সিরাজুল ইসলাম
Advertisement
আশ্রয়ণ প্রকল্প সেনাবাহিনী করবে জেনে স্বস্তি পেয়েছিলাম’-কথাটি আর কারো নয়, স্বয়ং প্রধান উপদেষ্টা প্রফেসর ড. মুহাম্মদ ইউনূসের। রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ কর্ণধারের এই কথার মধ্যদিয়ে যেমন দেশের সেনাবাহিনীর প্রতি আস্থা ও ভরসার বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে, তেমনি এই বাহিনীকে নোবেল বিজয়ী এই মানুষটি দারুনভাবে সম্মানিত করেছেন। সেনাবাহিনীর দায়িত্ব এখন এই সম্মান ধরে রাখা। আশা করা যায়- সবসময়ের মতো ভবিষ্যতেও সেনাবাহিনী দুর্নীতির উর্ধ্বে থাকবে; থাকবে আমাদের ভরসার কেন্দ্রবিন্দু হয়ে।
প্রধান উপদেষ্টা আসলে কী বলতে চেয়েছেন? একদম সহজ করে বলা যায়- নোয়াখালী, ফেনী কুমিল্লা ও চট্টগ্রাম অঞ্চলে বন্যা ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের আশ্রয়ণ প্রকল্প বাস্তবায়ন করতে গিয়ে সেনাবাহিনীর হাতে কোনো দুর্নীতি হয়নি। প্রকল্প বাস্তবায়ন করতে যে টাকা বরাদ্দ দেয়া হয়েছিল তার চেয়ে অনেক কম টাকায় প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হয়েছে। অথচ এমন প্রকল্পে পুকুর চুরি হয়। আশ্রয়ণ প্রকল্পে যে অর্থের নয়-ছয় হওয়ার আশংকা ছিল, সেনাবাহিনীর মাধ্যমে তা বাস্তবায়িত হওয়ায় সেই দুর্নীতি হয়নি। প্রকল্পের জন্য বরাদ্দ করা ৫০ কোটি টাকার পুরোটা খরচ না করেই ৩০০টি বাড়ি নির্মাণ করা সম্ভব হয়েছে এবং তা আনুষ্ঠানিকভাবে গত ৩০ এপ্রিল বরাদ্দ দেয়া হয়েছে। প্রধান উপদেষ্টা ঘর বিতরণ অনুষ্ঠানে অকপটে বলেছেন, সেনাবাহিনী ছিল বলেই এই প্রকল্পে দুর্নীতিটা হয়নি।
স্মরণ করা যেতে পারে- গত ২০ আগস্ট থেকে শুরু হয় ফেনী, নোয়াখালী, কুমিল্লা, চট্টগ্রাম ও সিলেটসহ ১১ জেলায় ভয়াবহ বন্যা। প্রলয়ংকারী বন্যার তাণ্ডবে বাস্তুচ্যুত হয় পাঁচ লাখেরও বেশি মানুষ। এই বন্যায় প্রায় ৫৮ লাখ মানুষ সরাসরি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে অবকাঠামো, বাড়িঘর, কৃষি ও মৎস্য খাত। এসব ক্ষয়ক্ষতি কাটিয়ে উঠতে দুর্গত জনগোষ্ঠীর জন্য জরুরি ও ধারাবাহিক মানবিক সহায়তা প্রয়োজন ছিল। সেই প্রয়োজন মেটাতে গিয়ে সরকার অর্থ বরাদ্দ করে যার বিনিময়ে নির্মিত হয় ৩০০ ঘর।
Advertisement
আশ্রয়ণ প্রকল্পে বরাদ্দ ৫০ কোটি টাকা দেয়া হলেও এর অর্ধেক দিয়ে ৩০০ ঘর নির্মাণ করেছে সেনাবাহিনী। আর এ কাজের জন্য অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস সেনাবাহিনীকে ধন্যবাদ জানিয়েছেন। ৩০ এপ্রিল সকাল সাড়ে ১০টায় প্রধান উপদেষ্টার তেজগাঁওয়ের কার্যালয়ে ভার্চুয়াল অনুষ্ঠানের মাধ্যমে এসব ঘর বিতরণ করা হয়। ঘরের চাবি বিতরণের সময় প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয় থেকে ভার্চুয়ালি যুক্ত হন ড. মুহাম্মদ ইউনুস ও সেনাপ্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামানসহ সংশ্লিষ্টরা।
