বছর ঘুরে আবারও জাতীয় বাজেট ঘোষণার প্রস্তুতি। অর্থ মন্ত্রণালয় ও জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) ব্যস্ত নানান হিসাব-নিকাশে। কিন্তু রাজধানীর অলিগলি থেকে শুরু করে মফস্বলের ক্ষেত-খামার, সাধারণ মানুষ এমন একটি বাজেট চাচ্ছেন, যেটা শুধুই সংখ্যার খেলা নয়, বরং জীবনযাত্রার মান উন্নয়নে কার্যকর হাতিয়ার হবে।
Advertisement
তাদের মতে, প্রতিবছরই বাজেট ঘোষণার পর বিভিন্ন পণ্যের দাম বেড়ে যায়। এতে সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রার ওপর চাপ বাড়ে। এবার একটি বিশেষ পরিস্থিতিতে অন্তর্বর্তী সরকার বাজেট দেবে। যেহেতু কোনো রাজনৈতিক দলের অধীনে বাজেট দেওয়া হচ্ছে না, তাই আশা করা যায় এই বাজেটে রাজনৈতিক চাপ থাকবে না। সাধারণ মানুষের চাওয়া-পাওয়াকে অগ্রাধিকার দিয়ে অর্থ উপদেষ্টা বাস্তবসম্মত, জীবনঘনিষ্ঠ ও দেশের সামগ্রিক অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জ মোকাবিলার মতো বাজেট দেবেন।
তারা বলছেন, সাধারণ মানুষ সংখ্যার খেলা বোঝে না। বাজারে যাতে পণ্যের দাম কম থাকে, সেটা গুরুত্ব দিয়ে বাজেট তৈরি করতে হবে। একই সঙ্গে তরুণদের কর্মসংস্থান সৃষ্টি, ছোট ব্যবসা সহজ করার উপায়, চিকিৎসা সুবিধা সহজ করা, শিক্ষার মান উন্নয়নের প্রতি নজর দিয়ে বাজেট তৈরি করতে হবে।
অর্থ মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা যায়, মূল্যস্ফীতি, কর্মসংস্থান, মানুষের জীবনমান, স্বাস্থ্য, শিক্ষা ও সামাজিক সুরক্ষায় বাড়তি নজর দিয়ে আগামী অর্থবছরের (২০২৫-২৬) জন্য সাত লাখ ৯০ হাজার কোটি টাকার বাজেট দেওয়ার পরিকল্প করেছে অন্তর্বর্তী সরকার। বাজেটের এই আকার চলতি অর্থবছরের তুলনায় সাত হাজার কোটি টাকা কম। আগামী ২ জুন জাতির সামনে নতুন অর্থবছরের বাজেট তুলে ধরবেন অর্থ উপদেষ্টা ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ।
Advertisement
প্রতিনিয়ত কোনো না কোনো পণ্যের দাম বাড়ছে। কিন্তু আমাদের আয় তো বাড়ছে না। এ পরিস্থিতি বাজেটের কারণে নতুন করে পণ্যের দাম বেড়ে গেলে আমাদের কষ্টও বেড়ে যাবে। আমরা চাই এমন বাজেট দেওয়া হোক যাতে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম না বাড়ে
সাধারণত প্রতি অর্থবছরই বাজেটের আকার আগের অর্থবছরের তুলনায় বড় রাখা হয়। তবে এবার বাজেট ঘাটতি কমিয়ে রেখে বাজেট ছোট করার পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে। নতুন অর্থবছরের বাজেটে সামষ্টিক অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা বজায় রাখা এবং মূল্যস্ফীতির লাগাম টেনে ধরার বিষয়ে গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে।
