মতামত

জাগো নারী জাগো বহ্নিশিখা

জাগো নারী জাগো বহ্নিশিখা

ইস্টওয়েস্ট ইউনিভার্সিটিতে পরীক্ষা নেওয়া শেষে গুনগুন করতে করতে নিচে নামি। কাজের মধ্যে বা কাজের বাইরে ফাঁক পেলে গুনগুন গান করা আমার বহুদিনের অভ্যাস। এতে আজেবাজে চিন্তা থেকে মুক্ত থাকা যায় বলে অন্তত আমার ধারণা। অবশ্য, একসময় অনেকের মতো আমিও ঘন ঘন পান, সিগারেট আর চা খেয়ে দুশ্চিন্তা তাড়াতাম। ডাক্তারের কল্যাণে সব বাদ দিয়ে এখন সুযোগ পেলেই হেরে গলায় গান ধরি। সামথিং ইজ ব্যাটার দ্যান নাথিং– নাই মামার চেয়ে কানা মামা অনেক ভালো।

Advertisement

গানটা ছিল সত্তরের দশকের পপ সঙ্গীত শিল্পী ফেরদৌস ওয়াহিদের গাওয়া সুপার হিট গান- ‘আগে যদি জানতাম, তবে মন ফিরে চাইতাম/ এই জ্বালা আর প্রাণে সহেনা ...।’ এই গানটির গীতিকার ছিলেন আমার এক বছরের সিনিয়র, অত্যন্ত কাছের বন্ধু নুরুল হুদা। অকাল প্রয়াত আমার এই বন্ধুটি ছিলেন একজন অনলবর্ষী বক্তা এবং মতলব উত্তর থেকে নির্বাচিত এমপি; একসময় প্রতিমন্ত্রীও ছিলেন। জীবনে গীতিকার হওয়ার প্রচণ্ড আগ্রহ থাকলেও, আমার জানামতে, মাত্র দুটো গান লিখে তিনি আর গান লেখেননি। একই শিল্পীর কণ্ঠে তার অন্য সুপারহিট গান, ‘সব আগুন যায় নেভানো, হায় আগুন লাগলে মনে, সে আগুন নেভেনা নেভেনা ...’ শুনলে এই বুড়ো বয়সেও প্রেম হানা দিতে চায়।

দুই.উবারের গাড়ির জন্য আমার জিটিএ রায়হানকে নিয়ে অপেক্ষা করছি। কল কনফার্ম করতেই এক নারীর কণ্ঠে হকচকিয়ে যাই। এই ঢাকা শহরে নারীদের গাড়ি চালানোর দৃশ্য নতুন কিছু নয়; খুব স্বল্প সংখ্যক নারী, স্বীয় কাজে এবং সম্ভবত, শখেরবশে গাড়ি চালিয়ে থাকেন। মনে মনে ভাবি, নিশ্চয় আগন্তুক নারী ড্রাইভারটির পেশা ড্রাইভিং, যা তার পরিবারের জীবন-জীবিকা ও উপার্জনের একমাত্র উৎস। আজকাল বিভিন্ন এনজিও কিংবা করপোরেট সেক্টরে নারী ড্রাইভার নিয়োগ পায় জানতাম কিন্তু উবারের মতো এমন বাণিজ্যিক ভিত্তিতে কোনো নারী গাড়ি চালায় সে কথা এর আগে কখনো শুনেছি বলে মনে পড়ে না।

এ নিয়ে ভাবনার ডালপালা গজাবার আগেই ইস্টওয়েস্টের মূল ফটকের সামনে গাড়িটি এসে থামলো। দেখি চশমা চোখে, খোলা চুলে ড্রাইভিং সিটে এক ষোড়শী স্টিয়ারিংয়ে হাত রেখে স্মিত হাস্যে আমার অপেক্ষায়। আমাকে তুলে গাড়ি স্টার্ট দিয়েই মিউজিক প্লেয়ারে আকাশ ভাঙা শব্দে একটা পপ গান ছেড়ে দিলেন। সাধারণত গাড়িতে গান ছাড়ার আগে যাত্রীর অনুমতি নিতে হয় কিংবা যাত্রীর কাছ থেকে অনুরোধ আসে গানের জন্য। এক্ষেত্রে ব্যতিক্রম দেখে একটু অবাক হলাম। আমি গান থামাতে অনুরোধ করে একটা বিরক্তি ভাব নিয়ে জিজ্ঞেস করি-‘কত বছর ধরে গাড়ি চালান, আপা?’ ‘ছিঃ ছিঃ। আমাকে ‘আপনি’ বলছেন কেন, কেনই বা আমাকে ‘আপা’ বলে ডাকছেন। আমি তো বয়সে আপনার থেকে অনেক অনেক ছোট। প্লিজ আমাকে তুমি করে বলবেন।’

