মতামত

প্রধান উপদেষ্টার পদত্যাগের প্রশ্ন : সমাধান কোন পথে?

প্রধান উপদেষ্টার পদত্যাগের প্রশ্ন : সমাধান কোন পথে?

রাজনীতিতে সব ছাপিয়ে এখন আলোচনার বিষয় অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূসের পদত্যাগ প্রসঙ্গ। দেশের বিরাজমান পরিস্থিতিতে ক্ষোভ ও হতাশা প্রকাশ করে তিনি পদত্যাগ করার অভিপ্রায় ব্যক্ত করেছেন-এমন কথা চাউর হওয়ার পরই রাজনীতি নতুন বাঁকে মোড় নিয়েছে।

Advertisement

গত বৃহস্পতিবার দুপুরে উপদেষ্টা পরিষদের নিয়মিত বৈঠক শেষে অনির্ধারিত আলোচনায় দেশের সার্বিক পরিস্থিতি নিয়ে অন্য উপদেষ্টাদের সঙ্গে কথা বলেন অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস। সেখানে ক্ষোভ ও হতাশার কথা তুলে ধরেন তিনি। যদি ঠিকভাবে কাজ করতে না পারেন, তাহলে প্রধান উপদেষ্টার পদে থেকে কী লাভ, সে কথাও বলেন তিনি।

উপদেষ্টা পরিষদের বৈঠকের পর প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে দেখা করেন জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম। তিনি বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় প্রধান উপদেষ্টার বাসভবন যমুনায় যান। সেখান থেকে বেরিয়ে রাতে বিবিসি বাংলাকে বলেন, অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস ‘পদত্যাগের বিষয়ে ভাবছেন।’

রাতে বিবিসিকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে তিনি বিষয়টি পরিষ্কার করে আরও বলেন, ‘প্রধান উপদেষ্টা দেশের বর্তমান পরিস্থিতিতে কাজ করতে পারবেন না, এমন শঙ্কা প্রকাশ করেছেন।’ তিনি বলেন (প্রধান উপদেষ্টা), ‘আমি যদি কাজ করতে না পারি...যে জায়গা থেকে তোমরা আমাকে আনছিলে একটা গণঅভ্যুত্থানের পর। দেশের পরিবর্তন, সংস্কার। কিন্তু যেই পরিস্থিতি যেভাবে আন্দোলন বা যেভাবে আমাকে জিম্মি করা হচ্ছে। আমি তো এভাবে কাজ করতে পারব না।’ (প্রথম আলো, ২৩ মে, ২০২৫)।

Advertisement

সেই বৈঠকে প্রধান উপদেষ্টাকে পদত্যাগের মতো সিদ্ধান্ত না নেওয়ার অনুরোধ করেন এনসিপি নেতা নাহিদ ইসলাম। প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী ফয়েজ আহমদ তৈয়্যবও ব্যক্তিগত ফেসবুক বার্তায় একই অনুরোধ জানিয়েছেন।

দিন দিন পরিস্থিতি আরও জটিল আকার ধারণ করছে। নির্বাচনেরও সুস্পষ্ট কোনো রোডম্যাপ পাওয়া যাচ্ছে না। অন্তর্বর্তী সরকার বলছে, ২০২৫ এর ডিসেম্বর অথবা ২০২৬ এর জুন মাসে নির্বাচন হতে পারে। যখন এ ধরনের একটি সম্ভাব্য তারিখের কথা বলা হচ্ছে তখন সেটি দাঁড়াচ্ছে ছয় মাসেরও বেশি ব্যবধানে। এটি কোনো যুক্তিসংগত রোডম্যাপ হতে পারে না। এখানে ডিসেম্বর না জুন—এই বিতর্কের সুযোগ নেই। সুস্পষ্ট একটি রূপরেখা দিতেই হবে।

