সাহিত্য

নজরুলের প্রেম নজরুলের দ্রোহ

নজরুলের প্রেম নজরুলের দ্রোহ

ছোটবেলার কথা। প্রায় রাতে আমার বাবা বিভিন্ন কবিতা শুনিয়ে আমাকে ঘুম পাড়াতেন। ঘুরেফিরে নির্দিষ্ট কয়েকটি কবিতা পড়তেন। তবে একটি কবিতা ছিল কমন—কাঠবিড়ালি কাঠবিড়ালি পেয়ারা তুমি খাও...। খালার বাড়ির মাটির ঘরের দেওয়ালে ঝুলতে দেখতাম সুঁই-সুতার কারুকাজে বানানো কিছু ফ্রেম। যখন পড়তে শিখলাম—একটা ফ্রেমে আবিষ্কার করলাম— ‘দুর্গম গিরি কান্তার-মরু দুস্তর পারাবার হেলঙ্ঘিতে হবে রাত্রি নিশীথে যাত্রীরা হুঁশিয়ার!দুলিতেছে তরী, ফুলিতেছে জল, ভুলিতেছে মাঝি পথছিঁড়িয়াছে পাল, কে ধরিবে হাল, আছে কার হিম্মত?’কে লিখেছেন এই কবিতা? এই প্রথম জানলাম কাজী নজরুল ইসলামের নাম। জানলাম তিনি বিদ্রোহী কবি। সেই থেকে নজরুলকে চেনা। তাকে বোঝার চেষ্টা করা। সেই চেষ্টা চলছে এখনো আমার অবিরাম।

Advertisement

নজরুল তখন জেলে। জেলে বসেই খবর পেলেন রবীন্দ্রনাথ তার গীতনাট্য ‘বসন্ত’ উৎসর্গ করলেন নজরুলকে। আর সেই আনন্দে জেলে বসেই বিদ্রোহী কবি লিখলেন—আজ সৃষ্টি সুখের উল্লাসে। কলকাতায় বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদের সভা। রবীন্দ্রনাথ তখন ৬০। নজরুল ২২। নজরুল মঞ্চে উঠে রবীন্দ্রনাথকে প্রণাম করে নেমে যাচ্ছেন। জলদগম্ভীর কণ্ঠে কবিগুরু বললেন—না, নজরুল তুমি নিচে নয়, তুমি এই সভায় আমার পাশেই বসবে। বিশ্বকবির পাশে ২২ বছরের বিদ্রোহী কবি। সম্পর্কের কী গভীর নৈকট্য! নজরুল ধূমকেতু পত্রিকা সম্পাদনা করতেন। অর্ধসাপ্তাহিক এই পত্রিকার জন্য আশীর্বাদ বাণী লিখেছিলেন রবীন্দ্রনাথ।

আলাপ করা যেতে পারে ঔপন্যাসিক নজরুল নিয়ে। তিনটি উপন্যাস লিখেছিলেন তিনি। তবে মাত্র তিনটি উপন্যাসেই বাংলা গদ্য সাহিত্যকে তিনি দিয়েছিলেন নতুন দিশা। ‘বাঁধন হারা’ কাজী নজরুল ইসলামের প্রথম উপন্যাস। তিনি যখন করাচিতে থাকতেন; তখন এই উপন্যাস রচনায় মনোনিবেশ করেন। এটি মূলত একটি পত্রোপন্যাস। বাঁধন হারার প্রথম কিস্তি মোসলেম ভারত পত্রিকায় এবং ১৯২১ সালে (১৩২৭ বঙ্গাব্দ) ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হয়। এরপর ১৯২৭ সালের জুন মাসে (শ্রাবণ, ১৩৩৪ বঙ্গাব্দ) এটি প্রথম গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হয়।

