রংপুরের ঐতিহ্যবাহী দর্শনা ঘাঘটপাড়ার শুঁটকি আড়ত এখন অস্তিত্ব সংকটে। ৪৫ বছরেরও বেশি সময় ধরে চলে আসা এ পাইকারি আড়তে একসময় প্রতিদিন ১৫ থেকে ২০ লাখ টাকার শুঁটকি বিক্রি হলেও এখন লেনদেন নেমে এসেছে মাত্র তিন-পাঁচ লাখ টাকায়। ক্রেতার অভাব, ধারদেনার বোঝা ও ব্যাংক ঋণের অপ্রাপ্তিতে ধুঁকছে শুঁটকি ব্যবসা। অনেকেই ব্যবসা গুটিয়ে নিচ্ছেন, বদলাচ্ছেন পেশা। কর্মসংস্থানের বড় মাধ্যম হিসেবে পরিচিত একসময়ের রমরমা এই হাঁট এখন টিকে থাকার লড়াই করছে।
Advertisement
ব্যবসায়ীরা বলছেন, সহজ শর্তে ব্যাংক ঋণ ও সরকারি সহায়তা ছাড়া এই ঐতিহ্য টিকিয়ে রাখা অসম্ভব হয়ে পড়েছে।
শুঁটকি আড়ত সূত্রে জানা গেছে, ১৯৮০ সালে প্রায় দেড় একর জমিতে আড়তটি গড়ে ওঠে। শুরুর দিকে আড়তে প্রায় ৫০ জন ব্যবসায়ী থাকলেও এখন ব্যবসায়ী রয়েছেন মাত্র ১৬ জন। বাকিতে শুঁটকি মাছ বিক্রির টাকা তুলতে না পারায় পুঁজি হারিয়ে অনেক ব্যবসায়ী পথে বসেছেন।
শুঁটকি ব্যবসায়ীরা সুযোগ সুবিধা পেলে তাদের ভাগ্য বদলাতে পারবে। তবে সেজন্য দরকার ব্যাংক ঋণের সুযোগ-সুবিধা।
Advertisement
সূত্র আরও জানায়, শুঁটকির মৌসুম হিসেবে পরিচিত পৌষ ও অগ্রহায়ণ মাস। এসময় শুঁটকির চাহিদা সবচেয়ে বেশি থাকে। সামুদ্রিক শুঁটকির বৃহৎ অংশ আসে চট্টগ্রাম, খুলনা, পটুয়াখালী, বরিশাল ও রাজশাহীর চলন বিলসহ দেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে। ভারতীয় (এলসি) শুঁটকি মাছ সরাসরি না এলেও নীলফামারী জেলার সৈয়দপুর শুঁটকি আড়ত হয়ে রংপুরের আড়তে প্রবেশ করে।
এছাড়াও মায়ানমার, সংযুক্ত আরব আমিরাত ও পাকিস্তানের শুঁটকিও পাওয়া যায় দর্শনার এই আড়তে। তবে এসব শুঁটকিতে ট্যাক্সের পরিমাণ বেশি থাকায় মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছেন অনেক ক্রেতা।
জানা যায়, পুরো শুঁটকি আড়তে ৩০ থেকে ৫০ প্রকারের শুঁটকি পাওয়া যাচ্ছে। পছন্দের শুঁটকি খুচরা ও পাইকারি দামে কিনতে বিভিন্ন জায়গা থেকে আসা মানুষ ভিড় করেন দর্শনার এই শুঁটকি আড়তে।
আরও পড়ুন:আদালতে হাজিরা দিয়েই জীবন পার বাদী-বিবাদীর আলু এখন কৃষকের গলার কাঁটাসরজমিনে দেখা যায়, আড়তে সামুদ্রিক শুঁটকি মাছের মধ্যে ফেসা, কইড়া, লটকি, বালিয়া, মিতি চকলেট, কাচকি, পাতা, চেলা অন্যতম। মাছের আকার ও সংরক্ষণের প্রকারভেদে একই মাছের শুঁটকির দামের মধ্যে বেশ তারতম্য দেখা যায়। কেজিপ্রতি চেলা ৪০০-৭৫০ টাকা, কাচকি ৩২০-৫০০, ফেসা ৫০০-৭০০, ধঞ্চা ২০০-২৫০, লটকি ৫০০-১০০০, মিতি চকলেট ২০০-৪০০, বালিয়া ২০০-৩৫০ টাকা ও এলসি মাছের শুঁটকি ১৬০-১০০০ টাকায় বিক্রি হয়।
Advertisement
ব্যবসায়ীদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, পাইকারি শুঁটকি ব্যবসায়ীরা খুচরা ব্যবসায়ীদের কাছে বাকিতে শুঁটকি মাছ বিক্রি করায় সময়মতো পাওনা টাকা উত্তোলন করতে না পেরে অনেক ব্যবসায়ী ঋণগ্রস্ত হয়ে পড়ছেন। এতে তারা তাদের বাপ-দাদার পেশা বদলাতে বাধ্য হচ্ছেন। শুঁটকি ব্যবসায়ীদের স্বার্থ সংরক্ষণের জন্য গঠিত কমিটির কোনো কার্যক্রম না থাকায় প্রতিনিয়ত সাধারণ শুঁটকি ব্যবসায়ীরা ভোগান্তিতে পড়ছেন। ফলে দর্শনার মোড়ে গড়ে ওঠা সম্ভাবনাময়ী শুঁটকির আড়ত রংপুর এলাকায় কর্মসংস্থান সৃষ্টিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতেও ব্যর্থ হচ্ছে।
