একদিন সব ঠিক ছিল। হঠাৎ করেই ক্লান্তি যেন পিছু ছাড়ে না। মেজাজের উঠানামা, ওজন বেড়ে যাওয়া কিংবা কমে যাওয়া, চুল পড়া; সবকিছু মিলিয়ে শরীরটা যেন নিজের সঙ্গে লড়াই শুরু করেছে। অথচ বাইরে থেকে সবকিছু স্বাভাবিকই মনে হয়। এই নিঃশব্দ পরিবর্তনের পেছনে থাকতে পারে একটি ছোট্ট গ্রন্থি ‘থাইরয়েড’। যা গলার নিচে বসে শরীরের বিপাক ক্রিয়া থেকে শুরু করে মানসিক স্থিতি পর্যন্ত নিয়ন্ত্রণ করে। এই গ্রন্থিটি যখন সঠিকভাবে কাজ করে না, তখন শরীর নিজের বিরুদ্ধেই কাজ করতে শুরু করে। বিশ্ব থাইরয়েড দিবসে চলুন জেনে নিই সেই অদৃশ্য যুদ্ধের গল্প, যেটি আমরা অনেক সময় বুঝতেই পারি না, তবু সে চালিয়ে যাচ্ছে নিজের মতো করে।
Advertisement
আজ বিশ্ব থাইরয়েড দিবস। ২০০৮ সালে ইউরোপিয়ান থাইরয়েড অ্যাসোসিয়েশনের (ETA) উদ্যোগে বিশ্ব থাইরয়েড দিবস পালন শুরু হয়। পরে এতে যুক্ত হয় আমেরিকান থাইরয়েড অ্যাসোসিয়েশন (ATA), এশিয়া-ওশেনিয়া থাইরয়েড অ্যাসোসিয়েশন (AOTA) এবং ল্যাটিন আমেরিকান থাইরয়েড সোসাইটিও। বর্তমানে প্রতিবছর ২৫ মে বিশ্বব্যাপী এই দিবসটি পালিত হয়।
এ দিবসটি পালনের কারণ->> থাইরয়েডজনিত রোগ সম্পর্কে সচেতনতা বৃদ্ধি করা>> প্রাথমিক পর্যায়ে রোগ শনাক্তের গুরুত্ব তুলে ধরা। >> সঠিক চিকিৎসা ও নিয়মিত স্বাস্থ্যপরীক্ষার প্রয়োজনীয়তা জানানো>> বিশ্বজুড়ে থাইরয়েড রোগীদের সহায়তা ও তথ্যপ্রাপ্তি সহজ করা
বিশ্ব থাইরয়েড দিবস পালনের উদ্দেশ্য হলো এই গ্রন্থিটির গুরুত্ব এবং থাইরয়েড সমস্যার ঝুঁকিসমূহ সম্পর্কে জনসচেতনতা বাড়ানো।
Advertisement
থাইরয়েডজনিত সমস্যা অনেক সময় ধীরে ধীরে শরীরকে দুর্বল করে তোলে। হাইপোথাইরয়েডিজমে (থাইরয়েড হরমোনের ঘাটতি) যেমন দেখা দেয় ক্লান্তি, ওজন বৃদ্ধি, ঠান্ডা অনুভব, মন খারাপ থাকার প্রবণতা। আবার হাইপারথাইরয়েডিজমে (হরমোনের অতিরিক্ত নিঃসরণ) দেখা দিতে পারে হঠাৎ ওজন কমে যাওয়া, ঘাম হওয়া, নার্ভাসনেস বা ঘুমের সমস্যা।
এই লক্ষণগুলো অনেক সময় আমাদের অন্য রোগের সঙ্গে গুলিয়ে ফেলতে বাধ্য করে। কেউ মনে করে কাজের চাপ বা মানসিক অস্থিরতার কারণে এসব হচ্ছে। অথচ শরীর প্রতিনিয়ত সংকেত দিয়ে যায়, শুধু আমরা তা বুঝে উঠতে পারি না।
মনের ওপরও পড়ে প্রভাবঅনেকেই জানেন না, থাইরয়েড হরমোন সরাসরি প্রভাব ফেলে আমাদের মস্তিষ্কের কার্যক্রমে। তাই হরমোনের ভারসাম্যহীনতায় দেখা দিতে পারে এক ধরনের বিষণ্নতা, মনোযোগে ঘাটতি, স্মৃতিভ্রংশ বা এমনকি উদ্বেগের অনুভূতি। মানসিক স্বাস্থ্যজনিত সমস্যার উৎস অনেক সময় লুকিয়ে থাকে শরীরের এই অতি গুরুত্বপূর্ণ গ্রন্থিতে।
আরও পড়ুন:
Advertisement
থাইরয়েড সমস্যা যেকোনো বয়সেই হতে পারে, তবে বিশেষভাবে ঝুঁকিতে থাকেন নারীরা (বিশেষত গর্ভাবস্থা ও মেনোপজের সময়)। তবে যাদের পরিবারে থাইরয়েডজনিত রোগের ইতিহাস আছে। যারা দীর্ঘদিন ধরে মানসিক চাপে থাকেন। যাদের অটোইমিউন ডিজঅর্ডার আছে তাদেরও থাইরয়েডের ঝুঁকি রয়েছে।
কীভাবে বুঝবেন, থাইরয়েড সমস্যা হচ্ছে?>> হঠাৎ ওজন বেড়ে যাওয়া বা কমে যাওয়া>> চুল পড়া বেড়ে যাওয়া,>> বারবার ঠান্ডা বা গরম অনুভব>> অতিরিক্ত ঘুম বা ঘুমহীনতা>> মন খারাপ থাকা বা উদ্বেগ>> গলার সামনের অংশে ফোলাভাব>> ত্বক শুষ্ক বা চুলকানি>> মাসিকচক্রে অনিয়ম