নতুন অর্থবছরের বাজেটে ঘাটতি ধরা হতে পারে দুই লাখ ২৬ হাজার কোটি টাকা। চলতি বাজেটে যা ছিল দুই লাখ ৫৬ হাজার কোটি টাকা। আগামী অর্থবছরের জন্য যে ঘাটতি ধরা হচ্ছে, সেই ঘাটতির অর্ধেকেরও বেশি বিদেশি উৎস থেকে এবং বাকিটা ব্যাংক ও সঞ্চয়পত্র থেকে ঋণ করার পরিকল্পনা করা হচ্ছে।
নতুন অর্থবছরের বাজেটে পরিচালন বা অনুন্নয়ন খাতে বরাদ্দ ধরা হতে পারে পাঁচ লাখ ৪৫ হাজার কোটি টাকা। আর উন্নয়ন ব্যয় ধরা হতে পারে দুই লাখ ৪৫ হাজার কোটি টাকা। এর মধ্যে বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচিতে (এডিপি) বরাদ্দ রাখা হতে পারে দুই লাখ ৩০ হাজার কোটি টাকা। জিডিপির প্রবৃদ্ধি সাড়ে ৫ শতাংশ ধরা হতে পারে। আর মূল্যস্ফীতি সাড়ে ৬ শতাংশে নামিয়ে আনার কথা বলতে পারেন অর্থ উপদেষ্টা। এবার অপ্রদর্শিত অর্থ বৈধ করার সুযোগ না দেওয়ার পরিকল্পনা করা হচ্ছে।
Advertisement
সরকার যে পরিকল্পনাই করুক সাধারণ মানুষের মূল চাওয়া নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম যাতে সহনীয় পর্যায়ে থাকে। বাজেটের পরপরই যেন অতিগুরুত্বপূর্ণ কোনো পণ্যের দাম না বাড়ে। সেজন্য সরকারকে দায়িত্বশীল ও মানবিক বাজেট দিতে হবে। একই সঙ্গে নতুন এমন পদক্ষেপ নিতে হবে, যা উদাহরণ হিসেবে থেকে যায়।
পণ্যের মূল্য নিয়ন্ত্রণই বড় দাবিআগামী অর্থবছরের মূল্যস্ফীতি সাড়ে ৬ শতাংশে নামিয়ে আনার পরিকল্পনা করলেও বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) তথ্য অনুযায়ী, চলতি বছরের এপ্রিল শেষে সার্বিক মূল্যস্ফীতি দাঁড়িয়েছে ৯ দশমিক ১৭ শতাংশ। এক মাস আগে অর্থাৎ মার্চে ছিল ৯ দশমিক ৩৫ শতাংশ। ২০২৪ সালের নভেম্বরে দেশে সার্বিক মূল্যস্ফীতির হার ছিল ১১ দশমিক ৩৮ শতাংশ। এরপর চলতি বছরের জানুয়ারিতে মূল্যস্ফীতির হার কমে ৯ দশমিক ৯৪ শতাংশ হয়। ফেব্রুয়ারিতে তা আরও কমে ৯ দশমিক ৩২ শতাংশ। এ হিসাবে মূল্যস্ফীতি ধারাবাহিকভাবে কমছে। কিন্তু সার্বিক মূল্যস্ফীতি এখনো ৯ শতাংশের ওপরে। ফলে স্বাভাবিকভাবেই নিম্ন আয়ের মানুষ কিছুটা চাপের মধ্যে আছেন।
আরও পড়ুন উচ্চাভিলাষী নয়, প্রয়োজন বাস্তবসম্মত বাজেট বিনিয়োগ আকর্ষণে বাজেটে একটি দূরদর্শী করনীতি-করহার দরকার সহজ হচ্ছে সঞ্চয়পত্র কেনা, টকটাইম-সিমে বাড়ছে না ভ্যাট কৃষিখাতে সুনির্দিষ্ট প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা দরকাররামপুরার বাসিন্দা ইসমত আরা বলেন, প্রতি বছর বাজেট এলেই বিভিন্ন পণ্যের দাম নতুন করে বাড়ে। এতে আমাদের মতো স্বল্প আয়ের মানুষ সবচেয়ে বেশি বিপাকে পড়ে। এখন বাজারে সব ধরনের পণ্যের দাম বেশ চড়া। প্রতিনিয়ত কোনো না কোনো পণ্যের দাম বাড়ছে। কিন্তু আমাদের আয় তো বাড়ছে না। এ পরিস্থিতি বাজেটের কারণে নতুন করে পণ্যর দাম বেড়ে গেলে আমাদের কষ্টও বেড়ে যাবে। আমরা চাই এমন বাজেট দেওয়া হোক যাতে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম না বাড়ে।
