এক কাপ ‘চা’ কখনো দিনের শুরু, কখনো ক্লান্ত বিকেলের সঙ্গী, আবার কখনো সম্পর্কের আড়ষ্টতা ভাঙার সহজ মাধ্যম। এই চা শরীরকে দেয় প্রশান্তি, মনকে করে প্রফুল্ল। সকাল, বিকেল বা অতিথি আপ্যায়ন চায়ের গুরুত্ব যেন বাঙালির জীবনে অপরিসীম। তবে যতটা উষ্ণতা ছড়ায় এই পানীয়, তার পেছনের গল্পটা ততটাই কঠিন আর নির্মম। সুগন্ধি পাতা থেকে যে চা আপনার টেবিলে পৌঁছায় তার আড়ালে রয়েছে হাজার হাজার শ্রমিকের ঘাম, কষ্ট, অবহেলা আর অধিকারবঞ্চনার গল্প। ‘আন্তর্জাতিক চা দিবস’ আমাদের উৎসবের উপলক্ষ হলেও, এই দিনে প্রশ্ন তুলতেই হয়—এই চায়ের স্বাদ কি আসলেই মিষ্টি?
Advertisement
চায়ের পেছনে রয়েছে হাজার বছরের ইতিহাস, বহু সাংস্কৃতিক টানাপোড়েন, উপনিবেশ, আন্দোলন, এমনকি বিপ্লব। তাই ২১ মে যখন ‘আন্তর্জাতিক চা দিবস’ পালিত হয়, তখন সেটা শুধু পানীয়কে উদযাপন নয়; একটা বিশ্বজুড়ে বিস্তৃত ঐতিহ্যকে স্মরণও বটে।
এক কাপ চায়ের ইতিহাস: উপনিবেশ আর বাণিজ্যের গল্পচায়ের উৎপত্তি চীনে হলেও এর বিশ্বজয়ের গল্পটা মূলত শুরু হয় উপনিবেশবাদ এবং বাণিজ্য বিস্তারের হাত ধরে। ১৭শ শতকে ইউরোপে চায়ের জনপ্রিয়তা যখন বাড়তে থাকে, তখন ব্রিটিশরা চা আমদানিতে চীননির্ভরতা কমাতে ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলে চা চাষ শুরু করে। অসম, দার্জিলিং, সিলেট এই অঞ্চলের চা বাগানগুলো তৈরি হয় উপনিবেশিক মুনাফা কায়েমের লক্ষ্যে। আর এই উৎপাদনের মূলে ছিল এক শ্রেণির মানুষের নিরন্তর পরিশ্রম, যাদের নাম কখনোই উঠে আসে না ইতিহাসের পাতায়।
বাংলাদেশের চা শ্রমিক: অদৃশ্য এক জনপদের বাসিন্দাবাংলাদেশে বর্তমানে প্রায় ১ লাখ ৫০ হাজারের বেশি চা শ্রমিক রয়েছে, যারা মূলত সিলেট, মৌলভীবাজার ও চট্টগ্রাম অঞ্চলের ১৬০টির বেশি চা বাগানে কাজ করেন। এই শ্রমিকদের অধিকাংশই কয়েক প্রজন্ম আগে ভারতের বিহার, উড়িষ্যা বা মধ্যপ্রদেশ থেকে আনা হয়েছিল চা বাগানের জন্য। এই মানুষগুলো বাংলাদেশে থেকেও যেন ‘বাংলাদেশি’ হতে পারেনি। সমাজের মূল স্রোত থেকে বিচ্ছিন্ন, অল্প বেতনে দিন পার করেন, শিক্ষা-স্বাস্থ্য-বাসস্থান থেকে বঞ্চিত হয়ে তারা বেঁচে আছেন ‘চা পাতা’ নামের এক নীরব উৎপাদনের পেছনে।
Advertisement
