দেশজুড়ে

মাথা গোঁজার ঠাঁইয়ের কাছে তুচ্ছ প্রাণের মায়া

মাথা গোঁজার ঠাঁইয়ের কাছে তুচ্ছ প্রাণের মায়া

জলবায়ু পরিবর্তন, অবাধে প্রাকৃতিক বন উজাড়, পরিবেশের জন্য ক্ষতিকারক বনায়ন ও যত্রতত্র পাহাড় কাটার ফলে দিন দিন পাহাড়ধসের ঝুঁকির মুখে ধাবিত হচ্ছে পার্বত্য অঞ্চল। আগামী বর্ষায় বৃষ্টিপাত বেশি হলে ঝুঁকিতে থাকবে পাহাড়ি এলাকাগুলো। এমন অবস্থায় পাহাড়ের মাটি, গাছ কাটা ও অবৈধ বসতি নির্মাণ বন্ধ না হলে আগামীতে আরও ভয়াবহ ভূমিধসের আশঙ্কা রয়েছে। তবে এসব ঝুঁকির তোয়াক্কা না করেই জীবননাশের শঙ্কা নিয়ে পাহাড়ের পাদদেশে বসবাস করছে রাঙ্গামাটির কয়েক হাজার পরিবার।

Advertisement

পার্বত্য এলাকায় ষাটের দশকে কর্ণফুলী পানি বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের পর থেকে শুরু হয় পাহাড়ে বসতি স্থাপন। ফলে কাটা হচ্ছে পাহাড়ের মাটি ও গাছ। এসব কারণে বৃষ্টির পরিমাণ বেশি হলেই ধসে পড়ছে পাহাড়। প্রায় এক দশক ধরে বৃষ্টিপাতে পার্বত্য এলাকায় পাহাড়ধস বেড়েছে। বাড়ছে মৃত্যুর মিছিল। তবে সবচেয়ে বেশি প্রাণ গেছে ২০১৭ সালের পাহাড় ধসে। এতে মারা গেছে ১২০ জন। এরপর ২০১৮ সালে মারা যায় ১১ জন। দিন যত যাচ্ছে পাহাড়ি এলাকায় ঝুঁকির পরিমাণ তত বাড়ছে। সামনে আরও বাড়বে বলেও আশঙ্কা করা হচ্ছে।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, পাহাড় কাটার পেছনে শুধু দখলদাররাই দায়ী নয়, বিভিন্ন উন্নয়ন কাজে নিয়ম না মেনে সরকারিভাবেও পাহাড় কাটা হয়। বাণিজ্যিক কারণে নির্বিচারে কাটা হয় গাছ। ফলে প্রাকৃতিকভাবে ধস প্রতিরোধের সক্ষমতা হারিয়ে ফেলছে পাহাড়। পাহাড়ধস ঠেকাতে নির্বিচারে পাহাড় কাটা বন্ধ এবং ধসের আশঙ্কা রয়েছে এমন পাহাড় এবং পাহাড়ের পাদদেশ থেকে বসবাসকারীদের সরিয়ে নেওয়া জরুরি বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।

তথ্যমতে, রাঙ্গামাটি শহরের শিমুলতলী, রূপনগর, পুরাতন পুলিশ লাইনস, যুব উন্নয়ন এলাকা, রাঙ্গাপানি এলাকা অধিক ঝুঁকিপূর্ণ। এসব ঝুঁকিপূর্ণ এলাকায় প্রায় পাঁচ হাজার পরিবারের ২০ হাজার মানুষ বসবাস করছে। এসব এলাকায়ই ২০১৭ সালের ১৩ জুন রাঙ্গামাটিতে ভয়াবহ পাহাড়ধসের ঘটনায় পাঁচ সেনাসদস্যসহ ১২০ জনের প্রাণহানি ঘটে। ওই বছর রাঙ্গামাটি-চট্টগ্রাম মহাসড়কের একটি অংশ ধসে সপ্তাহব্যাপী সড়ক যোগাযোগ বন্ধ হয়ে যায়।

Advertisement

আরও পড়ুন অল্প বৃষ্টিতেই সেই ১৬ পাহাড়ে ধস, বড় দুর্ঘটনার আশঙ্কা পাহাড় কাটা রোধে ডিসিদের কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়ার নির্দেশ পাহাড়ধসে বান্দরবান-রুমা ভারী যান চলাচল বন্ধ

২০১৮ সালের ১২ জুন জেলার নানিয়ারচর উপজেলায় পাহাড়ধসে মারা যান আরও ১১ জন। এর পরের বছর জেলার কাপ্তাইয়ে মারা যান আরও তিনজন। বর্ষা মৌসুমে বৃষ্টিপাত হলে রাঙ্গামাটিতে পাহাড়ধসের আশঙ্কা থেকেই যায়।