রিকশাচালক মো. আসলাম বলেন, আমাদের একটাই চাওয়া বউ, ছেলে-মেয়ে নিয়ে যাতে ভালোভাবে দু’মুঠো খেতে পারি। বাজারে এখন চাল, ডাল, তেল সবকিছুর দাম বাড়তি। প্রতিদিন যা আয় হয় তার বেশিরভাগই খাওয়ার পেছনে চলে যায়। বাজেটের পর যদি এসব পণ্যের দাম বাড়ে তাহলে তো আমাদের বাঁচা মুশকিল হবে। তাই আমরা এমন বাজেট চাই যাতে জিনিসপত্রের দাম কমে।
করমুক্ত আয়ের সীমা বাড়ানোর দাবিবেসরকারি চাকরিজীবী মো. খায়রুল আলম বলেন, বিবিএসের হিসাবে মূল্যস্ফীতি ধারাবাহিকভাবে কমছে। এরপরও মূল্যস্ফীতি এখনো ৯ শতংশের ওপর। এটা নিঃসন্দেহ উচ্চ মূল্যস্ফীতি। বাজারে গেলেও মূল্যস্ফীতির উত্তাপ টের পাওয়া যাচ্ছে। এতে আমাদের মতো মধ্যবিত্তরা সবচেয়ে বেশি চাপে পড়ে। যেহেতু উচ্চ মূল্যস্ফীতি ঠেকানো যাচ্ছে না, তাই সরকারের উচিত কর কাঠামোতে পরিবর্তন আনা। সাধারণ মানুষকে কিছুটা স্বস্তি দিতে নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের ওপর কর না বাড়িয়ে সম্ভব হলে কমানোর পদক্ষেপ নেওয়া উচিত। একই সঙ্গে করমুক্ত আয়ের সীমা বাড়ানো উচিত।
আমরা চাইবো সরকার বাস্তবভিত্তিক ও জীবনঘনিষ্ঠ একটি বাজেট দেবে। যেখানে করমুক্ত আয়ের সীমা বাড়ানোর পাশাপাশি সাধারণ মানুষকে স্বস্তি দেওয়ার মতো বিভিন্ন পদক্ষেপ থাকবে।
একটি বেসরকারি ব্যাংকের কর্মকর্তা সাইফুল ইসলাম বলেন, এবার যে বাজেট আসছে তা দেবে অন্তর্বর্তী সরকার। এটি যেহেতু রাজনৈতিক সরকার নয়, তাই রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত প্রকল্প নেওয়ার প্রয়োজন হবে না। আমরা চাইবো সরকার বাস্তবভিত্তিক ও জীবনঘনিষ্ঠ একটি বাজেট দেবে। যেখানে করমুক্ত আয়ের সীমা বাড়ানোর পাশাপাশি সাধারণ মানুষকে স্বস্তি দেওয়ার মতো বিভিন্ন পদক্ষেপ থাকবে।
তিনি বলেন, অর্থ উপদেষ্টা বার বার বলেছেন তারা একটা পদচিহ্ন রেখে যেতে চান। আমরাও চাই আগামী বাজেটে এমন কিছু নতুন পদক্ষেপ নেওয়া হবে, তা জাতি সব সময় মনে রাখবে।
শিক্ষা ও স্বাস্থ্যখাতের বরাদ্দসরকার প্রতি বছরই শিক্ষা ও স্বাস্থ্যখাতে বড় অংকের বরাদ্দ ঘোষণা করে। কিন্তু বরাদ্দের বাস্তবায়ন ও গুণগত মান নিয়ে প্রশ্ন থেকেই যায়। এবারের বাজেটে শিক্ষা ও স্বাস্থ্যখাতে বরাদ্দ বাড়ানোর পাশাপাশি যাতে তা বাস্তবায়ন হয়, সেই দাবি জানায় সাধারণ মানুষ। ঝিনাইদহ জেলার একটি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক মো. মোজাম্মেল হোসেন বলেন, শুধু বই বিতরণ করলেই শিক্ষা হয় না। শিক্ষক নিয়োগ, ডিজিটাল ক্লাসরুম, গ্রামে টয়লেট ব্যবস্থা—এসব বাজেটে গুরুত্ব দেওয়া উচিত। প্রতি বছর বাজেট আসে, কিন্তু এসব বিষয়ে আমরা গুরুত্ব দিতে দেখি না। যেহেতু একটি অরাজনৈতিক সরকার বাজেট দিচ্ছে, তাই আমরা আশা করছি এবার এই বিষয়গুলোতে গুরুত্ব দেবেন। একই সঙ্গে শিক্ষা খাতের বরাদ্দ বাড়ানো হবে।
