বিদ্যুতের ক্রমাগত অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধি, ডলারের সংকট, ব্যাংক সুদের হার ১৮ শতাংশ পর্যন্ত বৃদ্ধি, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র কর্তৃক বাংলাদেশের রপ্তানি পণ্যের ওপর আরোপিত অতিরিক্ত ৩৭ শতাংশ শুল্ক, রপ্তানির বিপরীতে নগদ প্রণোদনার অস্বাভাবিক হ্রাস এবং টাকার অবমূল্যায়নের কারণে ওয়ার্কিং ক্যাপিটালের সংকট ইত্যাদি বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।
তিনি বলেন, দেশের শিল্পকারখানা বিশেষ করে টেক্সটাইল মিল এবং পোশাক খাতে হঠাৎ করেই গ্যাস সরবরাহে কারখানাগুলোতে মারাত্মক সংকট তৈরি হয়েছে। গত দুই সপ্তাহ ধরে চলা পরিস্থিতিতে সমস্যা ধীরে ধীরে আরো প্রকট হচ্ছে। এতে উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছেন শিল্প উদ্যোক্তা এবং রপ্তানিকারকরা। এক থেকে দেড় মাস ধরে চলা প্রকট গ্যাস সংকটে দেশের রপ্তানিনির্ভর ও স্থানীয় টেক্সটাইল মিল এবং পোশাক খাতসহ অনেক খাতের কারখানা/মিলের উৎপাদন আংশিক অথবা সম্পূর্ণরূপে বন্ধ হয়ে গেছে। গ্যাসের অভাবে পোশাক কারখানাগুলো উৎপাদন কার্যক্রম পরিচালনা করতে না পারায় চলমান কার্যাদেশ অনুযায়ী যথাসময়ে পণ্য সরবরাহের জন্য বাধ্য হয়ে আন্তর্জাতিক ক্রেতা প্রতিষ্ঠানকে বিমান পথে অতিরিক্ত খরচে পণ্য সরবরাহ করতে হচ্ছে। এতে ওই পোশাক কারখানাগুলোকে বিশাল অংকের আর্থিক ক্ষতির সম্মুখীন হতে হচ্ছে।
টেক্সটাইল মিল এবং পোশাক কারখানাসহ অন্যান্য খাতগুলোতে গ্যাসের সংকট দীর্ঘদিনের। এরই সঙ্গে বিদ্যুতের লোডশেডিং সব মাত্রা অতিক্রম করে গেছে। গ্যাসের নিরবচ্ছিন্ন সরবরাহের আশ্বাসে গত কয়েক বছরে দফায় দফায় ৩০০ শতাংশ এর অধিক মূল্য বৃদ্ধি করা হয়, একই সঙ্গে মিল মালিকদের সিকিউরিটি বাবদ অতিরিক্ত অর্থ প্রদান করতে হয়। শিল্পে নিরবচ্ছিন্ন গ্যাসের সরবরাহের নামে মূল্যবৃদ্ধি করা হলেও বাস্তবে গ্যাস সরবরাহ পরিস্থিতির কোনো উন্নতি হয়নি।
বিটিএমএ প্রেসিডেন্ট বলেন, বর্তমানে পৃথিবীতে ট্যারিফ যুদ্ধ এবং ভূ-রাজনৈতিক কারণে বিভিন্ন দেশের শিল্পপ্রতিষ্ঠান অন্য দেশগুলোতে সুবিধাজনক উৎপাদন পরিবেশ প্রাপ্তি সাপেক্ষে স্থানান্তর হচ্ছে। স্থানান্তরের অপেক্ষায় থাকা এসব শিল্প প্রতিষ্ঠানগুলো বাংলাদেশে স্থাপনের সম্ভাবনা থাকলেও দেশের বর্তমান গ্যাস সংকট এবং ব্যাংক খাতের আর্থিক সক্ষমতার অভাবে বাংলাদেশ এই সুযোগ থেকে বঞ্চিত হতে যাচ্ছে।
Advertisement
তিনি বলেন, দেশের অর্থনীতিতে টেক্সটাইল সেক্টরের অবদান অপরিসীম, কিন্তু দুঃখের বিষয় এ সেক্টরটি বিগত ৩ বছরেরও বেশি সময় ধরে জ্বালানি সংকটের জন্য স্বাভাবিক উৎপাদন কার্যক্রম পরিচালনা করতে পারছে না। বিগত কয়েক মাস যাবত তীব্র গ্যাস সংকটের কারণে মিলগুলো তাদের উৎপাদন ক্ষমতার মাত্র ৪০-৫০ শতাংশের বেশি ব্যবহার করতে পারছে না। ফলশ্রুতিতে সুতা, কাপড় ও পোশাকের উৎপাদন ব্যাপকভাবে হ্রাস পাওয়ায় উৎপাদন খরচ প্রায় দ্বিগুণ হওয়ায় প্রতিযোগী দেশগুলোর সঙ্গে এ সেক্টরের প্রতিযোগিতার সক্ষমতাকে মারাত্মকভাবে ক্ষুণ্ন করছে যার প্রভাব আমাদের রপ্তানি আয়ের মুখ্য খাত তথা তৈরি পোশাক রপ্তানিতে নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে। টেক্সটাইল শিল্পে উৎপাদন খরচ বৃদ্ধি পাওয়ায় আমাদের স্থানীয় বাজারও বিদেশিদের হাতে চলে যাচ্ছে। মিল-কারখানাগুলো উৎপাদন সক্ষমতা ব্যবহার করতে না পারলে কীভাবে আসন্ন ঈদ উপলক্ষে শ্রমিকদের বেতন-বোনাস প্রদান করবে? ক্রমশ ওয়ার্কিং ক্যাপিটাল সংকুচিত হওয়ায় শিল্প মালিকরা এক অসহনীয় পরিস্থিতির সম্মুখীন।
