রেলের আয় বাড়াতে ৩৫৮ কোটি টাকায় ১২৫টি লাগেজ ভ্যান কেনা হয়েছে। যাত্রীবাহী ট্রেনের সঙ্গে পণ্যবাহী এসব লাগেজ ভ্যান যুক্ত করা হয়েছে। তবে স্বল্প সংখ্যক চালু হলেও বেশিরভাগই অব্যবহৃত অবস্থায় পড়ে আছে। এতে এক সময়ের আলোচিত ডেমু ট্রেন প্রকল্পের মতো লাগেজ ভ্যান প্রকল্পও মুখ থুবড়ে পড়েছে। এখন এসব লাগেজ ভ্যান বেসরকারি খাতে ইজারা দেওয়ার পরিকল্পনা করছেন রেল কর্তারা।
Advertisement
আওয়ামী লীগ সরকার ২০১৩ সালে অপরিকল্পিতভাবে ৬৫৪ কোটি টাকা ব্যয়ে ২০টি ডেমু ট্রেন আমদানি করে। এ ডেমু ট্রেন ৩০ বছর সার্ভিস দেওয়ার কথা থাকলেও ৫ থেকে ৭ বছর পরই অকেজো হতে থাকে। ২০২১ সালের মধ্যে সবগুলো ট্রেন পরিত্যক্ত ঘোষণা করা হয়। এতে সরকারের বিশাল অঙ্কের অর্থের অপচয় হয়।
এবার ডেমু ট্রেনের মতো অবস্থা হতে চলেছে ৩৫৮ কোটি টাকায় ১২৫টি লাগেজ ভ্যানের। আমদানিকৃত লাগেজ ভ্যানের মাত্র ৫% ব্যবহার হচ্ছে, বাকিগুলো অব্যবহৃত অবস্থায় পড়ে আছে। লাগেজ ভ্যান আমদানি রেলের অপরিকল্পিত ব্যয় ও এর পেছনে বিগত সরকারের দুর্নীতির সংশ্লিষ্টতা রয়েছে কি না সেটিও খতিয়ে দেখার দাবি জানিয়েছেন অনেকে।
রেলের আয় বৃদ্ধির জন্য এসব লাগেজ ভ্যান কিনলেও বাস্তব চিত্র ভিন্ন। পণ্যবাহী স্পেশাল লাগেজ ভ্যান চালু করে পণ্য পরিবহনের ভাবনা ছিল রেলওয়ের। কিন্তু রেলওয়ে কর্মকর্তারা পরবর্তীতে ভেবে দেখেন এতে লাভ হবে না, তাই সেটি করেননি। ফলে দীর্ঘদিন এসব লাগেজ ভ্যান অব্যবহৃত অবস্থায় ফেলে রাখা হয়।
Advertisement
পরে ২০২৪ সালের মে মাসে এসব লাগেজ ভ্যানের মধ্যে থেকে কিছু সংখ্যক আন্তঃনগর ট্রেনে সংযুক্ত করা হয়। এতেও সফলতার দেখা মেলেনি। সেসব আন্তঃনগর ট্রেনে লাগেজ ভ্যান সংযুক্ত করা হয়েছে এসব ট্রেনের প্রথম ও শেষ স্টেশনে শুধু মাত্র মালামাল ওঠানো-নামানো হয়। অন্য স্টেশনগুলোতে যাত্রাবিরতি থাকলেও মালামাল ওঠা-নামার অনুমতি নেই। ফলে ইচ্ছা থাকলেও এসব স্টেশন এলাকার ব্যবসায়ী বা সাধারণ মানুষ এসব ট্রেনের লাগেজ ভ্যানে মালামাল পরিবহন করতে পারছেন না। যাত্রাবিরতির স্টেশনগুলো থেকে লাগেজ ভ্যানে মালামাল পরিবহন করা হলে রেলের আয় বাড়তো।
এরপর ২০২৪ সালের অক্টোবর মাসে খুলনা-ঢাকা, পঞ্চগড়-ঢাকা ও চাঁপাইনবাবগঞ্জ-ঢাকা রুটে তিনটি কৃষি পণ্যবাহী স্পেশাল ট্রেন চালু করা হয়। এ ট্রেনে ৭টি লাগেজ ভ্যান সংযুক্ত করা হয়। কিন্তু কৃষি পণ্যবাহী স্পেশাল ট্রেন লাভের মুখ দেখেনি। দুই সপ্তাহের ব্যবধানে একে একে বন্ধ হয়ে যায় কৃষিপণ্য স্পেশাল ট্রেন।
রেলওয়ে সূত্রে জানা যায়, ২০২৩ সালের সেপ্টেম্বর মাসে ১২৫টি লাগেজ ভ্যান চীন থেকে ৩৫৮ কোটি টাকায় আমদানি করা হয়। এর আগে লাগেজ ভ্যান কিনতে ২০২০ সালে ৩১ আগস্ট তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকার চীনের সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ হয়। প্রতিটি ব্রডগেজ লাগেজ ভ্যান ৩ কোটি ৫ লাখ, মিটার গেজ লাগেজ ভ্যানের ২ কোটি ৪৫ লাখ মূল্য নির্ধারণ করা হয়। ১২৫টি লাগেজ ভ্যানের মধ্যে ৭৫টি মিটার গেজ ও ৫০টি ব্রডগেজ রয়েছে। এরমধ্যে ২৮টি রেফ্রিজারেটর লাগেজ ভ্যান আছে।