বেসরকারি একটি অফিসের কর্মকর্তা মো. ইসমাইল হোসেন বলেন, সরকারি হাসপাতালের সেবার মান বাড়ানো ও ওষুধ সরবরাহ নিশ্চিত করতে হবে। একই সঙ্গে গ্রামীণ স্বাস্থ্যকেন্দ্র উন্নয়ন দরকার। যাতে সাধারণ মানুষ মৌলিক অধিকার হিসেবে সঠিক চিকিৎসাসেবা পেতে পারেন। সরকারি হাসপাতালগুলোতে ফ্রি ওষুধ দেওয়ার কথা, কিন্তু বাস্তবে বেশিরভাগ ওষুধ হাসপাতাল থেকে দেওয়া হয় না। সরকারের উচিত নিম্ন আয়ের মানুষ যাতে সরকারি হাসপাতাল থেকে সঠিক চিকিৎসাসেবা পাওয়ার পাশাপাশি ফ্রি ওষুধ পায় তার ব্যবস্থা করা।
তরুণদের জন্য কর্মসংস্থান ও উদ্যোক্তা সহায়তাঢাকা বিশ্ববিদ্যলয়ের শিক্ষার্থী আরিফুল ইসলাম বলেন, এবারের বাজেটে কর্মসংস্থান সৃষ্টি ও উদ্যোক্তা তৈরিতে বিশেষভাবে নজর দেওয়া উচিত। কর্মসংস্থান ও নতুন উদ্যোক্তা তৈরি করতে তরুণদের জন্য স্টার্টআপ ফান্ড, প্রশিক্ষণ, সহজ শর্তে ঋণ বা ট্যাক্স ইনসেনটিভ রাখা যেতে পারে। সরকার এটি করতে পারলে, সেটা একটা পদচিহ্ন হয়ে থাকতে পারে।
সরকারি হাসপাতালগুলোতে ফ্রি ওষুধ দেওয়ার কথা, কিন্তু বাস্তবে বেশিরভাগ ওষুধ হাসপাতাল থেকে দেওয়া হয় না। সরকারের উচিত নিম্ন আয়ের মানুষ যাতে সরকারি হাসপাতাল থেকে সঠিক চিকিৎসাসেবা পাওয়ার পাশাপাশি ফ্রি ওষুধ পায় তার ব্যবস্থা করা
জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী সুমাইয়া আক্তার বলেন, তরুণদের যাতে কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা হয়, এবারের বাজেটে সেজন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে হবে। আর এই কর্মসংস্থান সৃষ্টি করতে শুধু বড় শিল্প নয়, স্টার্টআপ বা অনলাইন উদ্যোক্তাদের দিকে নজর দিতে হবে। স্টার্টআপ, অনলাইন উদ্যোক্তাদের জন্য বিশেষ সহায়তার ব্যবস্থা রাখলে নতুন উদ্যোক্তা সৃষ্টি হওয়ার পাশাপাশি কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা হবে।
খিলগাঁওয়ের একটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষিকা নুসরাত বলেন, দেশে বেকারের সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে। বেকারত্ব একটা অভিশাপ। তাই যুব সমাজের বেকারত্ব লাঘবের জন্য সরকারের পদক্ষেপ নেওয়া উচিত। এজন্য আগামী অর্থবছরের বাজেটে কর্মংস্থান সৃষ্টির প্রতি বিশেষ নজর দিতে হবে। কর্মসংস্থান সৃষ্টি হয় এমন জনবান্ধব প্রকল্প হাতে নিতে হবে। একই সঙ্গে মূল্যস্ফীতি কমানোর দিকে নজর দিতে হবে। মূল্যস্ফীতি কমাতে না পারলে সব পদক্ষেপ ব্যর্থ হবে।
কৃষি ভর্তুকিঝিনাইদহ জেলার কৃষক মোয়াজ্জেম হোসেন বলেন, বাজেট বড় হলো না ছোট হলো তা দিয়ে আমাদের কিছু যায় আসে না। আমরা চাই এমন বাজেট দেওয়া হোক যাতে কম দামে বীজ, সার, ডিজেল ও বিদ্যুৎ পাই। উৎপাদন খরচ কমলে এবং পণ্যের ন্যায্যমূল্য পেলেই আমরা খুশি। এজন্য যে পদক্ষেপ নেওয়া উচিত আমরা সরকারের কাছে সেই পদক্ষেপ নেওয়ার দাবি জানাই।
এমএএস/এএসএ/এমএফএ/এএসএম