প্রধান উপদেষ্টার পদত্যাগের অভিপ্রায়ের বিষয়ে বলা হচ্ছে, পদত্যাগ এই সময়ে কার্যকর কোনো সমাধান বয়ে আনবে না। বরং পরিস্থিতিতে আরও ঘোলাটে করবে। চলমান সংস্কার প্রক্রিয়া বাধাগ্রস্ত হবে। আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্র্যাইব্যুনালের বিচার প্রক্রিয়া অনিশ্চিত হয়ে যাবে। এমনকি সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ যে, একটি অবাধ ও সুষ্ঠু জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠান নিয়েও দেখা দেবে অনিশ্চয়তা। দেশ আবারো অন্ধকারে নিমজ্জিত হবে।

প্রধান উপদেষ্টার পদত্যাগের অভিপ্রায় প্রসঙ্গে কথা বলেন অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ। ‘গণঅভ্যুত্থান পরবর্তী বাংলাদেশ: কেমন বাজেট চাই’ শীর্ষক এক আলোচনা সভায় সভাপতির বক্তব্যে অংশ নিয়ে তিনি বলেন, অন্তর্বর্তী সরকারের দায়িত্ব বৈষম্যহীন বাংলাদেশ গড়ার পথে অগ্রসর হওয়ার জন্য প্রয়োজনীয় মতাদর্শিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক নীতিমালা প্রণয়ন করা। সরকার সেই কাজের দিকে না গিয়ে, অন্যদিকে গিয়ে জটিলতা সৃষ্টি করে তারপর মান-অভিমান করা, এটা তো কোনো গ্রহণযোগ্য কাজ নয়।

Advertisement

গতকাল শুক্রবার দুপুরে জাতীয় প্রেস ক্লাবে এই সভার আয়োজন করে গণতান্ত্রিক অধিকার কমিটি। এই সভায় তিনি আরও বলেন, এই সরকারের স্থায়ী কোনো ‘ম্যান্ডেট’ নেই। এই সরকার দীর্ঘদিন থাকবে না। তাই তার পক্ষে অনেক কিছুই সম্ভব নয়। তবে সরকার বৈষম্যহীন বাংলাদেশের প্রত্যাশা অনুযায়ী কিছু কিছু পরিবর্তনের গতিমুখ তৈরি করতে পারে।

মানুষ পরিশ্রম করছে, সম্পদ তৈরি হচ্ছে, ফলে টাকা-পয়সার অভাব নেই উল্লেখ করে অর্থনীতির এই অধ্যাপক বলেন, সম্পদের ওপর জনগণের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার পথ তৈরি হবে বৈষম্যহীন বাংলাদেশ তৈরি হওয়ার পর। সরকারের এটা প্রতিশ্রুতির অঙ্গীকার। সেই অঙ্গীকারের দিকে না গিয়ে বিদেশি কোম্পানি, বিদেশি বিনিয়োগ, স্টারলিংক, এলএনজি আমদানি—এসব দিকে মনোযোগ দেওয়া তো এই সরকারের দায়িত্ব নয়। সরকারের দায়িত্ব হচ্ছে বৈষম্যহীন বাংলাদেশে অগ্রসর হওয়ার জন্য জাতীয় সক্ষমতা বাড়ানো, শিক্ষা ও সংস্কৃতির ক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় পরিবর্তন করা, কৃষি–শিল্পের ক্ষেত্রে পরিবর্তন করা এবং জনগণের জন্য পরিবেশবান্ধব যে পথ, সেই পথটাই যাতে শক্তিশালী হয়, সেটার জন্য প্রয়োজনীয় মতাদর্শিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক নীতিমালা প্রণয়ন করা। সরকার সেই কাজটা করবে। সেই কাজের দিকে না গিয়ে, অন্যদিকে গিয়ে জটিলতা সৃষ্টি করে, তারপর মান-অভিমান করা, এটা তো কোনো গ্রহণযোগ্য পথ নয়। (সূত্র: প্রথম আলো)

