দেশজুড়ে

৯৭ বর্গকিলোমিটারের নগরীতে ৪৮৮ কিলোমিটার ড্রেন, তবুও জলাবদ্ধতা!

৯৭ বর্গকিলোমিটারের নগরীতে ৪৮৮ কিলোমিটার ড্রেন, তবুও জলাবদ্ধতা!

প্রায় ৯৭ বর্গকিলোমিটার আয়তনের রাজশাহী শহরের পয়োনিষ্কাশনের জন্য তৈরি করা হয়েছে ৪৮৮.৫৯ কিলোমিটার ড্রেন। তবে শুধু গত রাতের বৃষ্টিতেই নগরজুড়ে তৈরি হয় জলাবদ্ধতা। যদিও ৭-৮ ঘণ্টার মধ্যেই সেই পানি নেমে গেছে। তবে এত দীর্ঘ ড্রেন থাকার পরও কার ব্যর্থতায় এমন জলজট, এ নিয়ে তৈরি হয়েছে প্রশ্ন।

Advertisement

রাজশাহী সিটি করপোরেশনের তথ্যমতে, রাজশাহী সিটি করপোরেশনের মোট ড্রেনের দৈর্ঘ্য ৪৮৮.৫৯ কিলোমিটার। এর মধ্যে প্রাইমারি ড্রেন ১২.৬৫ কিলোমিটার। সেকেন্ডারি ড্রেন ৮১.৩২ কিলোমিটার ও টারশিয়ারি ড্রেন ৩৯৪.৬২ কিলোমিটার। এসব ড্রেন নির্মাণ করতে সিটি করপোরেশনকে খরচ করতে হয়েছে কোটি কোটি টাকা।

রাজশাহী আবহাওয়া অফিসের তথ্যমতে, রাজশাহীতে সর্বোচ্চ বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয় ২০২৩ সালের ৫ অক্টোবর ১৬৫.৩ মিলিমিটার। এরপর এত বৃষ্টি আর হয়নি। চলতি বছরের মার্চ থেকে মে মাসের ২০ তারিখ পর্যন্ত বৃষ্টিপাত হয়েছে ১৩৮ দশমিক ২ মিলিমিটার। এরমধ্যে মার্চ মাসে ৩ দিনে বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয়েছে ৭ দশমিক ৮ মিলিমিটার। এপ্রিলের ৫ দিনে বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয়েছে ৪৩ দশমিক ৯ মিলিমিটার। চলতি মে মাসের ৮ দিনে বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয়েছে ১৭০ দশমিক ৫ মিলিমিটার। এরমধ্যে গত ২৪ ঘণ্টায় (২১ মে রাতে) সর্বোচ্চ বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয়েছে ৮৪ মিলিমিটার।

আরও পড়ুন-

Advertisement

ঢাকায় বৃষ্টিতে জলাবদ্ধতায় জনদুর্ভোগ মুখ খুললেই মেয়র বলতেন ‘ব্যাডা তুমি বেশি বুঝো?’ অধিকাংশ খাল-বিল ভরাট, সামান্য বৃষ্টিতেই তলিয়ে যায় নগর

গত ২৪ ঘণ্টায় রেকর্ড পরিমাণ বৃষ্টির পর রাজশাহী নগরীজুড়ে ব্যাপক জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হয়। ৮৪ মিলিমিটার বৃষ্টিতেই শহরজুড়ে দেখা দেয় জলাবদ্ধতা। নগরীর অনেক রাস্তায় ছোট যানবাহন চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। ড্রেন উপচে নিচু এলাকার অনেক বাড়িতেও ঢুকে যায় পানি।

খোঁজ নিয়ে দেখা গেছে, রাজশাহী নগরীতে একটু বেশি পরিমাণে বৃষ্টি হলেই দেখা দেয় জলাবদ্ধতা। বিশেষ করে ৩০ মিলিমিটার বৃষ্টি হলেই সাহেববাজার, উপশহর, কয়েরদাড়া, দাসপুকুর, মেডিকেল কলেজ, সিঅ্যান্ডবির মোড়, বালিয়া পুকুরসহ বেশকিছু এলাকা প্লাবিত হয়। অস্বাভাবিক এই জলাবদ্ধতার কারণ খুঁজতে গিয়ে উঠে আসছে অনেকগুলো বিষয়।

ভুক্তভোগী নগরবাসীর অভিযোগ, রাজশাহীতে এমনিতেই বৃষ্টির পরিমাণ কম। এতেই যদি এমন পরিস্থিতি তৈরি হয়, তাহলে নিয়মিত বৃষ্টি হলে দুর্ভোগ অসহনীয় পর্যায়ে পৌঁছাবে।

সিঅ্যান্ডবি মোড়ের স্থানীয় বাসিন্দা রহমত আলী বলেন, বৃষ্টি শুরু হলেই মনে হয় এই বুঝি ঘরবন্দি হয়ে গেলাম। আমার ছোট একটা মুদি দোকান আছে। কিন্তু রাস্তায় এমন পানি জমে যে, দোকানে আসতেই কষ্ট হয়। দোকানের সামনেই হাঁটুসমান পানি জমে থাকে। ক্রেতারাও ভয়ে আসে না, পা ভিজিয়ে কেউ মালামাল নিতে চায় না। বেচাকেনা একদম বন্ধ হয়ে যায়। এরকম দু-একদিন থাকলে পরিবার চালানোই কঠিন হয়ে পড়ে।

