এক সময় গ্রামের মেঠোপথ কিংবা শহরের অলিগলিতে, সকালে চোখ মেললেই শোনা যেত টিংটিং শব্দ। কিশোর থেকে শুরু করে মধ্যবয়সী মানুষ ছুটে চলতেন সাইকেল চালিয়ে। তখন সাইকেল ছিল জীবনের এক অবিচ্ছেদ্য অংশ। ইঞ্জিনচালিত বাহনের আধিপত্যে এই অভ্যাস হারিয়ে যেতে বসেছিল ঠিকই, তবে সময়ের প্রয়োজনে দু'চাকার এই বাহনকে বিলুপ্ত করা যায়নি।
Advertisement
এটি থেকে গেছে আমাদেরই প্রয়োজনে। তবে শুধুমাত্র যাতায়াতের মাধ্যম হিসেবে নয়, বরং স্বাস্থ্য সচেতনতা, পরিবেশবান্ধব চিন্তা ও সচেতন জীবনধারার একটি প্রতীক হয়ে উঠেছে।
আজকের ব্যস্ত নগরজীবনে যান্ত্রিকতার চাপে হাঁপিয়ে উঠেছে মানুষ। অনিয়মিত জীবনযাপন, অস্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাস, শরীরচর্চার অনুপস্থিতি আমাদের ঠেলে দিচ্ছে বিভিন্ন জটিল রোগের দিকে। ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপ, হৃদরোগ বা মানসিক উদ্বেগ এসবের মূলে রয়েছে একঘেয়ে, নিষ্ক্রিয় জীবনযাপন। এই বাস্তবতা থেকে বেরিয়ে আসতে অনেকেই নতুন করে চিন্তা করছেন, কীভাবে নিজেকে সচল রাখা যায়? সাইকেল চালানো হতে পারে সেই উত্তরের একটি কার্যকর পথ।
বিশেষজ্ঞদের মতে, প্রতিদিন মাত্র ৩০ মিনিট সাইকেল চালালেই শরীরে রক্ত চলাচল স্বাভাবিক হয়, বিপাকক্রিয়া উন্নত হয়, ওজন নিয়ন্ত্রণে থাকে এবং ঘুমের মান বেড়ে যায়। পাশাপাশি মানসিক চাপ কমে, মন থাকে সতেজ। সকালে খোলা বাতাসে সাইকেল চালানোর অভ্যাস মানসিক প্রশান্তি এনে দেয়, যা দিনের শুরুতেই একজন মানুষকে ইতিবাচক করে তোলে।
Advertisement
শুধু স্বাস্থ্য নয়, সাইকেল চালানো একটি পরিবেশবান্ধব অভ্যাসও বটে। জ্বালানি নির্ভর নয় বলে এটি কার্বন নিঃসরণ করে না, শব্দদূষণ ঘটায় না। বৈশ্বিক উষ্ণতা ও জলবায়ু পরিবর্তনের যে সংকটময় সময় পার করছি, সেখানে সাইকেল চালানো মানে কেবল নিজের শরীরের যত্ন নয়, বরং এটি একটি সামাজিক দায়িত্ব।
ইউরোপের অনেক দেশ, যেমন নেদারল্যান্ডস, ডেনমার্ক কিংবা জার্মানি, ইতোমধ্যেই সাইকেলবান্ধব শহর ও রাস্তা গড়ে তুলেছে। বাংলাদেশেও রাজধানীর কিছু এলাকায় সাইকেল লেন চালুর উদ্যোগ দেখা গেছে, যদিও সেগুলোর রক্ষণাবেক্ষণ ও সচেতনতা এখনো প্রয়োজনীয় মাত্রায় পৌঁছায়নি।
অফিসগামী কিছু মানুষ এখন যানজট ও গণপরিবহনের ভোগান্তি এড়িয়ে সাইকেলকেই বেছে নিচ্ছেন। এতে করে কর্মস্থলে পৌঁছানো যেমন সহজ হচ্ছে, তেমনি দিনের শুরুটা হচ্ছে এক ধরনের ব্যায়ামের মাধ্যমে। যান্ত্রিক পরিবেশে আটকে থাকা কর্মজীবীদের জন্য এটি হতে পারে স্বাস্থ্য সচেতনতার এক চমৎকার উপায়।
আরেকটি দিক হলো, সাইকেল জীবনের শৃঙ্খলা গড়ে তোলে। প্রতিদিন নির্দিষ্ট সময়ে সাইকেল চালানোর অভ্যাস ধীরে ধীরে জীবনের অন্যান্য দিকেও ইতিবাচক প্রভাব ফেলে। এটি এক ধরনের রুটিন তৈরি করে, যা জীবনকে করে আরও সংগঠিত।
Advertisement
ঢাকার মত ব্যস্ত শহরে অনেকেই ছুটির দিনে বেরিয়ে পড়েন সাইকেল নিয়ে। ধানমণ্ডি লেক, হাতিরঝিল, পার্ক এলাকা কিংবা শহরের বাইরের কিছু শান্ত প্রাকৃতিক এলাকায় ঘুরে আসেন। এটি যেমন শরীরচর্চা, তেমনি মানসিক রিফ্রেশমেন্টও বটে। বর্তমানে বেশ কিছু সাইক্লিং ক্লাব গড়ে উঠেছে ঢাকায়। বিডি সাইকেলিস্ট, সাইঅএল লাইফ বাংলাদেশ ক্লাবগুলো অন্যতম। তরুণ-তরুণীরা দল বেঁধে দূরপাল্লায় সাইকেল চালাতে যান, এতে সামাজিক বন্ধন যেমন দৃঢ় হয়, তেমনি গড়ে ওঠে এক নতুন জীবনীশক্তি।
তবে এখনো কিছু চ্যালেঞ্জ রয়ে গেছে। সড়কে সাইকেল চালানোর নিরাপত্তা, পর্যাপ্ত লেন না থাকা, এবং গণসচেতনতার অভাব সাইক্লিং সংস্কৃতিকে পুরোপুরি বিকশিত হতে দিচ্ছে না। এসব বিষয়ে সরকার, সিটি করপোরেশন এবং বেসরকারি উদ্যোক্তাদের সমন্বিত উদ্যোগ প্রয়োজন। বিশেষ করে স্কুল-কলেজ পর্যায়ে সাইকেল চালানোকে উৎসাহিত করা গেলে নতুন প্রজন্মের মধ্যে এটি সহজেই জনপ্রিয় হয়ে উঠতে পারে।
একটি সাইকেল আমাদের শুধু চলার গতি দেয় না, এটি জীবনকে করে সচল, শরীরকে রাখে সুস্থ এবং মনকে করে উৎফুল্ল। যান্ত্রিক শহরের ক্লান্তিতে একটুখানি আরাম, একটুখানি স্বস্তির জন্য যদি আপনার পাশে থাকে একটি সাইকেল, তবে তা হয়ে উঠতে পারে আপনার অন্যতম প্রিয় সঙ্গী। তাই সুস্থ ও সচেতন জীবনের জন্য নিয়মিত সাইকেল চালানোর অভ্যাস গড়ে তুলুন।
তথ্যসূত্র: হার্ভার্ড হেলথ পাবলিশিং, মায়ো ক্লিনিক, ডব্লিউএইচও, ইউরোপিয়ান সাইক্লিস্টস ফেডারেশন
এএমপি/জিকেএস