পরীক্ষা ও চিকিৎসাথাইরয়েড সমস্যার নিশ্চিত হতে প্রয়োজন হয় টি৩, টি৪ ও টি.এস.এইচ টেস্ট। এ ছাড়া কিছু ক্ষেত্রে আলট্রাসনোগ্রাম বা বাইপসি করা লাগতে পারে। সঠিক সময়ে ধরা পড়লে এ রোগ নিয়ন্ত্রণে রাখা সম্ভব।
চিকিৎসা মূলত হরমোন রিপ্লেসমেন্ট থেরাপির মাধ্যমে হয়। তবে চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়া কোনো ওষুধ শুরু করা বিপজ্জনক হতে পারে।
কীভাবে বিশ্ব থাইরয়েড দিবস পালন করবেন?বিশ্ব থাইরয়েড দিবস পালনের মাধ্যমে আমরা সচেতনতা বাড়াতে ও থাইরয়েড স্বাস্থ্যকে গুরুত্ব দিতে পারি। যেভাবে বিশেষ এই দিবস পালন করতে পারেন-
>> থাইরয়েড পরীক্ষার: একজন চিকিৎসকের সঙ্গে দেখা করে থাইরয়েড পরীক্ষার সময় ঠিক করুন। নিয়মিত চেকআপ সমস্যা প্রাথমিক পর্যায়ে শনাক্ত করতে সহায়তা করে, যা সময়মতো চিকিৎসা নিশ্চিত করে এবং সুস্বাস্থ্য বজায় রাখে।
>> শিক্ষামূলক কর্মশালায় অংশ নিন: স্থানীয় বা অনলাইন ভিত্তিক থাইরয়েড বিষয়ক সেমিনারে অংশ নিতে পারেন। এসব কর্মশালায় উপসর্গ চেনা, চিকিৎসার পদ্ধতি বোঝা এবং স্বাস্থ্যকর জীবনধারা গড়ে তোলার বিষয়ে প্রয়োজনীয় তথ্য পাওয়া যায়।
>> কমিউনিটিতে সচেতনতা কর্মসূচি আয়োজন করুন: আপনার এলাকায় হাঁটা, দৌড় বা সাইক্লিং ইভেন্ট আয়োজন করতে পারেন। এমন আয়োজন একদিকে যেমন স্বাস্থ্যসচেতনতা বাড়ায়, অন্যদিকে কমিউনিটির মানুষকে একত্রিত করে সচেতনতামূলক আলোচনায় যুক্ত করে।
>> সামাজিক মাধ্যমে তথ্য শেয়ার করুন: আপনার সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহার করে থাইরয়েড সমস্যার ওপর তথ্য, ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা, ইনফোগ্রাফিকস বা বিশেষজ্ঞদের লেখা শেয়ার করুন। এতে আপনার বন্ধুমহল ও অনুসারীরা উপকৃত হবে এবং থাইরয়েড স্বাস্থ্য সম্পর্কে জানতে আগ্রহী হবে।
>> থাইরয়েড স্বাস্থ্যবিষয়ক সংস্থাগুলোর পাশে দাঁড়ান: থাইরয়েড গবেষণা ও রোগী সহায়তায় কাজ করে এমন সংস্থাগুলোর পাশে দাঁড়ান, চাইলে আর্থিক অনুদান দিন বা স্বেচ্ছাসেবী হিসেবে যুক্ত হন। এর ফলে গবেষণা, রোগী সহায়তা এবং সচেতনতা কার্যক্রম আরও বিস্তৃত করা সম্ভব হবে।
স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা দিবসটি উপলক্ষে থাইরয়েড সমস্যার উপসর্গ, চিকিৎসা পদ্ধতি ও প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থাগুলো তুলে ধরেন। বিভিন্ন কর্মসূচি, অনলাইন প্রচারণা ও শিক্ষামূলক কার্যক্রমের মাধ্যমে প্রয়োজনীয় তথ্য ছড়িয়ে দেওয়া হয়।
আজ বিশ্বজুড়ে কোটি কোটি মানুষ থাইরয়েড স্বাস্থ্য সম্পর্কে সচেতন হচ্ছেন। এই সচেতনতা ভালো চিকিৎসা, রোগী সহায়তা এবং সুস্থ জীবনযাপনকে আরও সহজ করছে। আগে যারা উপসর্গ উপেক্ষা করতেন, তারা এখন চিকিৎসা নিচ্ছেন এবং তাদের জীবনমান উন্নত হচ্ছে।
এই আন্তর্জাতিক উদ্যোগ ক্রমেই বিস্তৃত হচ্ছে-সহযোগিতা, শিক্ষা ও সচেতনতার মাধ্যমে। একটি ছোট গ্রন্থি হলেও এর প্রভাব অনেক বড়; তাই এটি সম্পর্কে জানা এবং যত্ন নেওয়াই হতে পারে সুস্থ জীবনের চাবিকাঠি।
জেএস/এমএস