দেশজুড়ে

লোহাপট্টি থেকে হারিয়ে যাচ্ছে লোহা!

লোহাপট্টি থেকে হারিয়ে যাচ্ছে লোহা!

যশোরের বহুল পরিচিত লৌহজাত পণ্যের মোকাম ‘লোহাপট্টি’ থেকে হারিয়ে যাচ্ছে লোহা। প্রতি বছরই কমছে লোহার দোকানের সংখ্যা। ছয় দশকের পুরোনো এই মার্কেটে এক সময় ১২০টির মতো লোহার দোকান ছিল। এখন তা কমে ৪০ এর নিচে নেমে এসেছে। বছরে অর্ধশত কোটি টাকা লেনদেন হওয়া মার্কেটে এখন লেনদেন নেমে এসেছে ৩০ কোটির নিচে।

Advertisement

ব্যবসায়ীরা বলছেন, বেশ কিছু সংকট-সীমাবদ্ধতার কারণে লোহাপট্টি ছেড়ে লোহার ব্যবসায়ীরা শহরের বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে পড়ছেন। ফলে পুরোনো লোহার জৌলুসময় লোহাপট্টি মার্কেট তার ঐতিহ্য হারিয়ে ফেলছে।

ইতিহাস ঘেঁটে এবং পুরোনো ব্যবসায়ীদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, যশোর শহরের বড় বাজারের গোহাটা সড়কে লোহার কারবারের গোড়াপত্তন ঘটে বিগত শতাব্দীর ষাটের দশকে। তখন কয়েকজন ব্যবসায়ী বস্তায় করে পুরোনো লোহার বিভিন্ন সামগ্রী নিয়ে ফুটপাতে ব্যবসা শুরু করেন। প্রথম দিককার ব্যবসায়ী হিসেবে নিজাম মিয়া, ইউসুফ, আব্দুস সামাদ, লুৎফর রহমানের নাম জানা যায়। এই ব্যবসায়ীরা চট্টগ্রাম, ঢাকাসহ বিভিন্ন এলাকা থেকে পুরোনো লোহা, লৌহজাত পণ্য এবং বিভিন্ন মেশিনারির যন্ত্রাংশ নিয়ে গোহাটা সড়কে ব্যবসার সূচনা করেন। দেশ স্বাধীনের পর এই ব্যবসার প্রসার ঘটায় ওই ব্যবসায়ীরা ছোট ছোট দোকানঘর নেওয়া শুরু করেন। এক পর্যায়ে গোহাটা সড়কের এই অংশের নাম হয়ে যায় লোহাপট্টি।

আরও পড়ুন-

Advertisement

বছরের ব্যবধানে চা রপ্তানি বেড়েছে দ্বিগুণের বেশি অর্ধেকে নেমেছে আখাউড়া স্থলবন্দরের রপ্তানি নির্মাণকাজে ভাটা, কমেছে ইট বিক্রি

ব্যবসায়ীরা জানান, ৮০’র দশকে এই ব্যবসার পরিধি বিস্তৃত হতে হতে দোকানের সংখ্যা ১২০ ছাড়িয়ে যায়। ব্যবসায়ীরা মূলত ঢাকা ও চট্টগ্রাম থেকে পুরোনো লোহা সংগ্রহ করে নিয়ে আসেন লোহাপট্টিতে। বিশেষ করে চট্টগ্রাম থেকে ট্রাকে করে জাহাজ কাটা লোহার মালামাল নিয়ে আসা হয়। এছাড়া পুরোনো বার্জ, কার্গোর বিক্রি করা লোহার মালামাল, ছোট-বড় বিভিন্ন মিল, ফ্যাক্টরি, কল-কারখানার ব্যবহৃত-অব্যবহৃত যন্ত্রাংশ এবং আশপাশের এলাকার যেসব পুরোনো ভবন ভাঙা হয় সেসব ভবনের বিক্রি করা লোহার মালামালও এখানে বেচাকেনা হয়। আবার নিলামের মাধ্যমেও এখানকার ব্যবসায়ীরা পুরোনো লোহার মালামাল কিনে থাকেন।

এসব লোহার মালামাল লোহাপট্টি থেকে বৃহত্তর যশোর, কুষ্টিয়া, ফরিদপুর, বরিশাল, পটুয়াখালী, পাবনা, বগুড়া, রাজশাহী, রংপুর, দিনাজপুর জেলাসহ সমগ্র দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চল ও উত্তরবঙ্গে সরবরাহ শুরু হয়। নসিমন, করিমন থেকে শুরু করে স্থানীয়ভাবে নির্মিত বিভিন্ন যন্ত্রপাতি, ছোট ছোট কলকারখানা, গৃহস্থালিসহ নানান কাজে ব্যবহারের জন্য এখান থেকে লৌহজাত পণ্য কিনে থাকেন ক্রেতারা।