Advertisement

নারীদের কাছ থেকে এই ধরনের প্রতিক্রিয়া অন্তত আমার কাছে নতুন কিছু নয়। দু-তিন বছরের ছোট হবেন হয়তো এমন কাউকে ‘আপা’ সম্বোধন মাত্রই নাকি সুরে বলতে শুনি, ‘প্লিজ আঙ্কেল, আমাকে তুমি বলবেন; আমি না আপনার থেকে বয়সে অনেক ছোট।’ ভাবসাব দেখে মনে হয় পারত আপা বা খালা হতে চায় না কেউই; যেন দুনিয়ার সব আপা এবং খালা বয়সের ভারে ন্যুব্জ থাকে; খুকি আপা, খুকি খালাও যে থাকতে পারে তা বেমালুম ভুলে যায় তারা।

যাই হোক, আমাদের গাড়ি এগিয়ে চলে বসুন্ধরা আবাসিক এলাকার দিকে- ‘তা না হয় বুঝলাম, আপা। আমাদের নবিজি বয়স বিবেচনা না করে অন্য কেউ সালাম দেওয়ার আগেই নিজে সালাম দিতেন বলে শুনেছি। রক্ষণশীল পরিবারে বয়স্ক স্বামী নাবালিকা বধূকে পর্যন্ত আপনি বলে সম্বোধন করে। আমি নিজে আমার ছাত্রীদের কখনোসখনো আদর করে আপনি বলি ...।’‘আচ্ছা ঠিক আছে, তাই হোক । আমি গাড়ি চালাই ধরুন ৭-৮ বছর ধরে। তবে উবারে তিন মাস যাবত আছি। আগে নিজের গাড়ি নিজে চালাতাম; এখন চালাই বাণিজ্যিক ভিত্তিতে।’‘উবারে ঢুকলেন কি জন্য? আমাদের দেশে রাতবিরাতে বাণিজ্যিক ভিত্তিতে মেয়েরা গাড়ি চালায় এটা অস্বাভাবিক একটা দৃশ্য... নিরাপত্তার অভাব, সামাজিক স্বীকৃতি নেই ...।’

‘আসলে আমি একজন গায়িকা। আগে বিভিন্ন অনুষ্ঠানে গান করতাম। ওই জগতের বাইরের দিকটায় আলোর ঝলকানি কিন্তু ভিতরে ঘুটঘুটে অন্ধকার। নানান ধরনের প্রব্লেম আঙ্কেল । অ্যারেঞ্জারকে অতিরিক্ত পয়সা না দিলে ডাক পড়ে না, ডাক পড়লে পছন্দের গান গাইতে পারি না, তারপর তো যৌন হয়রানি আছেই। আপনাকে কি আর বলব, যৌন সুড়সুড়িতে যারা সায় দেয়, তারা গান না জানলেও ডাক পায়। ইত্যাদি অনেক কারণে এখন ওই পেশা ছেড়ে দিতে বাধ্য হয়েছি। দুটো সন্তান, অসুস্থ বাবা, আর আপাতত বেকার স্বামীর মুখে অন্ন তুলে দিতে সকাল ৯টা থেকে রাত ১২টা পর্যন্ত গাড়ি চালাই। আমার বাসা সাভারের হেমায়েতপুর। নিরাপত্তার সমস্যা নেই কারণ যাত্রী ও ড্রাইভার দুজনেরই তথ্য নথিভুক্ত আছে। আর স্বীকৃতি? বিদেশ গিয়ে অন্যের ঘরে বাসন-কোসন মেজে স্বীকৃতি পাওয়া যায় অথচ নিজ দেশে গাড়ি চালালেই দোষ আঙ্কেল?’

অন্ধকারে রিয়ার ভিউ গ্লাসে অস্পষ্টভাবে নারীর বেদনাক্লিষ্ট চেহারা লক্ষ করে আমি সান্ত্বনা দেওয়ার চেষ্টা চালাই। বলি, হুমায়ূন আহমেদের ‘বহুব্রীহি’ নাটকে বাড়ির কাজের ছেলে ইজ্জত রাখতে গিয়ে রাতে চুরি করতে চায় কিন্তু দিনে রিকশা চালাতে চায় না। তার যুক্তি, রাতে কেউ দেখে না, দিনে সবাই দেখে ফেলে। আরও বলি, আপনি এ নিয়ে ভাববেন না, আপা সব ঠিক হয়ে যাবে। ‘প্রশ্ন হলো গায়িকা স্বয়ং গাড়িতে উপস্থিত থাকতে সিডিতে গান শোনা কেন। একটি গান শোনান, প্লিজ’ –আমি বিনীত আবদার রাখি।

