মতামত

মাঠে হাল ধরে সুন্দর করে…

মাঠে হাল ধরে সুন্দর করে…

বাংলার দিগন্ত বিস্তৃত সবুজ মাঠ, নদীর কলকল ধ্বনি, আর সেই শান্ত পরিবেশে কৃষকের কাঁধে লাঙল, হাতে জোয়াল—এই দৃশ্য এক সময়ে ছিল বাংলার চিরাচরিত রূপ। একজোড়া হৃষ্টপুষ্ট বলদ, তাদের গলায় ঘণ্টা, আর কৃষকের দরদি হাতের স্পর্শে মাটি চিরে ফসল ফলানোর স্বপ্ন—এই ছিল বাংলার কৃষি অর্থনীতির ভিত্তি। লাঙল-জোয়াল শুধু মাটি কর্ষণের যন্ত্র ছিল না, এটি ছিল বাংলার গ্রামীণ জীবনের প্রতিচ্ছবি, সংস্কৃতির অবিচ্ছেদ্য অংশ। সময়ের স্রোতে আধুনিক কৃষি প্রযুক্তির আগমনে সেই ঐতিহ্য আজ ক্রমশ ফিকে হয়ে আসছে, বিলুপ্তির পথে।আধুনিক কৃষি ব্যবস্থার হাত ধরে ট্রাক্টর, পাওয়ার টিলারের মতো শক্তিশালী যন্ত্র মাঠে নেমেছে। অল্প সময়ে বিশাল আকারের জমি চাষ করা এখন অনেক সহজ। কৃষকের কাছে সময় এবং শ্রম দুটোই মূল্যবান, তাই তারা ঝুঁকছেন আধুনিক যন্ত্রের দিকে। যেখানে কয়েক দশক আগেও বাংলার গ্রামে গ্রামে দেখা যেত বলদের ধীরলয়ে জমি চষা, লাঙলের ফলা নতুন জীবনের স্পন্দন সৃষ্টি করছে, সেখানে এখন যন্ত্রের তীব্র আওয়াজ আর দ্রুতগতির চাকার দাপট। ঐতিহ্যবাহী লাঙল-জোয়ালের ব্যবহার তাই ক্রমশ হ্রাস পাচ্ছে।

Advertisement

তবে এই পরিবর্তনের পেছনে লুকিয়ে আছে এক দীর্ঘশ্বাস। লাঙল-জোয়ালের সঙ্গে জড়িয়ে ছিল কৃষকের গভীর সম্পর্ক । বলদ শুধু তাদের কাজের সঙ্গী ছিল না, ছিল পরিবারের সদস্যের মতো। কৃষক তাদের নাম ধরে ডাকতেন, তাদের অসুস্থতায় চিন্তিত হতেন, তাদের কষ্টের ভাগ নিতেন। জোয়াল কাঁধে বলদের মাঠের পর মাঠ হেঁটে যাওয়া যেন ছিল এক নীরব কাব্য, জীবন সংগ্রামের প্রতিচ্ছবি। হাল চাষের সময় কৃষকের মুখে শোনা যেত বিভিন্ন লোকগান, যা প্রকৃতি আর মানুষের একাত্মতাকে প্রকাশ করতো। এই প্রথা ছিল পরিবেশবান্ধব। কোনো রাসায়নিক সারের ব্যবহার ছাড়াই মাটি প্রাকৃতিকভাবে উর্বর থাকত, যা দীর্ঘমেয়াদি কৃষির জন্য অপরিহার্য ছিল।আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহার নিঃসন্দেহে উৎপাদন বাড়িয়েছে, কৃষকের জীবনকে কিছুটা হলেও সহজ করেছে। কিন্তু এর বিনিময়ে আমরা হারাচ্ছি আমাদের ঐতিহ্য, আমাদের সংস্কৃতি। আজ হয়তো কালেভদ্রে কোনো গ্রামে লাঙল-জোয়াল চোখে পড়ে। নতুন প্রজন্ম অনেকেই এই যন্ত্রগুলোর ব্যবহার জানে না, বোঝে না এর ঐতিহাসিক তাৎপর্য। তারা ভাবতেই পারে না যে একসময় এই সাধারণ যন্ত্রগুলোই ছিল বাংলার অর্থনীতির মূল চালিকাশক্তি।