ব্যবসায়ীরা আরও জানান, লোহাপট্টিতে লোহার রড, পাইপ, নাট-বল্টু, বিয়ারিং, শেপ, ঢালাই লোহা, ইঞ্জিন বক্স, বিভিন্ন মেশিনারিজের যন্ত্রাংশ থেকে শুরু করে লৌহজাত এমন কোনো যন্ত্রাংশ নেই যা পাওয়া যায় না। ৯০ এর দশক ও পরবর্তীতে জমজমাট আকার ধারণ করা লোহাপট্টিতে বছরে অর্ধশত কোটি টাকার লেনদেন হতো।

কিন্তু পরবর্তীতে লোহাপট্টির সেই জৌলুসে ভাটা পড়তে শুরু করে। দোকানের সংখ্যা কমতে কমতে এখন ৪০ এর নিচে চলে এসেছে। নানা কারণে লোহাপট্টি ছাড়ছেন লোহার ব্যবসায়ীরা। এর মধ্যে অন্যতম কারণ হচ্ছে, বড় বাজারের এই অংশের অর্থনৈতিক গুরুত্ব বেড়ে যাওয়া। দোকান ভাড়া ও অ্যাডভান্সের পরিমাণ কয়েকগুণ বেড়ে যাওয়ায় লোহার ব্যবসায়ীরা দোকান ধরে রাখতে পারছেন না। ফলে লোহাপট্টির পশ্চিম অংশের প্রেস-প্রিন্টিং, কাগজ, স্টেশনারি ব্যবসায়ীরা পশ্চিম দিক থেকে, পূর্ব দিক থেকে হার্ডওয়্যার ব্যবসায়ীরা এবং দক্ষিণ দিক থেকে ফার্মেসি ব্যবসায়ীরা বাড়তি ভাড়ায় দোকানগুলো নিয়ে নিচ্ছেন। আর লোহার ব্যবসায়ীরা লোহাপট্টি থেকে সরে ব্যবসাকে শহরের বিভিন্ন প্রান্তে নিয়ে যাচ্ছেন। শহরের বকচর থেকে মুড়লি, মণিহার থেকে ঝুমঝুমপুর, আশ্রম রোড, চাঁচড়া, আরবপুর, ধর্মতলা এলাকায় লোহার ব্যবসা সরে যাচ্ছে।

Advertisement

ব্যবসায়ীরা আরও জানান, শহরের প্রাণকেন্দ্রে দোকানপাট, যানজট ও যান চলাচলের চাপ বেড়ে যাওয়ায় লোহার গাড়ি আনা নেওয়া, ক্রেতাদের আসা যাওয়ায় নানা প্রতিবন্ধকতা মোকাবিলা করতে হয়। এই প্রতিবন্ধকতা ঠেলে ব্যবসায়ীদের মালামাল আনতে যেমন বেগ পেতে হয়, তেমনি ক্রেতারাও আসতে চান না। ফলে কমেছে বেচাবিক্রি, টান পড়েছে আয়ে। ফলে লোহার বেচাকেনায় এখন যে লাভ হচ্ছে, তা দিয়ে লোহাপট্টিতে দোকান ভাড়া ও অ্যাডভান্স সংকুলান করা যাচ্ছে না। বাধ্য হয়েই তারা এখান থেকে ব্যবসা গুটিয়ে নিচ্ছেন।

লোহাপট্টি ব্যবসায়ী সমিতির সভাপতি এমএস সাইদুর রহমান বাবু জানান, ষাটের দশকে গোহাটা সড়কে লোহার ব্যবসা শুরু হয়। ৮০ ও ৯০ এর দশকে এর ব্যাপক বিস্তৃতি লাভ করে। এক পর্যায়ে এখানে লোহার দোকানের সংখ্যা ১২০টি ছাড়িয়ে যায়। কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে অন্য ব্যবসায়ীদের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় টিকতে না পেরে দোকান ছাড়ছেন লোহার ব্যবসায়ীরা। এখন তারা বকচর, মুড়লি, মণিহার থেকে নীলগঞ্জ, আশ্রম রোড, চাঁচড়া, আরবপুর এলাকায় সরে যাচ্ছেন। ফলে লোহার ব্যবসা শহরের বিভিন্ন এলাকায় ছড়িয়ে গেছে। কিন্তু লোহাপট্টি থেকে লোহার ব্যবসা কমে যাচ্ছে। লোহাপট্টিতে এখন দোকানের সংখ্যা ৪০টির নিচে নেমে এসেছে।