বাঁধন হারা উপন্যাসটি বাংলা সাহিত্যের প্রথম পত্রোপন্যাস। উপন্যাসের চরিত্র সংখ্যা মোট দশটি। একটি চরিত্র আরেকটির সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে সম্পৃক্ত। নুরু ও মাহবুবা একে অন্যকে পছন্দ করে এবং বিয়ের তোড়জোড়ের মাধ্যমে কাহিনির সূচনা। এই সময়ে নুরু বাড়ি থেকে পালিয়ে গিয়ে সেনাবাহিনীতে যোগ দেয়। এ উপন্যাসের আরও চরিত্র মাহবুবা, রাবেয়া ও সাহসিকা বাল্যসখী। তাদের মধ্যে পত্র যোগাযোগ হয়। সাহসিকা তার নামের মতই সাহসী ও প্রতিবাদী। চিরকুমারী সাহসিকা নারীদের ওপর অন্যায় ও অত্যাচারের প্রতিবাদ করে। মাহবুবা নুরুল হুদাকে প্রচণ্ড ভালোবাসে। কিন্তু নুরুল হুদা কোনো বাঁধনে জড়াতে চায় না। অবশেষে মাহবুবার বিয়ে হয়ে যায় চল্লিশোর্ধ্ব এক জমিদারের সঙ্গে। কিছুদিন বাদেই মাহবুবা বিধবা হয়ে যায়। নুরুল হুদাকে সে লেখে যে, সে মক্কা ও মদিনায় তীর্থ ভ্রমণে যাবে এবং নুরুল হুদার কর্মস্থল বাগদাদেও যেতে পারে। নুরুল হুদা মাহবুবাকে নিষেধ করে না। তাদের দুজনের দেখা হওয়ার সম্ভাবনার মাধ্যমে শেষ হয় উপন্যাসটি।

Advertisement

‘মৃত্যুক্ষুধা’ কাজী নজরুল ইসলামের দ্বিতীয় উপন্যাস। দারিদ্র্য, ক্ষুধা, দুর্ভিক্ষের পরিপ্রেক্ষিতে সপরিবারে মেজবউয়ের খ্রিষ্টধর্ম গ্রহণ এ উপন্যাসকে অন্যমাত্রায় নিয়ে গেছে! অন্যদিকে রুবি আনসারকে ভালোবাসলেও তার বাবা তাকে বিয়ে দেয় আইসিএস পরীক্ষার্থী মোয়াজ্জেমের সঙ্গে। অতঃপর মোয়াজ্জেমের মৃত্যু এবং রুবির জীবনের দুর্বিষহ চিত্র তথা নারী জীবনের বাস্তব চিত্র নিপুণভাবে তুলে ধরেছেন এ উপন্যাসে।

তৃতীয় উপন্যাস ‘কুহেলিকা’। এ উপন্যাসের মধ্য দিয়ে নজরুলের রাজনৈতিক আদর্শ ও মতবাদ প্রতিফলিত হয়েছে। উপন্যাসের নায়ক জাহাঙ্গীর বিপ্লবী স্বদেশি দলের সঙ্গে যুক্ত। সবমিলিয়ে রাজনীতি, মতবাদ ও আদর্শের এক কাণ্ডারি কুহেলিকা উপন্যাসটি।

আরও পড়ুন

কাজী নজরুল ইসলামের তিনটি উপন্যাস কাজী নজরুল ইসলামের প্রবন্ধে শিক্ষাভাবনা

নজরুল তার একজীবনে বারবার প্রেমে পড়েছেন। ১৯২১ সালে কোনো একসময় বন্ধু আলী আকবর খানের নিমন্ত্রণে নজরুল এলেন কুমিল্লার দৌলতপুরে। সেখানে এক বিয়ের অনুষ্ঠানে দেখা হলো রূপবতী সৈয়দা খাতুনের সঙ্গে। কবি প্রেমে পড়ে গেলেন সৈয়দা খাতুনের। সৈয়দা খাতুনও সাড়া দিলেন। প্রেমিক কবি সৈয়দা খাতুনের নাম রাখলেন নার্গিস। দৌলতপুরে থাকা অবস্থায়ই নার্গিসকে বিয়ের সিদ্ধান্ত নিলেন নজরুল। বিয়েও হলো কিন্তু বাসর রাতেই কবি রহস্যময় কারণে চলে আসেন দৌলতপুর থেকে।

Advertisement

১৯২৪ সালের এপ্রিল মাসে নজরুল বিয়ে করেন প্রমীলা সেন গুপ্তাকে। প্রমীলাকে কবি দোলন ও দুলি নামে ডাকতেন। তাঁদের এ বিয়েতে বাধা হয়ে দাঁড়ায় ধর্ম। আইনের বাধাবিঘ্ন পেরিয়ে শেষে নিজ নিজ ধর্মীয় পরিচয় বহাল রেখেই তাঁদের বিয়ে সম্পন্ন হয়।