তিনি বলেন, এমতাবস্থায় ব্যবসায়ীরা কীভাবে ব্যাংক ঋণের অর্থ পরিশোধ করবেন তা না নিয়ে গভীর অনিশ্চয়তায় রয়েছেন। যদি সময়মতো ব্যাংকের পাওনা পরিশোধ করা সম্ভব না হয় তাহলে দেশের আর্থিক খাতও সংকটে পড়ার আশঙ্কায় পড়বে মর্মে আমরা মনে করি।
তিনি বলেন, প্রধান উপদেষ্টাসহ সরকারের সংশ্লিষ্ট দপ্তরে বারংবার পত্র প্রেরণ, আবেদন এবং নিবেদন করেও গ্যাস সংকটের কোনো সমাধান হয়নি। তথাপিও সম্প্রতি সকল অংশীজনের আপত্তি আমলে না নিয়ে অযৌক্তিকভাবে গ্যাসের মূল্যবৃদ্ধি করা হয়েছে। তবে গত কয়েক সপ্তাহ ধরে যে সমস্যা দেখা যাচ্ছে এর অন্যতম প্রধান কারণ বিদ্যুৎ ও সার উৎপাদন বাড়াতে শিল্পকারখানাগুলোতে সরবরাহ কমিয়ে দেওয়া। এর মধ্যে শুধু তিতাস নেটওয়ার্কেই শিল্পখাতে দৈনিক ১০০ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস সরবরাহ কমেছে। এছাড়াও আমরা মনে করি সিস্টেম লস ২০ শতাংশের কাছাকাছি কারণ সকল টেক্সটাইল মিল এবং পোশাক কারখানায় ইভিসি মিটার স্থাপন করা হয়নি। ফলে সিস্টেম লসের প্রকৃত হিসাব বোঝা যাচ্ছে না।
তিনি আরও বলেন, গ্যাস সরবরাহ পাওয়ার ক্ষেত্রে রপ্তানি খাতের প্রতিষ্ঠানগুলোকে অগ্রাধিকার প্রদান করা উচিত হলেও তা করা হচ্ছে না বরং রপ্তানি আয়ের মূল উৎসের প্রতিষ্ঠানগুলো গ্যাসের অভাবে স্বাভাবিক উৎপাদন কার্যক্রম পরিচালনা করতে পারছে না। অধিকাংশ টেক্সটাইল মিল এবং পোশাক কারখানায় গ্যাসের শূন্য চাপের প্রমাণ রয়েছে। গ্যাস সরবরাহের এই অবস্থা চলতে থাকলে বিটিএমএ, বিজিএমইএ, বিকেএমইএ এবং বিটিটিএলএমইএ এর অধীনের টেক্সটাইল এবং পোশাক খাতের প্রায় ৭০ বিলিয়ন ডলারের বিনিয়োগ মারাত্মক হুমকির মুখে পড়বে। এই সংকট চলতে থাকলে উৎপাদন কার্যক্রম ব্যাহত হয়ে রপ্তানি কমে যাবে। ফলে ফরেন রিজার্ভের ওপর নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। সামষ্টিক অর্থনীতি মেরামতের সরকারের সাম্প্রতিক উদ্যোগকে বাধাগ্রস্ত করবে। নেতিবাচক প্রভাব পড়বে দেশের অর্থনীতিতে। এতে আর্থিক সংকট ঘনীভূত হবে, ব্যাংক ঋণ এবং শ্রমিকদের বেতনাদি পরিশোধে আশঙ্কা তৈরি হবে মর্মে উৎপাদক এবং রপ্তানিকারকরা অত্যন্ত উদ্বিগ্ন।
তিনি বলেন, আরও উদ্বেগের বিষয় হচ্ছে নতুন কোনো কর্মসংস্থান হচ্ছে না বরং কর্মরত শ্রমিকদের বেতন-ভাতাদি পরিশোধে অনিশ্চয়তার আশঙ্কা রয়েছে। কিন্তু গ্যাসের এই মারাত্মক সংকট থেকে উত্তরণের জন্য সরকারের সংশ্লিষ্ট দপ্তর বিশেষ করে জ্বালানি মন্ত্রণালয়, বিইআরসি, পেট্রোবাংলা এবং তিতাসের কাছ থেকে এখন পর্যন্ত কোনো ধরনের পরিকল্পনা কিংবা রূপরেখা প্রদান করা হয়নি। এমতাবস্থায় সার্বিক অবস্থা বিবেচনায় অতিসত্বর যে কোনো মূল্যে বিশেষ অগ্রাধিকার প্রদান করে টেক্সটাইল এবং পোশাক খাতে নিরবচ্ছিন্ন গ্যাস সরবরাহ নিশ্চিত করতে হবে।
এ সময় অনতিবিলম্বে সিস্টেম লস বন্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করা, অবৈধ সংযোগ বিচ্ছিন্ন করা, বিইআরসি, পেট্রোবাংলা, তিতাসসহ গ্যাস সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান সমূহকে মুনাফা অর্জন পরিহার করা এবং গ্যাস সরবরাহের সব পর্যায়ে ভ্যাট প্রত্যাহার করার জন্য সরকারের প্রতি আহ্বান জানান।
এনএস/এমআরএম/জিকেএস