প্রশ্ন হচ্ছে, প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের পদত্যাগের প্রশ্ন কেন এলো? গত বছর ৮ আগস্ট জুলাই অভ্যুত্থানের পর ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তী সরকার যখন দেশ পরিচালনার দায়িত্ব নেয়, তখন ঘুণাক্ষরেও কেউ ভাবতে পারেননি, সাড়ে ৯ মাসের মাথায় পরিস্থিতি এতটা জটিল আকার ধারণ করবে। সরকারের সঙ্গে রাজনৈতিক দলগুলোর দূরত্ব ও মতপার্থক্য ‘পয়েন্ট অব নো রিটার্নের’ দিকে যাবে। বাস্তবতা হচ্ছে সময় যত গড়াচ্ছে এই দূরত্ব ও মতপার্থক্য, ব্যবধান ততই বাড়ছে। অথচ এ সরকারের ভিত্তি ছিল সশস্ত্র বাহিনী, চব্বিশের গণঅভ্যুত্থানে নেতৃত্বদানকারী ছাত্র নেতৃত্ব ও রাজনৈতিক দলের জোরালো সমর্থন।

প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস

প্রথমদিকে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে একটি সমঝোতামূলক ঐক্য ছিল। গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্তগুলো রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলোচনা করেই নিত সরকার। কিন্তু সময়ের ব্যবধানে ব্যবধানও বাড়তে থাকে। বিশেষ করে অন্তর্বর্তী সরকারের ভিত সশস্ত্রবাহিনীর সঙ্গে সরকারের দূরত্ব সাম্প্রতিক সময়ে প্রকাশ্য রূপ নেয়। সেনাপ্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান বলছেন, সশস্ত্র বাহিনীর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট অনেক বিষয়ে সরকার সিদ্ধান্ত নিয়েছে তাদের ‘অন্ধকারে’ রেখে।

ঢাকা সেনানিবাসের সেনা প্রাঙ্গণে গত বুধবার অফিসার্স অ্যাড্রেসের সূত্রের বরাত দিয়ে সেনাপ্রধানের বক্তব্য প্রকাশ হয়েছে গণমাধ্যমে। সেখানে দাবি করা হয়, সংস্কার প্রসঙ্গে সেনাপ্রধান বলেন, কী সংস্কার হচ্ছে, কীভাবে হচ্ছে, এ বিষয়ে তার কিছু জানা নেই। এ বিষয়ে তার সঙ্গে কোনো পরামর্শ বা আলোচনা করা হয়নি। মানবিক করিডোর বিষয়ে সিদ্ধান্ত একটি নির্বাচিত সরকার থেকেই আসতে হবে এবং তা বৈধ প্রক্রিয়া অনুসরণ করেই হতে হবে। এছাড়া আগামী ডিসেম্বরের মধ্যে নির্বাচন হওয়া উচিত বলে সেনাপ্রধানের বক্তব্য প্রচার করা হয়েছে।

নির্বাচন নিয়ে সেনাপ্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামানের এমন বক্তব্যের পর থেকে বিষয়টি নিয়ে আলোচনা শুরু হয় রাজনৈতিক অঙ্গনসহ সরকারেও। বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘সেনাপ্রধান যৌক্তিকভাবেই তাদের অবস্থান ব্যাখ্যা করেছেন। আইন-শৃঙ্খলা রক্ষার কাজ করা তো সেনাবাহিনীর দায়িত্ব না। সবাই তো একটা সুষ্ঠু নির্বাচনের দাবিতে আন্দোলন করেছে। দেশের সর্বত্র এখন বিশৃঙ্খলা বিরাজ করছে। সরকার এগুলো নিয়ন্ত্রণ করতে পারছে না। ফলে যত দ্রুত সম্ভব একটা নির্বাচন দিয়ে নির্বাচিত প্রতিনিধিদের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর করা সরকারের দায়িত্ব। সেনাপ্রধান যেটা বলেছেন, সেটা তো দেশের সব মানুষের দাবি। এটাকে ভিন্নভাবে দেখার কোনো সুযোগ নেই। তারা তো তাদের নিজেদের কাজে ফিরে যেতে চায়।’

