আন্তর্জাতিক

এক শুক্রাণু দাতার জিনগত ত্রুটিতে ক্যানসারের ঝুঁকিতে ৬৭ শিশু

এক শুক্রাণু দাতার জিনগত ত্রুটিতে ক্যানসারের ঝুঁকিতে ৬৭ শিশু

ইউরোপীয় দেশগুলোতে ইন ভিট্রো ফার্টিলাইজেশন (আইভিএফ) পদ্ধতিতে গর্ভধারণ বেশ প্রচলিত। তাই এসব দেশে শুক্রাণু দান করাটাও স্বাভাবিক। তবে সম্প্রতি এই পদ্ধতিতে সন্তান জন্মদান কাল হয়ে দাঁড়িয়েছে ইউরোপের বিভিন্ন দেশের ৪৭টি পরিবারের জন্য। শুক্রাণু দাতার শরীরে বিরল জিনগত সমস্যার কারণে ক্যানসারের ঝুঁকিতে পড়েছে এসব পরিবারের ৬৭টি শিশু। এরই মধ্যে ১০ শিশুর শরীরে ক্যানসার ধরা পড়েছে।

Advertisement

ব্রিটিশ বার্তা সংস্থা দ্য গার্ডিয়ানের প্রতিবদনে বলা হয়েছে, ২০০৮ থেকে ২০১৫ সালের মধ্যে জন্ম নেওয়া এসব শিশুর মধ্যে কারও কারও শরীরে প্রাণঘাতী টিপি ৫৩ জিনের মিউটেশন শনাক্ত হয়, যা ‘লি-ফ্রাউমেনি সিনড্রোম’ নামে একটি মারাত্মক বংশগত ক্যান্সার-প্রবণতা সৃষ্টিকারী রোগের সঙ্গে সম্পর্কিত। এই মিউটেশনের কারণে জীবনের কোনো এক সময় ব্লাড ক্যানসারনহ বিভিন্ন ধরনের ক্যানসারে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি বেড়ে যায়।

ফ্রান্সের রুয়েন বিশ্ববিদ্যালয় হাসপাতালের জীববিজ্ঞানী ড. এডউইজ কাসপার ইউরোপিয়ান সোসাইটি অব হিউম্যান জেনেটিক্সের মিলান সম্মেলনে এই ঘটনা উপস্থাপন করে বলেন, একজন ডোনার দিয়ে পুরো ইউরোপজুড়ে এত শিশু জন্মগ্রহণ করা অস্বাভাবিক ও এতে জেনেটিক্যাল রোগ ছড়িয়ে পড়ার ঝুঁকি বেড়ে যায়।

তিনি আরও বলেন, এটা স্পষ্ট যে ইউরোপজুড়ে একটি সীমা নির্ধারণ করা প্রয়োজন। প্রত্যেক ডোনারের কাছ থেকে সর্বোচ্চ কতটি পরিবার সন্তান নিতে পারবে, তা নির্ধারণ করা দরকার।

Advertisement

এই ঘটনা প্রথমে প্রকাশ্যে আসে যখন দুটি আলাদা পরিবারের সন্তানের মধ্যে ক্যান্সার ধরা পড়ে। এর পরপরই তারা ফার্টিলিটি ক্লিনিকের সঙ্গে যোগাযোগ করে। এরপর জানা যায়, এই দুই শিশুর পিতৃসূত্রে পাওয়া শুক্রাণু একই দাতার ছিল ও সেই দাতার শুক্রাণুতেই ছিল টিপি৫৩ নামক বিরল মিউটেশনটি। এই শুক্রাণুগুলো সরবরাহ করেছিল ইউরোপিয়ান একটি স্পার্ম ব্যাংক।

পরবর্তী সময়ে ইউরোপের বিভিন্ন হাসপাতাল ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান একযোগে তদন্ত শুরু করে ও দেখা যায় এই শুক্রাণু দাতার কাছ থেকে ৮টি ইউরোপীয় দেশের ৪৬টি পরিবারের অন্তত ৬৭টি শিশুর জন্ম হয়েছে। তাদের মধ্যে ২৩ জনের শরীরে এই মিউটেশন পাওয়া গেছে ও ১০ জন এরই মধ্যে ক্যানসারে আক্রান্ত, তাদের মধ্যে কেউ লিউকেমিয়া, কেউবা নন-হজকিন লিম্ফোমায় ভুগছে।

এই মিউটেশনধারী শিশুদের জন্য নির্দিষ্ট পর্যবেক্ষণ প্রক্রিয়া সুপারিশ করা হয়েছে, যেমন- নিয়মিত তাদের পুরো শরীরের এমআরআই, মস্তিষ্কের এমআরআই ও পরবর্তী সময়ে প্রাপ্তবয়স্ক বয়সে স্তন ও পেটের আল্ট্রাসাউন্ড পরীক্ষা করাতে হবে।