সীমাহীন কাজ হলেও মজুরি হাতে গুনতে হয়চা শ্রমিকদের মজুরি নিয়ে প্রতিবছরই আলোচনা হয়, আন্দোলনও হয়। অথচ আজকের দিনে এসেও একজন চা শ্রমিকের দৈনিক মজুরি মাত্র ১৭০-১৮০ টাকা। এই টাকায় একজন শ্রমিককে চলতে হয় পরিবার নিয়ে; যেখানে খাদ্য, ওষুধ, বাসস্থান, শিক্ষা সবকিছু সামলানো অসম্ভব। অধিকাংশ শ্রমিক পরিবারই অনাহারে-অর্ধাহারে দিন কাটায়। বিশেষ করে নারী শ্রমিকরা, যারা চা পাতা তোলার প্রধান কারিগর, তাদের নেই মাতৃত্বকালীন ছুটি, নেই সঠিক চিকিৎসা কিংবা সামাজিক সুরক্ষা।
স্বাস্থ্যসেবা ও শিক্ষার বেহাল দশাচা বাগান এলাকায় যে স্বাস্থ্যসেবা রয়েছে, তা নামমাত্র। বেশিরভাগ বাগানে পুরনো, অপর্যাপ্ত ডিসপেনসারি; নেই প্রশিক্ষিত ডাক্তার। শ্রমিকদের সন্তানদের জন্য বিদ্যালয় থাকলেও পাঠদানে নেই গুণগত মান। ফলাফল প্রজন্মের পর প্রজন্ম পেছনে পড়ে যাচ্ছে, মূলস্রোত থেকে বিচ্ছিন্ন থেকে যাচ্ছে এই জনগোষ্ঠী। চা শ্রমিক পরিবারে শিশু শ্রমও এক বাস্তবতা, যেটা কখনো আইন, কখনো অভাবের সামনে অসহায়।
চা বাণিজ্যের লাভ কার, কষ্ট কার?বাংলাদেশ প্রতি বছর কোটি কোটি টাকার চা রপ্তানি করে। ২০২৪ সালের তথ্যমতে, বাংলাদেশ চা রপ্তানি করেছে প্রায় ৮ কোটি মার্কিন ডলারের বেশি। এই বিশাল বাজার ও চাহিদার সুযোগে বড় বড় কোম্পানিগুলো লাভের মুখ দেখলেও, উৎপাদনের কেন্দ্রে থাকা শ্রমিকের ভাগ্যে জোটে না সেই অর্থের ছিটেফোঁটাও। শ্রমিকের পরিশ্রমে তৈরি হওয়া এক কাপ চায়ের দাম যেখানে ২০-৫০ টাকা, সেখানে সেই শ্রমিকের ঘণ্টাপর্যায়ের মজুরি অনেক সময় ১০ টাকাও হয় না।
চা দিবসে কি আমরা শুধু চায়ের স্বাদ উপভোগ করবো?‘আন্তর্জাতিক চা দিবস’ পালিত হয় ২১ মে, জাতিসংঘ ঘোষিত একটি দিন, যার মূল উদ্দেশ্য শ্রমিকদের অবস্থা নিয়ে আলোচনা, টেকসই উৎপাদন নিশ্চিত করা, এবং সচেতনতা তৈরি। কিন্তু আমরা কি সত্যিই সেই উদ্দেশ্যকে সম্মান করি?
Advertisement
চা নিয়ে নানা ক্যাম্পেইন, পোস্ট, অফার থাকলেও কোথাও তেমন আলোচনায় আসে না এই শ্রমিকদের জীবনযাপন, অধিকার বা ভবিষ্যৎ।
সমাধানের পথ: শুধুই সহানুভূতি নয়, চাই কাঠামোগত পরিবর্তন>> ন্যূনতম মজুরি বৃদ্ধির নিশ্চয়তা>> চুক্তিভিত্তিক নয়, স্থায়ী শ্রমিক স্বীকৃতি>> শিক্ষা ও স্বাস্থ্যসেবা বিনামূল্যে নিশ্চিত করা>> চা শিল্পে নারীর নিরাপত্তা ও স্বাস্থ্য অধিকার রক্ষা
চায়ের কাপ আমাদের নিত্যসঙ্গী। কিন্তু সেই কাপ যখন ঠোঁটে ছোঁই, তখন কি মনে পড়ে এই পাতা তুলেছেন এমন একজন, যিনি দিনের পর দিন রোদে, বৃষ্টিতে, ঘামে ভিজে পরিশ্রম করছেন; অথচ তার সন্তানের জন্য পর্যাপ্ত খাবার জোটে না। চায়ের ইতিহাস শুধু একটি পানীয়ের নয়, এটি একটি সমাজব্যবস্থার প্রতিচ্ছবি। যেখানে একদল মানুষ আনন্দ পায়, আর অন্যদল নীরব থেকে কষ্ট বহন করে।
জেএস/জেআইএম