তিনি আরও উল্লেখ করেন, এক সময় এই মার্কেটে বছরে অর্ধশত কোটি টাকার বেচাকেনা হতো। যখন রডের দাম ১৬-২০ টাকা কেজি ছিল তখন এই বেচাকেনা ছিল। এখন রডের দাম ৮০-৯০ টাকা কেজি। অথচ এখন এই মার্কেটে বেচাকেনা ৩০ কোটি টাকার নিচে নেমে এসেছে।

অন্তরা বিয়ারিং হাউজের স্বত্বাধিকারী ওলিয়ার রহমান ৪০ বছর ধরে লোহাপট্টিতে ব্যবসা করছেন। তিনি জানান, সব ধরনের বিয়ারিং, শেপসহ সংশ্লিষ্ট যন্ত্রাংশ বিক্রি করেন তিনি। এক সময় তার দোকানে দৈনিক ২০-৩০ হাজার টাকার কেনাবেচা হতো। এখন ৫-১০ হাজারের বেশি বেচাকেনা হচ্ছে না। ফলে লোহাপট্টিতে এখন ব্যবসা টিকিয়ে রাখা দুরূহ হয়ে পড়েছে।

নিউ ফাতেমা আয়রনের স্বত্বাধিকারী মাসুদ পারভেজ লোহাপট্টিতে ব্যবসা করছেন ২০ বছর ধরে। তিনি জানান, শহরের মাঝখানে এবং বাজারের মধ্যে হওয়ায় এখানে আসা এবং মালামাল আনা নেওয়ায় অনেক ঝক্কি পোহাতে হয়। এজন্য লোহার ব্যবসা শহরের বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে পড়েছে। ফলে ক্রেতারা লোহাপট্টিতে কম আসছেন। এ কারণে লোহাপট্টিতে লোহার ব্যবসা টিকিয়ে রাখা কঠিন হয়ে পড়ছে।

লোহাপট্টির চার দশকের ব্যবসায়ী চাকলাদার আয়রনের মালিক মো. সাজ্জাদ হোসেন জানান, এক সময় লোহাপট্টি জমজমাট ছিল। কিন্তু শহরের বিভিন্ন প্রান্তে ব্যবসা ছড়িয়ে পড়ায় এখানে ব্যবসা কমে গেছে। এজন্য দোকানের সংখ্যাও কমেছে।

লোহাপট্টিতে একসময় ব্যবসা করতেন জগদীশ চন্দ্র ঢালী। এখন ব্যবসার হাল ধরেছেন তার ছেলে জয় ঢালী। লক্ষ্মী আয়রন স্টোরের মালিক জয় ঢালী বলেন, লোহাপট্টিতে লোহার বেচাকেনা কমে যাওয়ায় আয় কমে গেছে। অন্যদিকে বাড়ছে দোকান ভাড়া ও অ্যাডভান্সের পরিমাণ। লোহার ব্যবসায়ীরা সেই টাকা দিতে পারছেন না। অন্যদিকে তিন পাশ থেকে প্রেস-কাগজ, হার্ডওয়্যার ও ওষুধের ব্যবসায়ীরা বাড়তি ভাড়া ও অ্যাডভান্স দিয়ে লোহাপট্টির দোকানগুলো ভাড়া নিয়ে নিচ্ছেন। ফলে তিন দিক থেকে ওই ব্যবসায়ীরা লোহাপট্টিকে চেপে ধরেছেন। আর লোহাপট্টির ব্যবসায়ীরা এই চাপ সইতে না পেরে এখান থেকে ব্যবসা গুটিয়ে শহরের সুবিধাজনক প্রান্তে সরে যাচ্ছেন।

শহরের খড়কি এলাকার বাসিন্দা আব্দুল হান্নান লোহাপট্টিতে এসেছিলেন মেশিনের যন্ত্রাংশের ছোট রড কিনতে। তিনি জানালেন, গাড়ি উঁচু করার হাইড্রোলিক ‘জগ’ বানানোর জন্য লোহার রড খুঁজছেন। বিভিন্ন মেশিন তৈরির জন্য এখান থেকে যন্ত্রাংশ কিনে নেন। লোহাপট্টিতে পাওয়া যায় না এমন কোনো জিনিস নেই। দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে যন্ত্রাংশ ও লৌহজাত পণ্য কিনতে ব্যবসায়ীরা এখানে আসেন। এখানে না পাওয়া গেলে তা কিনতে ঢাকা কিংবা চট্টগ্রাম যেতে হবে। তাই স্থানীয় পর্যায়ের বিভিন্ন ওয়ার্কশপ ও যন্ত্রপাতি তৈরির প্রয়োজনে লোহাপট্টিতে লোহার ব্যবসা টিকে থাকা জরুরি বলে মনে করেন হান্নান।

এফএ/জেআইএম