মতামত

রাষ্ট্রীয় দায়িত্ব, রাজনীতি ও পরিবর্তনের বাস্তবতা

রাষ্ট্রীয় দায়িত্ব, রাজনীতি ও পরিবর্তনের বাস্তবতা

বর্তমান বাংলাদেশের রাজনৈতিক বাস্তবতা জটিল ও বহুমাত্রিক। এই প্রেক্ষাপটে ড. মুহাম্মদ ইউনুসের পদত্যাগ না করাকে অনেকে যেমন সংকট মোকাবেলার প্রয়াস হিসেবে দেখছেন, তেমনি অনেকে তা নিয়ে প্রশ্নও তুলছেন। তবে একটি বিষয় স্পষ্ট—কোনো রাজনৈতিক দলই সরাসরি তাঁর পদত্যাগ দাবি করেনি। এটি প্রমাণ করে, রাজনীতিক মহলে এই উপলব্ধি রয়েছে যে তাঁর সরে দাঁড়ানোতে দেশে আরও গভীর রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা তৈরি হতে পারে। বর্তমান অনির্বাচিত সরকারের প্রেক্ষাপটে এই শূন্যতা নতুন সংকটের জন্ম দিত।

Advertisement

ড. ইউনূস নিজেই স্বীকার করেছেন, চারদিকে অনিয়ম, দুর্নীতি ও চরম অনাচার বন্ধ করা যাচ্ছে না। এই ব্যর্থতা তাকে নৈতিকভাবে আঘাত করেছে। তা সত্ত্বেও কিছু গোষ্ঠী—দেশে ও প্রবাসে—যারা নিজেদের 'অরাজনৈতিক' বলে দাবি করেন, কিন্তু আসলে রাজনীতিরই অংশ, তাঁরা এই সরকারকে আরও দীর্ঘায়িত করার পক্ষে অবস্থান নিয়েছেন। অথচ একটি মৌলিক সত্য হলো—রাজনীতি ছাড়া কোনো দেশ চলতে পারে না। একটি সরকার, তার চরিত্র যাই হোক, শেষ পর্যন্ত রাজনৈতিকই হয়ে ওঠে।

ড. ইউনূসও এর ব্যতিক্রম নন। আমরা বিশ্বাস করি, রাষ্ট্র পরিচালনার দায় নিতে হলে রাজনৈতিক বাস্তবতা মেনেই চলতে হবে। তাই তাঁর সরকারকেও প্রচলিত রাজনৈতিক ধারা ও সংস্কৃতির মুখোমুখি হতে হয়েছে, এবং হবেও। কারণ, বাংলাদেশের রাজনীতি এখনও এমন এক রূপ নিচ্ছে যার বাইরে গিয়ে রাষ্ট্র পরিচালনা সম্ভব নয়—অন্তত আগামী কয়েক দশক ধরে।

প্রধান উপদেষ্টা যেহেতু স্বীকার করেছেন, ‘দৃশ্যমান কোনো সংস্কার’ এখনো হয়নি, সেহেতু এটা বুঝতে হবে যে সংস্কার কোনো ম্যাজিক নয়। এটি একটি দীর্ঘমেয়াদি প্রক্রিয়া, যা রাজনৈতিক বাস্তবতার মধ্য দিয়েই সম্পন্ন হয়। সংস্কারকে কেবল ক্যারিশম্যাটিক নেতৃত্বের ওপর ছেড়ে দিলে তা টেকসই হয় না; বরং প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দিতে হয়।

Advertisement

সাম্প্রতিক সময়ে সেনাপ্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান আলোচনায় এসেছেন। কেউ তাঁকে “ত্রাতা” ভাবছেন, আবার কেউ অন্যকথা বলছেন। এর পেছনে রাজনৈতিক বিভাজনের ভূমিকা সুস্পষ্ট। বাস্তবতা হলো, তিনি একজন দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা, যিনি তার পদের মর্যাদা ও দেশের নিরাপত্তার প্রশ্নে কিছু গুরুত্বপূর্ণ বক্তব্য দিয়েছেন। বিশেষ করে নির্বাচনের প্রয়োজনীয়তা ও সময়সীমা নিয়ে তার স্পষ্ট অবস্থান অনেককে সাহস দিয়েছে, যারা মনে করতেন রাজনৈতিক সংকট থেকে উত্তরণের আর কোনো পথ নেই।

বাংলাদেশ বর্তমানে যে অনিশ্চয়তা ও অস্থিরতার মধ্যে রয়েছে, তা থেকে উত্তরণের জন্য প্রয়োজন বাস্তবভিত্তিক, রাজনৈতিক প্রজ্ঞাসম্পন্ন ও গণতান্ত্রিক সিদ্ধান্ত। ব্যক্তি নয়, প্রক্রিয়াই হোক মুখ্য। নেতৃত্ব নয়, প্রতিষ্ঠান হোক শক্তিশালী। সেনাপ্রধান, প্রধান উপদেষ্টা কিংবা অন্য কেউ—তারা সবাই যেন এক সুসংগঠিত ও গ্রহণযোগ্য প্রক্রিয়ার অংশ হন, সেটাই আজকের প্রধান প্রয়োজন।

বর্তমান সময়ের সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হচ্ছে—অবাধ, সুষ্ঠু ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন। পুলিশি হয়রানি, মবতন্ত্র, বুলডোজার নীতি কিংবা নারী নির্যাতনের মতো ঘটনা রাষ্ট্রের নৈতিক ভিত্তিকে দুর্বল করছে। এ থেকে উত্তরণের একমাত্র পথ একটি গ্রহণযোগ্য রাজনৈতিক প্রক্রিয়া।

ডিসেম্বরে জাতীয় নির্বাচন আয়োজনের যে কথা বলা হচ্ছে, তা বাস্তবসম্মত ও সময়োপযোগী। যদিও নির্বাচন সব সমস্যার সমাধান নয়, তবে এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ সূচনা হতে পারে—একটি গণতান্ত্রিক ধারাবাহিকতা, স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিমূলক শাসনের পথে। এটাই হতে পারে কাঙ্ক্ষিত সংস্কারের দিকে অগ্রসর হওয়ার প্রথম ধাপ ।

Advertisement

বাংলাদেশ বর্তমানে যে অনিশ্চয়তা ও অস্থিরতার মধ্যে রয়েছে, তা থেকে উত্তরণের জন্য প্রয়োজন বাস্তবভিত্তিক, রাজনৈতিক প্রজ্ঞাসম্পন্ন ও গণতান্ত্রিক সিদ্ধান্ত। ব্যক্তি নয়, প্রক্রিয়াই হোক মুখ্য। নেতৃত্ব নয়, প্রতিষ্ঠান হোক শক্তিশালী। সেনাপ্রধান, প্রধান উপদেষ্টা কিংবা অন্য কেউ—তারা সবাই যেন এক সুসংগঠিত ও গ্রহণযোগ্য প্রক্রিয়ার অংশ হন, সেটাই আজকের প্রধান প্রয়োজন। এই মুহূর্তে প্রস্তাবনা হতে পারে—সংলাপ, স্বচ্ছ পরিকল্পনা ও সময়মতো নির্বাচন। তবেই হয়ত ভবিষ্যতের পথে আমরা নিশ্চিতভাবে অগ্রসর হতে পারবো ।

লেখক : ব্রিটেনপ্রবাসী কলামিস্ট।

এইচআর/জিকেএস