পাকশী বিভাগীয় পরিবহন কর্মকর্তার কার্যালয় সূত্রে জানা যায়, ১২৫টি নতুন লাগেজ ভ্যানের মধ্যে পশ্চিমাঞ্চল রেলওয়েতে ৫০টি এবং পূর্বাঞ্চল রেলওয়েকে ৭৫টি বরাদ্দ দেওয়া হয়। পশ্চিমাঞ্চল রেলওয়ের ৫০টি লাগেজ ভ্যানের মধ্যে এখন ১৫টি লাগেজ ভ্যান ১৫টি আন্তঃনগর ট্রেনে সংযুক্ত করা হয়েছে। বাকি ৩৫টি লাগেজ ভ্যান অব্যবহৃত অবস্থায় ঈশ্বরদী রেলওয়ে জংশন, ঈশ্বরদীর রূপপুর স্টেশন ও পার্বতীপুর জংশন স্টেশনে রয়েছে। অব্যবহৃত ৩৫টি লাগেজ ভ্যানের মধ্যে ১২টি রয়েছে রেফ্রিজারেটেড (শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত)।
Advertisement
এছাড়াও পশ্চিমাঞ্চল রেলওয়ে লোকাল ও মেইল ট্রেনে ১৮টি পুরাতন লাগেজ ভ্যান সংযুক্ত রয়েছে। নতুন লাগেজ ভ্যানের চেয়ে পুরাতন লাগেজ ভ্যানে আয় বেশি হয়। কারণ হিসেবে জানা যায়, লোকাল ও মেইল ট্রেন প্রতিটি স্টেশনে মালামাল ওঠা-নামার জন্য যথেষ্ট সময় বরাদ্দ থাকে। যা আন্তঃনগর ট্রেনের ক্ষেত্রে থাকে না। তাই নতুন লাগেজ ভ্যানের চেয়ে পুরাতন মেইল ও লোকাল ট্রেনে ব্যবহৃত লাগেজ ভ্যানে তিন থেকে চার গুণ বেশি আয় হয়।
পাকশী বিভাগীয় রেলওয়ে পরিবহন কর্মকর্তা (ডিটিও) হাসিনা বেগম জাগো নিউজকে জানান, পশ্চিমাঞ্চল রেলের ১৫টি আন্তঃনগর ট্রেনে নতুন ১৫টি লাগেজ ভ্যান সংযুক্ত করা হয়েছে। এছাড়াও লোকাল-মেইল ট্রেনে ১৮টি পুরাতন লাগেজ ভ্যান সংযুক্ত আছে। নতুন লাগেজ ভ্যানের চেয়ে পুরাতন লাগেজ ভ্যানগুলো থেকে বেশি আয় হচ্ছে।
তিনি আরও জানান, আন্তঃনগর যেসব ট্রেনগুলোতে নতুন লাগেজ ভ্যান সংযুক্ত করা হয়েছে সেগুলো শুধু মাত্র প্রথম ও শেষ স্টেশনে মালামাল ওঠানো-নামানো হয়। এ ট্রেনগুলো যেসকল স্টেশনে যাত্রাবিরতি দেয় সেখানে ২ থেকে ৫ মিনিট পর্যন্ত ট্রেন দাঁড়াতে পারে। এসময়ের মধ্যে মালামাল ওঠানো-নামানো সম্ভব হয় না। তাই আন্তঃনগর ট্রেনে প্রথম ও শেষ স্টেশন ছাড়া মালামাল ওঠানো-নামানো সম্ভব না হওয়ায় এসব ট্রেনের লাগেজ ভ্যানে আয় কম হচ্ছে।
পশ্চিমাঞ্চলের রেলওয়ের পাকশী বিভাগীয় বাণিজ্যিক কর্মকর্তা (ডিসিও) গৌতম কুমার কুন্ডু জাগো নিউজকে জানান, রেলের আয় বৃদ্ধির জন্য বেশ কয়েক বছর আগে যাত্রীবাহী ট্রেনে লাগেজ ভ্যান সংযুক্ত করা হয়েছে। এসব লাগেজ ভ্যান ট্রেনের আয় বৃদ্ধিতে ভূমিকা রাখছে। নতুন করে ২০২৩ সালে চীন থেকে ১২৫টি অত্যাধুনিক লাগেজ ভ্যান আমদানি করা হয়। আমদানিকৃত লাগেজ ভ্যানের মধ্যে ১৫টি আন্তঃনগর ট্রেনে সংযুক্ত করা হয়েছে। তিনি আরও জানান, আন্তঃনগর ট্রেনে সংযোগকৃত নতুন লাগেজ ভ্যানে যে মালামাল পরিবহন করা হচ্ছে তা থেকে তুলনামূলক আয় খুব কম হচ্ছে। ২০২৪ সালের জুলাই থেকে ২০২৫ সালের এপ্রিল পর্যন্ত পাকশী রেল বিভাগে লাগেজ ভ্যানে আয় হয়েছে ৩ কোটি ৯৪ লাখ ২৩ হাজার ৬৮৬ টাকা।
