প্রবাস

সাওনার ঘামে ইউরোপ ভিজলো কিন্তু বিবেক কী জাগলো?

সাওনার ঘামে ইউরোপ ভিজলো কিন্তু বিবেক কী জাগলো?

ইউরোপজুড়ে সংগীতের সবচেয়ে জনপ্রিয় ও প্রতীক্ষিত প্রতিযোগিতা ইউরোভিশন সং কনটেস্ট ২০২৫ শেষ হলো এক উৎসবমুখর পরিবেশে। এবারের আসরে চতুর্থ স্থান অর্জন করলেও সুইডেনের ব্যতিক্রমধর্মী পরিবেশনা সারা ইউরোপের নজর কাড়ে। ‘Vi ska bada bastu, bastu yksi kaksi kolme’ শিরোনামের গানে উঠে আসে ফিনল্যান্ডের ঐতিহ্যবাহী সাওনা সংস্কৃতি—যা দর্শক-শ্রোতাদের মাঝে ব্যাপক আলোড়ন তোলে।

Advertisement

১৯৫৬ সালে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী ইউরোপে ঐক্য ও সহযোগিতার বার্তা পৌঁছে দিতে ইউরোপীয় সম্প্রচার ইউনিয়নের (EBU) উদ্যোগে সূচনা হয় ইউরোভিশন সং কনটেস্টের। ভিন্ন ভাষা ও সংস্কৃতির শিল্পীরা নিজেদের মৌলিক গান নিয়ে এই আন্তর্জাতিক মঞ্চে প্রতিযোগিতা করেন। দর্শক এবং জুরি বোর্ডের সম্মিলিত রায়ে নির্ধারিত হয় বিজয়ী।

এই বছর সুইডেনের পক্ষে প্রতিযোগিতায় অংশ নেয় KAJ ব্যান্ড, যারা মূলত সুইডিশ-ফিনিশ ঐতিহ্যবাহী সংস্কৃতি ও ভাষাকে নিয়ে কাজ করে থাকে। তাদের গান ‘Vi ska bada bastu…’ একদিকে যেমন কৌতুকপূর্ণ ও প্রাণবন্ত, অন্যদিকে তেমনি একটি ঐতিহ্যের প্রতি শ্রদ্ধা জানানো এক সৃজনশীল প্রচেষ্টা।

সাওনা ফিনল্যান্ডে শুধু শরীর গরম করার জায়গা নয় বরং তা ধ্যান, বিশ্রাম এবং সামাজিক বন্ধনের প্রতীক। দেশটিতে সাওনার সংখ্যা প্রায় জনসংখ্যার সমান। এই প্রেক্ষাপটে, সাওনাকে ঘিরে একটি গানের মাধ্যমে আন্তর্জাতিক মঞ্চে তাদের সংস্কৃতিকে তুলে ধরা নিঃসন্দেহে তাৎপর্যপূর্ণ।

Advertisement

গানটির মঞ্চায়নে ছিল এক ভিন্নমাত্রার সৃষ্টিশীলতা। তোয়ালে পরা নৃত্যশিল্পী, হাতে সাওনার ‘ভিওতা’, ধোঁয়ার মধ্যে কাঠের ঘর—সব মিলিয়ে সেটটি যেন দর্শকদের এক বাস্তব সাওনার অভিজ্ঞতা দান করে। পেছনে চলছিল ফিনল্যান্ডের বরফে ঢাকা প্রাকৃতিক দৃশ্যের অ্যানিমেটেড ব্যাকগ্রাউন্ড। এমন চমকপ্রদ উপস্থাপনা ইউরোভিশনের ইতিহাসে বিরল।

KAJ ব্যান্ডের গানে ছিল কৌতুকের আবরণে এক গভীর বার্তা—হাসি শুধু আনন্দ নয় বরং জীবনের চাপ ও ক্লান্তির বিরুদ্ধে এক ধরনের প্রতিরোধ। এই গান প্রমাণ করেছে, গান শুধু বিনোদনের মাধ্যম নয় বরং তা হতে পারে সংস্কৃতি ও অনুভূতির শক্তিশালী বাহক।

চূড়ান্ত ফলাফলে অস্ট্রিয়া বিজয়ী হয় তাদের আবেগঘন ও মেলোডিক পরিবেশনার জন্য। অন্যদিকে, সুইডেন দর্শক ভোটে ভালো স্কোর করলেও জুরি পয়েন্টে পিছিয়ে পড়ে, ফলে চতুর্থ স্থানেই সন্তুষ্ট থাকতে হয়। তবে জনপ্রিয়তার বিচারে KAJ ব্যান্ডের গানটি এবারের প্রতিযোগিতার সবচেয়ে আলোচিত ও বিনোদনময় পারফরম্যান্স হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে।