৩৮ বছর ধরে শুঁটকি ব্যবসা করেন গনেশ দাশ। তিনি জাগো নিউজকে বলেন, এখানে একসময় অনেক শুঁটকি ব্যবসায়ী ছিলেন। যত দিন যাচ্ছে ব্যবসা গুটিয়ে চলে যাচ্ছেন। আমাদের পাশের দোকানের শুঁটকি ব্যবসায়ীর কাছে তার মহাজন অনেক টাকা পেতেন। শেষে তিনি জায়গা বিক্রি করে ঋণ পরিশোধ করে এখান থেকে ব্যবসা গুটিয়ে চলে গেছেন।
আরেক শুঁটকি ব্যবসায়ী মনজুর আলম জাগো নিউজকে বলেন, দীর্ঘ ১৬ বছর ধরে শুঁটকি মাছের ব্যবসার সঙ্গে জড়িত আছি। আগে ব্যবসা ভালোই চলতো, এখন মন্দায় দিন কাটাচ্ছি। শাক-সবজি বিশেষ করে আলু আগে ৭০ টাকা কেজি থাকায় তখন শুঁটকির চাহিদা বেশি ছিল। এখন আলু ও অন্যান্য সবজির দাম কম থাকায় মানুষ শুঁটকি কম কিনছে।
তিনি আরও বলেন, আগে মৌসুমের সময় প্রতিদিন এক লাখ থেকে দেড় লাখ টাকার শুঁটকি মাছ বিক্রি করতাম। বর্তমানে আমি ৬০ হাজার থেকে ৭০ হাজার টাকার শুঁটকি বিক্রি করছি। আমার দোকানে ৪ জন শ্রমিক আছে। মাসে জনপ্রতি ১০ থেকে ১২ হাজার টাকা মজুরি দেওয়া লাগে। ব্যাংকে আমরা সহজে লোন পাই না। ব্যাংকগুলো যদি সহজ শর্তে ঋণ দেওয়ার ব্যবস্থা করতো তাহলে আড়তে ব্যবসায়ীর সংখ্যার বৃদ্ধির পাশাপাশি ব্যাপক কর্মসংস্থান সৃষ্টি হতো।
আরও পড়ুন:অর্ধেকে নেমেছে পদ্মার আয়তন, শুকিয়ে যাচ্ছে শাখা নদীও সর্বনাশা ফারাক্কায় অভিশাপে রূপ নিচ্ছে আশীর্বাদের পদ্মাশুঁটকিতে রাসায়নিক দ্রব্য ব্যবহার করা হয় কি-না বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, এটা আমদানিকারকরা ভালো বলতে পারবেন। দেশি শুঁটকিতে কোনো রাসায়নিক দ্রব্য দেওয়া হয় না। ব্যবসা বাঁচিয়ে রাখতে ব্যাংক থেকে ঋণ প্রয়োজন। এ ঐতিহ্যবাহী ব্যবসা টিকিয়ে রাখতে হলে আমাদের দিকে সরকারের নজর দেওয়া উচিত। ব্যাংকগুলো থেকে আমাদের মতো ছোট ব্যবসায়ীদের স্বল্প সুদে ঋণ দিলে ব্যবসাকে টিকিয়ে রাখতে পারবো।
পাবনা থেকে এসে নব্বইয়ের দশকে রংপুরে শুঁটকি পেশার সঙ্গে জড়িত লুৎফর রহমান জাগো নিউজকে বলেন, দিনদিন শুঁটকি ব্যবসার ঐতিহ্য হারিয়ে যাচ্ছে। আগে এক লাখের উপরে শুঁটকি বিক্রি করতাম এখন পঞ্চাশ থেকে সত্তর হাজার বিক্রি করি। আমার দোকানে দুই জন শ্রমিক রেখেছি। তাদের প্রতিদিন জনপ্রতি ৪৫০ টাকা থেকে ৫৫০ টাকা বেতন দিতে হয়। অনেক ঋণের মধ্যে আছি। আমাদের যদি সিসি লোন দিতো তাহলে ব্যবসায় টিকে থাকতাম। উপায় না পেয়ে বাধ্য হয়েই সাধারণ লোনের ওপর টিকে আছি। সাধারণ লোনে সুদের হার বেশি হওয়ায় নাজেহাল অবস্থায় আছি, উন্নতি নেই।
সরকারকে উদ্দেশ্য করে তিনি বলেন, আমাদের দাবি সিসি লোন যেন আমরা পাই সে ব্যবস্থা করে দেওয়া হোক। সরকার শুঁটকির ওপর যে ট্যাক্স আরোপ করেছে সেটা কমালে আমাদের জন্য ব্যবসায় টিকে থাকা সহজ হতো।
রংপুর চেম্বার কব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির প্রেসিডেন্ট আকবর আলী জাগো নিউজকে বলেন, সহজ শর্তে ঋণ পেলে ব্যবসায়ীরা উপকৃত হবেন। ঐতিহ্যবাহী শুঁটকি আড়তের ব্যবসায়ীদের টিকিয়ে রাখতে সরকারিভাবে উদ্যোগ গ্রহণের দাবি জানাচ্ছি।
জেডআইকে/এমএন/জেআইএম