পশ্চিমাঞ্চল রেলওয়ের লালমনিরহাট বিভাগীয় বাণিজ্যিক কর্মকর্তা আব্দুল্লাহ আল মামুন জাগো নিউজকে জানান, ২০২৪ সালের জুলাই থেকে ২০২৫ সালের এপ্রিল পর্যন্ত লালমনিরহাট রেলওয়ে বিভাগে লাগেজ ভ্যানে আয় হয়েছে ১ কোটি ২ লাখ টাকা। এই আয়ের বেশিরভাগই লোকাল ও মেইলে ট্রেনে সংযুক্ত লাগেজ ভ্যান থেকে হয়েছে।
কৃষিতে জাতীয় স্বর্ণপদক ও এআইপি (অ্যাগ্রিকালচার ইম্পর্ট্যান্ট পারসন) পদকপ্রাপ্ত কৃষক শাহজাহান আলী বাদশা বলেন, কৃষি মালামাল বহনে সড়ক পথের তুলনায় রেলপথে ভাড়া ও সময় বেশি লাগে। এছাড়াও রেলপথে পণ্য পরিবহনের সময় একাধিকবার মালামাল ওঠা-নামা করানো হয়। এতে কৃষি পণ্যের মান ও গুণ দুইটিই নষ্ট হয়। তাই কৃষকরা সড়ক পথে মালামাল পরিবহনে বেশি স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করে। রেলওয়েতো তাদের ইচ্ছামতো স্টেশন নির্ধারণ করে মালামাল লোড-আনলোড করে। কিন্তু কৃষক বা কৃষি পণ্য ব্যবসায়ীরা আড়ত বা বাজারে কৃষি পণ্য পাঠায়। স্টেশন থেকে আড়তের দূরত্ব বেশি থাকায় আবার নতুন করে ট্রেন থেকে মালামাল আনলোড করে ট্রাকে বোঝাই করে আড়তে নিয়ে যেতে হয়। ট্রেনে কৃষিপণ্য পরিবহণ করতে হলে অবশ্যই রেলওয়েকে ভাড়া কমাতে হবে এবং কৃষিপণ্য ট্রেন আনলোড করে কৃষকদের আড়ত ও বাজারে পৌঁছানোর ব্যবস্থা করতে হবে। তবেই কৃষক বা ব্যবসায়ীরা ট্রেনে মালামাল পরিবহনে উৎসাহিত হবে।
রাজনৈতিক সমালোচক ও লেখক সরোয়ারুজ্জামান মনা বিশ্বাস জাগো নিউজকে বলেন, তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকারের সময়ের রেলের দুর্নীতির আরেকটি বড় চিত্র এই ১২৫টি লাগেজ ভ্যান। অপ্রয়োজনে অপরিকল্পিতভাবে ৩৫৮ কোটি টাকা ব্যয়ে এ লাগেজ ভ্যানগুলো আমদানি করা হয়েছিল। আমদানির দুই বছর পার হলেও এসব লাগেজ ভ্যান রেলওয়ের কোনো কাজে আসেনি। বরং অব্যবহৃত অবস্থায় বিভিন্ন স্টেশনে ফেলে রাখা হয়েছে। এসব লাগেজ ভ্যান কেনার সঙ্গে কারা জড়িত ছিল, এটি আমদানিতে কোনো দুর্নীতি হয়েছে কি না তা বর্তমান সরকারকে খতিয়ে দেখতে হবে।
পশ্চিমাঞ্চল রেলওয়ের চিফ কমার্শিয়াল ম্যানেজার সুজিত কুমার বিশ্বাস জাগো নিউজকে বলেন, ১২৫টি লাগেজ ভ্যানের মধ্যে পশ্চিমাঞ্চল রেলওয়েতে ৫০টি বরাদ্দ দেওয়া হয়। যার বেশিরভাগই অব্যবহৃত অবস্থায় আছে। এসব লাগেজ ভ্যান ব্যবহারের জন্য রেলওয়ে কর্মকর্তারা আলোচনা চালিয়ে যাচ্ছেন। লাগেজ পণ্য পরিবহন নীতিমালা তৈরি করা হচ্ছে। এসব লাগেজ ভ্যান বেসরকারি খাতে দেওয়া যায় কি না তা নিয়েও ভাবনা চলছে। এছাড়াও ডাক বিভাগ বেশ কিছু লাগেজ ভ্যান নেওয়ার আগ্রহ প্রকাশ করেছে। তাদের সঙ্গেও আলোচনা চলছে।
এফএ/জিকেএস