আধুনিকতার প্রভাবে এর ব্যবহার কমে গেলেও, এর ঐতিহাসিক এবং পরিবেশগত গুরুত্ব আজও অনস্বীকার্য। আমাদের উচিত এই ঐতিহ্য বাঁচিয়ে রাখার জন্য সম্মিলিত প্রচেষ্টা চালানো, যাতে ভবিষ্যৎ প্রজন্ম তাদের শেকড় চিনতে পারে এবং আমাদের সমৃদ্ধ কৃষি ঐতিহ্য সম্পর্কে জানতে পারে। একদিন, আধুনিক প্রযুক্তির পাশাপাশি লাঙল-জোয়ালের ঐতিহ্যবাহী রূপটিও বাংলার মাঠে টিকে থাকবে, প্রকৃতির সবুজ আর কৃষকের হাসিতে ভরে উঠবে আমাদের সোনার বাংলা।

এই ঐতিহ্য সম্পূর্ণভাবে বিলুপ্তির হাত থেকে বাঁচানো কঠিন, কারণ সময়ের চাকা সবসময় সামনের দিকেই ঘুরে। তবে আমরা অবশ্যই এই ঐতিহ্যের স্মৃতি সংরক্ষণ করতে পারি। আমাদের লোকসংস্কৃতি, সাহিত্য, চিত্রকর্মে লাঙল-জোয়ালের সেই চিরায়ত ছবি ধরে রাখা যেতে পারে। বিভিন্ন গ্রামীণ মেলায়, উৎসবে এর প্রদর্শনের ব্যবস্থা করা যেতে পারে। কৃষি জাদুঘরে স্থান পেতে পারে এই ঐতিহাসিক কৃষি সরঞ্জামগুলো, যা ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে তাদের শেকড়ের সন্ধান দেবে।

Advertisement

সরকার এবং বিভিন্ন বেসরকারি সংস্থা ঐতিহ্যবাহী কৃষি পদ্ধতি সংরক্ষণে কিছু পদক্ষেপ নিতে পারে। কৃষকদের মধ্যে সচেতনতা বৃদ্ধি করা যেতে পারে পরিবেশবান্ধব এই পদ্ধতির উপকারিতা সম্পর্কে। আধুনিক প্রযুক্তির সঙ্গে ঐতিহ্যবাহী পদ্ধতির সমন্বয়ে এমন কিছু উপায় বের করা যেতে পারে, যাতে দুটোই টিকে থাকে।আমরা সেই সোনালি দিন আর ফিরে পাব না, যখন মাঠজুড়ে শুধু লাঙল-জোয়ালের আনাগোনা দেখা যেত। তবে আমাদের মনে রাখতে হবে, এই লাঙল-জোয়াল শুধু কয়েকটি কাঠের টুকরা আর চামড়ার বাঁধন ছিল না। এর সঙ্গে মিশে ছিল বাংলার কৃষকের ঘাম, তাদের স্বপ্ন, আর প্রকৃতির প্রতি তাদের গভীর ভালোবাসা। এই ঐতিহ্য ভুলে যাওয়া মানে আমাদের নিজেদের ইতিহাসকেই অস্বীকার করা।

আধুনিকতার আলো ঝলমলে পথে চলতে গিয়ে আমরা যেন আমাদের শিকড় না ভুলি। উন্নয়নের পাশাপাশি আমাদের ঐতিহ্যও বাঁচিয়ে রাখার চেষ্টা করা উচিত। কোনো এক শান্ত বিকেলে, কোনো গ্রামের মেঠো পথে এখনো শোনা যায় সেই পরিচিত ঘণ্টার টুংটাং, যা আমাদের মনে করিয়ে দেয় এক সময়ের সমৃদ্ধ কৃষি ঐতিহ্যের কথা। কালের গর্ভে হারিয়ে যাওয়ার আগে লাঙল-জোয়ালের সেই নীরব কান্না আজও কোনো নিভৃত কোণে ধ্বনিত হয়, যা শোনার মতো কান আমাদের থাকা প্রয়োজন। আমাদের উচিত কান পেতে সেই হারানো সুর শোনা এবং ঐতিহ্য বাঁচিয়ে রাখার জন্য যথাসাধ্য চেষ্টা করা।