১৯২৮ সালের ফেব্রুয়ারি মাস। নজরুল এসেছেন ঢাকায় মুসলিম সাহিত্য সমাজের দ্বিতীয় বার্ষিক সম্মেলনে যোগ দিতে। সেখানে পরিচয় হয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম স্নাতকোত্তর মুসলমান ছাত্রী ফজিলাতুন্নেছার সঙ্গে। কবি প্রেমে পড়লেন। বন্ধু কাজী মোতাহার হোসেনের মাধ্যমে কবি ফজিলাতুন্নেছাকে অনেকগুলো প্রেমপত্র লিখলেন। কিন্তু কোনো সাড়া পাননি কবি। এ প্রেম ছিল তাঁর একতরফা। নজরুলের আরেক প্রেমিকার নাম রানু সোম। তিনি নজরুলের গান শিখতেন সংগীতজ্ঞ দিলীপ কুমার রায়ের কাছে। তাঁর কাছেই নজরুল রানু সোম সম্পর্কে জানতে পারেন। কবি নিজেই ঠিকানা জোগাড় করে রানু সোমের সঙ্গে যোগাযোগ করেন। শুরু হয় গান শেখানো। গান শেখানোর অজুহাতে রানুদের বাসায় ছিল কবির অবাধ যাতায়াত। কিন্তু পাড়ার ছেলেদের তা সহ্য হয়নি। একদিন বাসা থেকে বের হওয়ার পর তারা কবিকে আক্রমণ করেন। কবিও পাল্টা আক্রমণ করেন। বিষয়টি থানা-পুলিশ পর্যন্ত গড়ায়। এই রানু সোম পরে বুদ্ধদেব বসুকে বিয়ে করে প্রতিভা বসু নামে খ্যাতি লাভ করেন।

শিল্পী কানন দেবীকে নজরুল গান শেখাতেন। দেরী হয়ে গেলে অনেকদিন রাতে কবি থেকে যেতেন কানন দেবীর বাড়িতে। ত্রিশালের স্কুলশিক্ষক খিদির পণ্ডিত। তাঁর শ্বশুরবাড়ি দরিরামপুর। সেখানে নজরুল খিদির পণ্ডিতের সঙ্গে বেড়াতে যেতেন। পণ্ডিতের শ্যালিকা নূরজাহানের রূপে মুগ্ধ হয়ে কবি তাঁরও প্রেমে পড়েন। নজরুল নারীদের ভীষণ সম্মান করতেন। মনে পড়ে নজরুলের সেই বিখ্যাত পঙ্ক্তি—বিশ্বে যা কিছু মহান সৃষ্টি চির কল্যাণকর, অর্ধেক তার করিয়াছে নারী। অর্ধেক তার নর।

১৯৪২ সালের ৯ জুলাই। কলকাতা বেতারকেন্দ্রে রেকর্ডিং চলাকালীন হঠাৎ কাজী নজরুল অসুস্থ হয়ে পড়েন। তার জিভ আড়ষ্ট হয়ে জড়িয়ে গেলো। তারপর ধীরে ধীরে থেমে গেলো বিদ্রোহী কণ্ঠ। ৭৭ বছর বেঁচে ছিলেন নজরুল। এরমধ্যে ৩৪ বছর এক মাস বিশ দিন ছিলেন নির্বাক। মন-মগজে স্তব্ধ না হলে কবি বাংলা সাহিত্যে দিতে পারতেন আরও অনেক অমিয় সুধা।

৪২ বছরের সুস্থ জীবনে তিনি যতটা দিয়েছেন, তার কতটাইবা আমরা ধারণ করতে পারছি! নজরুলের প্রেম নজরুলের দ্রোহ নজরুলের অসাম্প্রদায়িক চেতনা নজরুলের মানবিকতা—মন-মগজে ধারণ করে এগিয়ে যাক আগামীর পৃথিবী। শুভ জন্মদিন বিদ্রোহী কবি।

এসইউ/এমএস