অনুষ্ঠানে প্রধান উপদেষ্টা বলেন, ‘২০২৪ সালে আমরা যখন সরকারের দায়িত্ব গ্রহণ করি তখন সঙ্গে সঙ্গে বন্যা শুরু হয়। ঠিক বুঝতে পারছিলাম না এ জায়গায় কী বন্যা হবে। অন্যান্য বছর যে বন্যা হয়, এটা সম্পূর্ণ ভিন্ন জায়গার বন্যা। এটা কত গভীরভাবে মানুষকে ক্ষতিগ্রস্ত করবে, সে সম্পর্কে কোনো ধারণা ছিল না। বরং আন্দাজ করা হয়েছিল যে, বন্যা তাড়াতাড়ি চলে যাবে। তবে দিন যত যাচ্ছিল এটা কঠিন হয়ে যাচ্ছিল।’
প্রধান উপদেষ্টা বলেন, ‘বন্যা বেড়ে যাচ্ছিল। সবাই ত্রাণ নিয়ে দৌড়াদৌড়ি করছে, সাহায্যের জন্য সারাদেশ ঝাঁপিয়ে পড়েছিল। এটা যে কত বড় বন্যা ছিল তা বুঝতে পেরেছি বন্যা চলে যাওয়ার অনেক পরে। বন্যায় যারা বাড়িঘর হারিয়েছিল, তাদের কোথাও যাওয়ার কোনো জায়গা ছিল না। নানাভাবে প্রস্তাব আসছিল, বাড়ি নির্মাণের জন্য টাকা দিতে হবে। টাকা দেয়ার ব্যাপারে আমি একটু শক্ত অবস্থান নিয়েছিলাম। টাকা দিতে গেলে এই টাকার ভাগ-বাটোয়ারা অনেক রকম হয়ে যাবে। যারা প্রাপ্য তাদের হাতে পৌঁছাবে না। তখন প্রস্তাব এসেছিল যে, আশ্রয়ণ প্রকল্পের মাধ্যমে বাড়ি নির্মাণ করার। সেই প্রকল্পের বিষয়ে জানা ছিল না, তবে নামটা জানা ছিল। তখন ভাবলাম যে, এটা কী করা যায়! পরে জানলাম এটা সেনাবাহিনী করবে। তখন স্বস্তি পেলাম, আসলে টাকাটা সঠিকভাবে ব্যবহার হবে।’
সেনাবাহিনীসহ সবার সহযোগিতায় ঘুরে দাঁড়িয়েছে বন্যা কবলিতরা। এ প্রসঙ্গে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান বলেন, বেশি ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারগুলোর জন্য গৃহনির্মাণ বরাদ্দ দেয়া অর্থের অর্ধেকে নির্মাণ কাজ শেষ করায় সেনাবাহিনীকে বিশেষ ধন্যবাদ। কোনো রকমের রাখঢাক না রেখেই ড. ইউনূস বলেন, ‘ভালো লাগছে যে, টাকাটার সঠিক ব্যবহার হয়েছে। ঘরটাও সঠিকভাবে নির্মাণ হয়েছে। অনেক সময় টাকা ব্যবহার করা হলেও গুণগতমান ঠিক হয় না। আজকে গুণগতমানের ব্যাপারেও আশ্বস্ত হলাম। আমরা যে টাকা দিয়েছিলাম তার অর্ধেক টাকাতে কাজটা হয়েছে। উল্টো খবর। সাধারণত যে টাকা দেওয়া হয়, তার দ্বিগুণ/তিনগুণ অর্থ চাওয়া হয়। অথচ, এখানে যা দেয়া আছে তার অর্ধেক ব্যবহার হয়েছে। এটি একটি আনন্দের খবর।’
Advertisement