Advertisement

বেশ কয়েকবার না বলার পর হ্যাঁ হয়। তিনি হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের বিখ্যাত গানের মুখ ও অন্তরা ধরলেন, ‘আমায় প্রশ্ন করে নিল দ্রুব তারা, আর কতকাল আমি রব দিশা হারা ...।’ গানটি শেষ হওয়া মাত্র আমি উদ্বেলিত হয়ে বললাম, আপনার গাওয়া এই গানটি আমার ছাত্রজীবনে রচিত প্রথম প্যারডি গান, ‘আমায় প্রশ্ন করে আমার প্রেমিকারা আর কতকাল আমি রব চাকরি ছাড়া...। প্যারডি শুনে বিমর্ষ চেহারা বিলীন করে তার মুখে খিলখিল হাসি দেখে আমি আনন্দ পাই।

তিন.গাড়ি ততক্ষণে বসুন্ধরায় প্রবেশের পথে ৩০০ ফিট রাস্তায় ।‘আপনি সাধারণত কি কি গান করেন আপা?’ – আমি জিজ্ঞেস করি। ‘পার্টিতে-পুরটিতে বিভিন্ন গান গাইতে হয় আঙ্কেল– হিন্দি বা উর্দু গজল, পুরোনো দিনের এপার-ওপার বাংলার গান, ফোক সঙ, সিনেমার গান ইত্যাদি।’অর্থনীতির ভাষায় বুঝলাম, কনসার্টজাতীয় কিংবা ইন হাউজ প্রোগ্রামে চাহিদা জোগান সৃষ্টি করে ; জোগান চাহিদা জাগায় না।‘ওই যে ডান দিকে টার্ন নিলেই আমার বাসা। নামার আগে আপনার খুব পছন্দের একটা গানের দু-একটা কলি যদি শোনাতেন তা হলে কৃতার্থ হতাম’– বলে আমি অনুরোধ রাখলাম।আবারও কয়েকবার না, না তারপর হ্যাঁ । তিনি গাইলেন,‘আগে যদি জানতাম, তবে মন ফিরে চাইতাম, এই জ্বালা আর প্রাণে সহেনা ...।’

চার.বাসায় ফিরে উবারচালক আপার জীবনের চ্যালেঞ্জ আমার পিছু ছাড়ে না। ভাবি, এদেশের সব নারী যদি নির্ভয়ে নিরুদ্বিগ্নে বিভিন্ন পেশায় স্বাধীনভাবে নিয়োজিত থাকতে পারতেন, মধ্যরাতে ঘরে ফিরতে সক্ষম হতেন দুশ্চিন্তামুক্ত হয়ে, যদি ইভটিজিং, ধর্ষণ, নারী নির্যাতনে থাকতো দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি, তা হলে এদেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ও উন্নয়ন কতটা ত্বরান্বিত হতো। স্মর্তব্য যে, শুধু বাড়ির কাজ এবং শিশু ও পরিবারের সেবায় নারীদের অবদান টাকার অঙ্কে হিসাব করলে দাঁড়াবে বর্তমান জিডিপির প্রায় ২৫ শতাংশ।

অথচ, ইদানীং খবর শুনি মেয়েদের পেশা, পোশাক এবং পছন্দ নিয়ে ফতোয়া দেওয়ার প্রচেষ্টা চলছে; এমনকি প্রকাশ্যে বেত্রাঘাতের ঘটনাও বিরল নয়। অথচ এই দেশটির প্রধান উপদেষ্টা মূলত নারীদের কল্যাণে নিবেদিত বলে নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন, উপদেষ্টা পরিষদে বেশ কজন নারী সদস্য আছেন যারা নারীদের নামে বিদেশ থেকে অনুদান এনে এনজিও করে খ্যাতি অর্জন করেছেন।

আমরা নারীদের সম্মান, সম্পদ এবং সক্ষমতা বিধানে ধর্মীয় অনুষ্ঠানে নারীবিদ্বেষী প্রচারণার প্রতিরোধ চাই। সোজা আঙুলে তো আর ঘি উঠবে না আর তাই কবির ভাষায় বলি,

“জাগো নারী জাগো বহ্নি-শিখা।জাগো স্বাহা সীমন্তে রক্ত-টিকা।।দিকে দিকে মেলি’ তব লেলিহান রসনা,নেচে চল উন্মাদিনী দিগ্বসনা,জাগো হতভাগিনী ধর্ষিতা নাগিনী,বিশ্ব-দাহন তেজে জাগো দাহিকা।।ধূ ধূ জ্ব’লে ওঠ ধূমায়িত অগ্নি,জাগো মাতা, কন্যা, বধূ, জায়া, ভগ্নী!পতিতোদ্ধারিণী স্বর্গ-স্খলিতাজাহ্নবী সম বেগে জাগো পদ-দলিতা,মেঘে আনো বালা বজ্রের জ্বালাচির-বিজয়িনী জাগো জয়ন্তিকা।”

লেখক : অর্থনীতিবিদ, কলামিস্ট। সাবেক উপাচার্য, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়।

এইচআর/এমএফএ/এমএস