উল্লেখযোগ্য বিষয় হলো, ২০০৮ সালে যখন এই শুক্রাণু সংগ্রহ করা হয়, তখন টিপি ৫৩ মিউটেশনটি ক্যান্সার-সম্পর্কিত বলে চিহ্নিত হয়নি ও প্রচলিত স্ক্রিনিং পদ্ধতিতে এই ধরনের মিউটেশন শনাক্ত করাও সম্ভব ছিল না। তবে বর্তমানে এটি লি-ফ্রাউমেনি সিনড্রোমের সঙ্গে জড়িত বলে প্রমাণিত হয়েছে।

Advertisement

ড. কাসপার বলেন, আমি বিভিন্ন ডেটাবেস, কম্পিউটার অ্যালগরিদম ও ফাংশনাল ট্রায়ালের মাধ্যমে মিউটেশনটি বিশ্লেষণ করি ও নিশ্চিত হই যে এটি ক্যানসার সৃষ্টির জন্য দায়ী। আমার মতে এই দাতার শুক্রাণু থেকে জন্ম নেওয়া শিশুদের জেনেটিক কাউন্সেলিং দেওয়া উচিত।

ইউরোপিয়ান স্পার্ম ব্যাংক জানিয়েছে, তারা বিশ্বব্যাপী প্রতিটি ডোনারের জন্য সর্বোচ্চ ৭৫টি পরিবারের মধ্যে ব্যবহারের সীমা নির্ধারণ করেছে। তবে তারা স্বীকার করেছে, এই ডোনার থেকে ৬৭ জনেরও বেশি শিশুর জন্ম হয়েছে, তবে সঠিক সংখ্যা প্রকাশ করা তাদের নীতিমালার বাইরে।

কাসপার বলেন, এই সংখ্যা ৬৭ তেই সীমাবদ্ধ কি না, সেটাই এখন প্রশ্ন। আমি এই বিষয়ে স্পার্ম ব্যাংকের কাছে জানতে চেয়েছি, কিন্তু তারা ওই দাতার মোট ব্যবহারের সংখ্যা জানাতে নারাজ।

যুক্তরাজ্যের ডি মন্টফোর্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক নিকি হাডসন বলেন, যখন মানুষের শুক্রাণু এক দেশ থেকে আরেক দেশে পাঠানো হয় ও বহু পরিবারের মধ্যে ব্যবহৃত হয়, তখন জটিল সব পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়। এই ঘটনাটি সে ধরনের চ্যালেঞ্জগুলোর একটি শক্তিশালী উদাহরণ।

তিনি আরও বলেন, যদি এই দাতার শুক্রাণু কেবল এক দেশের মধ্যেই ব্যবহৃত হতো, তাহলে আক্রান্ত শিশুর সংখ্যা অনেক কম হতে পারতো। এছাড়া, এতোগুলো পরিবারকে ট্র্যাক করা ও সতর্ক করা একটি বিরাট চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়ায়।

ইউরোপিয়ান স্পার্ম ব্যাংকের মুখপাত্র জুলি পাউলি বুদৎস বলেন, আমরা এই ঘটনায় অত্যন্ত ব্যথিত। দাতাকে যথাযথভাবে পরীক্ষা করা হয়েছিল, কিন্তু যদি আগে থেকে না জানা থাকে কী খোঁজা হচ্ছে, তাহলে সব মিউটেশন শনাক্ত করা সম্ভব নয়।

তিনি আরও বলেন, আমরা আন্তর্জাতিকভাবে পরিবার সীমা নির্ধারণের আলোচনাকে স্বাগত জানাই ও বারবার এর পক্ষে সমর্থন জানিয়েছি। এই কারণেই আমরা স্বতঃস্ফূর্তভাবে সর্বোচ্চ ৭৫টি পরিবারের সীমা নির্ধারণ করেছি।

দ্য গার্ডিয়ান বলছে, এই ঘটনা সামগ্রিকভাবে আন্তর্জাতিকভাবে স্পার্ম ডোনেশনের ব্যবস্থাপনায় আরও কঠোর নিয়ম ও সমন্বয় প্রয়োজনের বিষয়টি সামনে এনেছে। এর ফলে ভবিষ্যতে এমন স্বাস্থ্যঝুঁকি ও সামাজিক জটিলতা এড়ানো সম্ভব হবে।

সূত্র: দ্য গার্ডিয়ান

এসএএইচ