নোবেল বিজয়ী ড. ইউনূস আরো বলেন, সেনাবাহিনীর এই সততার মাধ্যমে সঠিক এবং সৎভাবে কাজ করার একটি দৃষ্টান্ত স্থাপিত হলো। এটি সবাইকে উদ্বুদ্ধ করবে। বন্যায় ক্ষতিগ্রস্তদের মাথা গোজার ঠাঁই হয়েছে, এবার সন্তানদের উন্নত ভবিষ্যতের দিকে নজর দেয়ার পরামর্শ দেন প্রধান উপদেষ্টা।
প্রধান উপদেষ্টার নির্দেশনায় গত বছর বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত ৩০০টি পরিবারের জন্য বিশেষ আবাসন প্রকল্পের মাধ্যমে ঘর নির্মাণের ৫০ কোটি টাকা বরাদ্দ দেয়া হয়। ৫০ কোটি টাকা বরাদ্দ পেলেও সেনাবাহিনীর ২৪ ও ৩৩ ডিভিশনের কর্মকর্তারা মাত্র ২৪ কোটি ৯৮ লাখ ৯৫ হাজার টাকা ব্যয়ে ৩০০টি ঘরের নির্মাণ কাজ শেষ করেন। এসব ঘরের মধ্যে ফেনী জেলায় ১১০টি, নোয়াখালী জেলায় ৯০টি, কুমিল্লা জেলায় ৭০টি ও চট্টগ্রাম জেলায় ৩০টি ঘর বরাদ্দ দেয়া হয়।
ঘরগুলো যেন দুর্যোগ সহনীয় ও টেকসই হয়- সে লক্ষ্যে স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তর ও সশস্ত্র বাহিনী বিভাগের সহযোগিতায় দুটি ডিজাইন প্রস্তুত করা হয়। প্রতিটি ডিজাইনে ২টি মূল কক্ষসহ কমন স্পেস, টয়লেট ও রান্নাঘরসহ বারান্দা রয়েছে। প্রথম ডিজাইনের ঘরের আয়তন ৪৯২ বর্গফুট এবং প্রাক্কলিত টাকার পরিমাণ ৭ লাখ ২৫ হাজার ৬৯৪ টাকা। আর দ্বিতীয় ডিজাইনের ঘরের আয়তন ৫০০ বর্গফুট এবং প্রাক্কলিত টাকার পরিমাণ ৭ লাখ ২৬ হাজার ৬৭৮ টাকা। উপকারভোগীদের নিজ বসতভিটার স্থানের সাথে সামঞ্জস্য রেখে কোনো একজন উপকারভোগীর জন্য যেখানে যে ডিজাইন প্রযোজ্য হবে সেভাবেই ঘরগুলো নির্মাণ করা হয়েছে।
ড. ইউনূসের বক্তব্যের অতি আকর্ষণীয় অংশবিশেষ তুলে ধরে এ লেখা শেষ করতে চায়। যেমনটি তিনি বলেছেন, ‘ঘর নির্মাণের এই টাকা দিতে গেলে ভাগবাটোয়ারা হয়ে যাবে। আসলে যারা প্রাপ্য তাদের হাতে পৌঁছাবে কিনা সন্দেহ আছে। এই টাকা দিতে গেলে ভাগবাটোয়ারা হয়ে যাবে। আসলে যারা প্রাপ্য, তাদের হাতে পৌঁছাবে কিনা সেটাই বড় প্রশ্ন।’
প্রধান উপদেষ্টার এই বক্তব্যের মধ্যদিয়ে সেনাবাহিনীর প্রতি তার পরম আস্থার কথা ফুটে উঠেছে, ফুটে উঠেছে তার ভালোবাসার কথা। এটা সেনাবাহিনীর জন্য বিরাট সম্মানের বিষয়। আসলে এই বক্তব্য শুধু প্রধান উপদেষ্টার আস্থা ও ভালোবাসার কথা নয়, এই বক্তব্য পুরো জাতির মনোভাব প্রকাশ করেছে। এটি সারা দেশবাসীর কথা। এই দেশের জনগণ সেনাবাহিনীকে তাদের পরম আস্থা ও ভরসাস্থল মনে করে। সেনাবাহিনী এই দেশের সাধারণ মানুষের পরম আত্মীয়। নিশ্চয় আমাদের দেশপ্রেমিক সেনাবাহিনী তাদের মর্যাদা সবসময় সুমন্নত রাখবে। শত ত্যাগের বিনিময়েও এই মর্যাদা ভুলুণ্ঠিত হতে দেবে না। নিশ্চয় আমাদের এই বিশ্বাস তারা যত্নের সঙ্গে লালন করবে, কারণ তারা আমাদের এই মাটিরই সন্তান।
(লেখক সিনিয়র সাংবাদিক ও কলামিস্ট)
এইচআর/জিকেএস