Advertisement

এলাকার শিক্ষার্থী ফাতেমা আক্তার বলেন, প্রতিদিন স্কুলে যেতে হয়। কিন্তু বৃষ্টির দিনে বাড়ি থেকে বের হলেই দেখি চারপাশে পানি। কখনো স্যান্ডেল আটকে যায় কাদায়, আবার কখনো পড়ে গিয়ে পুরো শরীর ভিজে যায়। এতে মন খারাপ হয়, ক্লাসেও মন বসে না। মনে হয় এই দুর্ভোগ থেকে বাঁচার কোনো রাস্তা নেই।

স্থানীয় স্কুলশিক্ষক শিরিন আক্তার বলেন, বাড়ির আশপাশে পানি জমে থাকায় রান্নাঘর পর্যন্ত যেতে সমস্যা হয়। জমে থাকা পানিতে মশার উপদ্রব বেড়ে ডেঙ্গু, চিকুনগুনিয়া রোগের শঙ্কা তৈরি হয়। বাচ্চারা বাইরে খেলতে পারে না। স্কুলে গেলেও শিক্ষার্থীদের উপস্থিতি কমে যায়।

রিকশাচালক আলাল শেখ বলেন, পানি জমে থাকলে রিকশা চালানো খুবই ঝুঁকিপূর্ণ। কখন কোথায় চাকা আটকে যায় বলা যায় না। যাত্রী তুলতে গেলেই ভয় হয় রিকশা উল্টে না যায়। এমন অবস্থায় কেউ রিকশায় উঠতেও চায় না। আয়-রোজগার একদম বন্ধ হয়ে যায়।

সিঅ্যান্ডবি মোড়ের স্থানীয় ব্যবসায়ী মামুন হোসেন বলেন, আমাদের দোকানের সামনে যে রাস্তা, সেটার পাশে কোনো ড্রেনই নেই। পানি নামার পথ নেই বলেই দিনের পর দিন জমে থাকে। কাদা, আবর্জনা, গন্ধ সব মিলিয়ে মানুষ কাছে আসতেই চায় না। দোকান বন্ধ করে বাড়ি যেতে হয়। ব্যবসা শেষ হয়ে যাচ্ছে। বারবার অভিযোগ করেও কোনো ফল পাইনি। প্রশাসন যেন আমাদের কথা শুনেও না শোনার ভান করে।

শহরজুড়ে থৈ থৈ পানি। সিটি করপোরেশনের সেবার মান নিয়েও উঠেছে প্রশ্ন। রাজশাহী সিটি করপোরেশনের প্রকৌশল বিভাগ এরই মধ্যে বেশ কিছু কারণ খুঁজে বের করেছে।

সিটি করপোরেশনের ভারপ্রাপ্ত প্রধান প্রকৌশলী আহমদ আল মঈন বলেন, ড্রেনগুলোতে মানুষ ভারী বর্জ্য ফেলছে। ফলে ড্রেনগুলো বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। তাই বৃষ্টির পানি সরতে দেরি হচ্ছে। আমাদের পরিচ্ছন্ন বিভাগ নিয়মিত ড্রেন পরিষ্কার করছে। কিন্তু মানুষ সচেতন না হলে এটি থেকে মুক্তি পাওয়া যাবে না।

তিনি আরও বলেন, ড্রেনগুলোতে আমরা বালু, ইট, পলিথিনসহ বেশ কিছু ভারী আবর্জনা পাচ্ছি। এগুলো নিয়ে মানুষকে সচেতন করার উদ্যোগ নিচ্ছি। মানুষ এগুলো থেকে সরে এলেই আমাদের যা ড্রেন আছে পানি সঙ্গে সঙ্গে চলে যাবে। কোথাও জলাবদ্ধতা হবে না।

নগর পরিকল্পনাবিদরা বলছেন, রাজশাহী শহরের যে ড্রেনেজ ব্যবস্থা, তাতে এমন জলাবদ্ধতা তৈরি হওয়ার কথা নয়। নিয়মিত ড্রেন পরিষ্কার না করা এবং সংশ্লিষ্ট বিভাগের দায়িত্বহীনতা এজন্য অনেকাংশে দায়ী।

রুয়েটের নগর ও অঞ্চল পরিকল্পনা বিভাগের প্রফেসর ড. মো. আবদুল ওয়াকিল বলেন, রাজশাহী নগরীতে জলাবদ্ধতার বেশ কয়েকটি প্রধান কারণ আছে। তার মধ্যে অন্যতম হলো রাজশাহী নগরীর ড্রেনের পানি উত্তর দিকে বারোনই নদে পড়ে। এটি ফেলার কারণে ড্রেনের পানির স্রোত কেমন সেটি দেখা দরকার। এছাড়া রাস্তার পানি ড্রেনে পড়ার ক্ষেত্রেও বাধা হয়। এগুলো যথাসময়ে পরিষ্কার করতে হবে। পাশাপাশি প্রাকৃতিক যে পুকুরগুলোতে বৃষ্টির পানি জমতো সেগুলো ভরাট হওয়ার কারণেও পানি নিষ্কাশনে দেরি হয়। এতে করেও জলাবদ্ধতা হয়। এসব দিকে বিশেষ নজর দিলেই জলাবদ্ধতা অনেকটা কমে আসবে।

এফএ/এমএস