আসলেও অন্তর্বর্তী সরকারের সঙ্গে বিএনপিরও দূরত্ব সৃষ্টি হয়েছে। বিশেষ করে ইশরাক হোসেন ইস্যুতে। বিএনপি অভিযোগ করে বলছে ইশরাক হোসেনের ঘটনায় সরকারের অবস্থান ছিল পক্ষপাতমূলক। যেখানে নির্বাচন কমিশন তাকে মেয়র ঘোষণা করে প্রজ্ঞাপন দিয়েছে, সেখানে রিটের অজুহাতে তার শপথ আটকে দেওয়া দুরভিসন্ধি বলে মনে করেন তারা।

সব মিলিয়ে দেশে একধরনের রাজনৈতিক অস্থিরতা ও অনিশ্চয়তা চলছে। আইন-শৃঙ্খলার অবনতি হয়েছে। মব বন্ধ হয়নি। ফ্যাসিস্টের দোসর তকমা দিয়ে আইনবিরোধী কার্যকলাপকে বৈধতা দেওয়া হচ্ছে। সব জায়গায় এক অরাজক অবস্থা্।

মিয়ানমারে মানবিক চ্যানেল তৈরি কিংবা চট্টগ্রাম বন্দরের একটি টার্মিনাল পরিচালনার ভার বিদেশি কোম্পানিকে দেওয়ার বিষয়ে সরকার রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলোচনা করেনি। তাছাড়া নিয়মতান্ত্রিক (অন্তর্বর্তী)একটি সরকার এ ধরনের সিদ্ধান্ত নিতে পারে কি না-এ নিয়েও প্রশ্ন রয়েছে।

রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে বিরোধ আগের মতোই রয়ে গেছে। রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বিতার ভাষায়ও কোনো পরিবর্তন আসেনি। বিএনপি সরকারে থাকা দুই ছাত্র প্রতিনিধির অবিলম্বে পদত্যাগ দাবি করেছে। এনসিপিও বিএনপিপন্থি উপদেষ্টাদের সরে যাওয়ার কথা বলেছে। দিন দিন পরিস্থিতি আরও জটিল আকার ধারণ করছে। নির্বাচনেরও সুস্পষ্ট কোনো রোডম্যাপ পাওয়া যাচ্ছে না। অন্তর্বর্তী সরকার বলছে, ২০২৫ এর ডিসেম্বর অথবা ২০২৬ এর জুন মাসে নির্বাচন হতে পারে। যখন এ ধরনের একটি সম্ভাব্য তারিখের কথা বলা হচ্ছে তখন সেটি দাঁড়াচ্ছে ছয় মাসেরও বেশি ব্যবধানে। এটি কোনো যুক্তিসংগত রোডম্যাপ হতে পারে না। এখানে ডিসেম্বর না জুন—এই বিতর্কের সুযোগ নেই। সুস্পষ্ট একটি রূপরেখা দিতেই হবে।

যখন-তখন আন্দোলন হচ্ছে। রাস্তা বন্ধ থাকছে। অচল হয়ে পড়ছে ঢাকা। দেশের অর্থনীতির চাকাও ঠিকমতো ঘুরছে না। বিনিয়োগ কমছে। বেকারত্ব বাড়ছে। এই অবস্থায় একটি জাতীয় নির্বাচনই হতে পারে সমাধানসূত্র। পদত্যাগের অভিপ্রায় বা পদত্যাগ কোনো সুফল বয়ে আনবে না।

লেখক : সাংবাদিক, কলামিস্ট। ডেপুটি এডিটর, জাগো নিউজ। drharun.press@gamil.com

এইচআর/এএসএম