২০১৭ সালে পাহাড়ধসে চট্টগ্রাম-রাঙ্গামাটি সড়কের শালবন এলাকায় ১০০ মিটার রাস্তা ধসে গিয়ে একেবারে বিলীন হয়ে যায়। দেশের অন্যান্য স্থানের সঙ্গে রাঙ্গামাটির সড়ক যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন থাকে ৯ দিন। বিভিন্ন আন্তঃসড়কে ১৪৫টি স্থানে ভাঙন দেখা দেয়। পাহাড়ধসের বিপর্যয়ে রাঙ্গামাটি-চট্টগ্রাম সড়ক ছাড়াও যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায় রাঙ্গামাটি-খাগড়াছড়ি-বান্দরবান সড়ক, রাঙ্গামাটি-বড়ইছড়ি ও রাঙ্গামাটি-কাপ্তাই সড়ক।

ঝুঁকি জেনেও পাহাড়ের পাদদেশে বসবাস করেন রবিউল ইসলাম। তিনি জাগো নিউজকে বলেন, ‌‘পাহাড়ি এলাকায় থাকতে হলে সমতল ভূমি কোথায় পাবো? আমাদের তো অন্য কোনো জায়গা নেই। তাই নিরুপায় হয়ে এখানেই বসবাস করি। বেশি সমস্যা হলে তখন আশ্রয়কেন্দ্রে যেতে হবে।’ রাঙ্গামাটির পরিবেশবাদী সংগঠন গ্লোবাল ভিলেজের নির্বাহী পরিচালক ফজলে এলাহী বলেন, ২০১৭ সালের পাহাড়ধসের পর ভবিষ্যতে একই ধরনের ঘটনারোধে যেসব পরিকল্পনার গালগপ্প শোনানো হয়েছিল, তার কিছুই বাস্তবায়িত হয়নি। এখনো সামান্য বৃষ্টি হলে অপ্রস্তুত আশ্রয়কেন্দ্রে সরে যাওয়ার মাইকিং করা হয়ে। কিন্তু বসত নির্মাণ বন্ধ করা হয়নি। যারা আগে বসতি করেছেন, তাদেরও সরানো হয়নি। সুতরাং যা হবার তাই হয়তো হবে আবারও।’

আরও পড়ুন ধস আতঙ্কেও পাহাড় ছাড়ছেন না বাসিন্দারা পাহাড়ধসে প্রাণহানির পর ১৮ আশ্রয়কেন্দ্র খুললো জেলা প্রশাসন

সুশাসনের জন্য নাগরিকের (সুজন) জেলা কমিটির সাধারণ সম্পাদক এম জিসান বখতেয়ার বলেন, ‘ঝুঁকিপূর্ণ এলাকায় বসবাসরত মানুষদের নিরাপদ আবাসনের ব্যবস্থা করে দিতে আমরা বিভিন্ন সময় সভা-সমাবেশ করে আসছি। তবে এ বিষয়ে পৌরসভা, জেলা প্রশাসন, জেলা পরিষদ ও পার্বত্য মন্ত্রণালয়কে একযোগে কাজ করতে হবে। প্রয়োজনে একটি টাস্কফোর্স গঠন করে সমস্যার স্থায়ী সমাধান করতে হবে।’

Advertisement

পাহাড়ধসে প্রাণহানি রোধে সব প্রতিষ্ঠানকে পরিকল্পিতভাবে কাজ করার কথা বলেন রাঙ্গামাটি বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের বন ও পরিবেশবিজ্ঞান বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ড. সুপ্রিয় চাকমা।

তিনি জাগো নিউজকে বলেন, ‘আমাদের তো কোনো প্রতিষ্ঠানের মাস্টারপ্ল্যান নেই। বাজার, স্কুল, কলেজ ও হাসপাতাল সব তো শহরের মধ্যে তৈরি করা হয়েছে। ফলে শহরে মানুষের চাপ বাড়তে বাড়তে পাহাড়, ঝিরি, লেক সব জায়গায় আবাসন গড়ে উঠেছে। এসব তো দেখার কেউ নেই। শুধু বর্ষাকাল এলে মাইকিং করে সতর্ক করে সমাধান হবে না।’

সম্প্রতি রাঙ্গামাটি জেলা প্রশাসনের উদ্যোগে ঝুঁকিপূর্ণ এলাকাগুলোতে সচেতনতামূলক কার্যক্রম পরিচালনা করা হয়েছে। শহরের শিমুলতলি ও লোকনাথ মন্দির এলাকায় ঝুঁকিপূর্ণ স্থান পরিদর্শন করেন প্রশাসনের কর্মকর্তারা। পরিদর্শনকালে এলাকাবাসীর সঙ্গে কথা বলেন তারা।

এ বিষয়ে স্থানীয় সরকার বিভাগের উপপরিচালক মোবারক হোসেন জাগো নিউজকে বলেন, ভূমিক্ষয় পার্বত্য এলাকার পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্যের জন্য একটি বড় হুমকি। এ থেকে সৃষ্ট ভূমিধস মানুষের জানমালের জন্য চরম ঝুঁকিপূর্ণ। তাই সবাইকে এ বিষয়ে সচেতন হতে হবে। পাহাড় রক্ষা ও নিরাপদ বসবাস নিশ্চিত করতে সম্মিলিতভাবে কাজ করতে হবে।

এসআর/জিকেএস