এই ঐতিহ্য হারানোর পেছনে আরও কিছু কারণ রয়েছে। গ্রামীণ জনজীবনের পরিবর্তন, কৃষকের সন্তানদের কৃষিকাজের প্রতি অনীহা এবং কৃষি ঋণের অভাবের মতো বিষয়গুলোও লাঙল-জোয়ালের ব্যবহার কমে যাওয়ার জন্য দায়ী। অনেক কৃষক আর্থিক কষ্টের কারণে বলদ পালন করতে পারেন না অথবা আধুনিক যন্ত্র কেনার জন্য উৎসাহিত হন। ফলে ধীরে ধীরে মাঠ থেকে হারিয়ে যায় এই ঐতিহ্যবাহী কৃষি পদ্ধতি।

তবে এর বিপরীত চিত্রও একেবারে অনুপস্থিত নয়। এখনো কিছু কৃষক তাদের জমিতে লাঙল-জোয়ালের ব্যবহার ধরে রেখেছেন। তারা মনে করেন, এই পদ্ধতিতে চাষ করলে জমির উর্বরতা দীর্ঘস্থায়ী হয় এবং ফসলের গুণগত মানও ভালো থাকে। এছাড়া এটি একটি পরিবেশবান্ধব পদ্ধতি, যা মাটির স্বাস্থ্য রক্ষা করে এবং রাসায়নিক সারের ব্যবহার কমায়। এই কৃষকরা আধুনিকতার স্রোতে গা ভাসাননি, কিন্তু তারা তাদের ঐতিহ্য আঁকড়ে ধরে আছেন।আমাদের উচিত এই ব্যতিক্রমী কৃষকদের সম্মান জানানো এবং তাদের উৎসাহিত করা। তাদের অভিজ্ঞতা ও জ্ঞান নতুন প্রজন্মের কৃষকদের কাছে পৌঁছে দেওয়া প্রয়োজন। কৃষি শিক্ষা পাঠ্যক্রমে ঐতিহ্যবাহী কৃষি পদ্ধতির গুরুত্ব এবং উপকারিতা সম্পর্কে আলোচনা অন্তর্ভুক্ত করা যেতে পারে। এর মাধ্যমে নতুন প্রজন্ম জানতে পারবে তাদের পূর্বপুরুষদের কৃষি কৌশল সম্পর্কে এবং উপলব্ধি করতে পারবে এর ঐতিহাসিক ও পরিবেশগত তাৎপর্য।পরিশেষে বলা যায়, লাঙল-জোয়াল দিয়ে হাল চাষ শুধু একটি কৃষি পদ্ধতি নয়, এটি বাংলার সংস্কৃতির একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ। আধুনিকতার প্রভাবে এর ব্যবহার কমে গেলেও, এর ঐতিহাসিক এবং পরিবেশগত গুরুত্ব আজও অনস্বীকার্য। আমাদের উচিত এই ঐতিহ্য বাঁচিয়ে রাখার জন্য সম্মিলিত প্রচেষ্টা চালানো, যাতে ভবিষ্যৎ প্রজন্ম তাদের শেকড়কে চিনতে পারে এবং আমাদের সমৃদ্ধ কৃষি ঐতিহ্য সম্পর্কে জানতে পারে। একদিন, আধুনিক প্রযুক্তির পাশাপাশি লাঙল-জোয়ালের ঐতিহ্যবাহী রূপটিও বাংলার মাঠে টিকে থাকবে, প্রকৃতির সবুজ আর কৃষকের হাসিতে ভরে উঠবে আমাদের সোনার বাংলা।

Advertisement

লেখক : গবেষক। sadia15.jnu@gmail.com

এইচআর/এমএফএ/জিকেএস