ইউরোভিশন ২০২৫-এর মঞ্চে এই গান ছিল শুধু সংগীত নয়—দুই দেশের (সুইডেন ও ফিনল্যান্ড) বন্ধুত্ব, সম্মান ও ঐতিহ্যের একটি নিপুণ শিল্পরূপ। এই পরিবেশনা যেন বলে দিচ্ছে—‘সংস্কৃতি ভাগাভাগি করলে তা ছোট হয় না বরং আরও সমৃদ্ধ হয়।’

Advertisement

যদিও বিজয় মুকুট হাতে আসেনি, তবুও ‘Vi ska bada bastu, bastu yksi kaksi kolme’ গানটি এখন ইউরোপের নানা প্রান্তে টিকটক ভিডিও, ক্লাব পার্টি এবং ইউরোভিশন রি-ওয়াচ ইভেন্টে সবচেয়ে বেশি ব্যবহৃত গান। সংগীতপ্রেমীরা বলছেন—এটাই ছিল ইউরোভিশনের প্রাণবন্ত স্পিরিটের নিখুঁত উদাহরণ।

সংগীতের প্রতিযোগিতা পার হতে পারে স্কোরবোর্ডে, কিন্তু মানুষের মনে জায়গা করে নেয় সৃজনশীলতা, অনুভূতি ও আনন্দ। ইউরোভিশন ২০২৫-এর এই সাওনা-গান সেই জায়গাতেই চিরস্থায়ী আসন নিয়েছে।

Yksi, kaksi, kolme – দেখা হবে সাওনায়!

তবে এবারের ইউরোভিশন আমাকে বারবার স্মরণ করিয়ে দিয়েছে—সংগীত মানে সংহতি, ভ্রাতৃত্ববোধ, সহনশীলতা, উদারতা, একে অপরের পাশে দাঁড়ানো এবং অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের অঙ্গীকার। অথচ একই মঞ্চেই গোটা ইউরোপ কীভাবে ইসরায়েলের বিনোদনে তাদের সর্বোচ্চ ভোট দিয়ে সেই সংস্কৃতিকে সম্মান দেখাল! গাজার মানুষের মৃত্যু, তাদের প্রতি চলমান অবিচার—এর কোনো কিছুই কি ইউরোপের হৃদয়ে একবারও প্রশ্ন জাগাতে পারল না?

ইউরোভিশনের রঙিন আলো, ধোঁয়া আর শব্দের ভিড়ে আমরা প্রায়ই ভুলে যাই—সংগীত কেবল বিনোদন নয়, এটি এক নৈতিক উচ্চারণ, এক দায়বদ্ধতার ভাষা। যখন আমরা ‘সংগীতের ঐক্য’ বলে উল্লাস করি, তখন সেই ঐক্যের পরিসরে নির্দ্বিধায় জায়গা করে নিতে হবে প্যালেস্টাইনের শিশুর কান্না ও আর্তনাদকে। নৈতিকতাবর্জিত সৌন্দর্য যেমন ক্ষণস্থায়ী, তেমনি সহমর্মিতাবর্জিত সৃষ্টিশীলতাও শেষপর্যন্ত অপূর্ণ।

গানের উৎসবে হাততালি দেওয়া যেমন সহজ, অন্যায়ের বিরুদ্ধে হাত বাড়ানো ততটাই কঠিন—কিন্তু প্রয়োজনীয়। ইউরোপ যদি সত্যিই ‘ভ্রাতৃত্ব’-কে হৃদয়ে ধারণ করতে চায়, তবে তাকে প্রথমে স্বীকার করতে হবে—ইসরায়েলের প্রতি নিঃশর্ত সমর্থন এবং গাজার মানুষের বেদনা উপেক্ষা একই মঞ্চে সহাবস্থান করতে পারে না।

এ কারণেই, ইউরোভিশনের শেষ নোটটি আমাদের সকলকে স্মরণ করিয়ে দিক— সর্বোচ্চ স্কোর নয়, সর্বোচ্চ মানবিকতা—সেটিই আসল বিজয়। যতক্ষণ না আমরা সেই মানবিকতার মানদণ্ডে নিজেকে মাপতে শিখছি, ততক্ষণ সব সুরই অসম্পূর্ণ, সব জয়ের মুকুটই ফাঁপা।

তাই আগামীর মঞ্চে আমরা কণ্ঠে তুলব শুধুই গান নয়, তুলব এক অন্তর্ভুক্তিমূলক সুবিচারের সম্মিলিত উচ্চারণ—যা সত্যিই সবার হৃদয়ে স্থায়ী আসন নিবে, গড়ে দেবে এক নতুন মানচিত্র: যেখানে এনকোরের দাবিতে আর্তনাদ নয়, প্রতিধ্বনিত হবে মুক্তির সুর।

— রহমান মৃধাগবেষক এবং লেখকসাবেক পরিচালক, ফাইজার, সুইডেনRahman.Mridha@gmail.com

এমআরএম/জেআইএম