অর্থনীতি

বছরের ব্যবধানে চা রপ্তানি বেড়েছে দ্বিগুণের বেশি

বছরের ব্যবধানে চা রপ্তানি বেড়েছে দ্বিগুণের বেশি

চা রপ্তানির সুবর্ণ সময় বাংলাদেশ ফেলে এসেছে সেই ২০ বছর আগে। ২০০১-২০০৫ সাল পর্যন্ত রপ্তানি ছিল বছরে এক কোটি কেজির বেশি। সেটা কমতে কমতে ২০১৩ সালে মাত্র ৫ লাখ ৪০ হাজার কেজিতে নামে। এরপর থেকে সামান্য ওঠা-নামার মধ্যেই আছে।

Advertisement

তবে ২০২৪ সালে তার আগের বছরের তুলনায় দ্বিগুণেরও বেশি চা রপ্তানি করেছে বাংলাদেশ। যদিও একই সময়ে উৎপাদন কমেছে। ২০২৩ সালে বাংলাদেশে রেকর্ড ১০ কোটি ২৯ লাখ ৮১ হাজার কেজি চা উৎপাদন হয়েছিল। দেশে এত চা আগে কখনোই উৎপাদন হয়নি। তবে বছর বাদেই সেই সাফল্যে ছেদ পড়েছে।

২০২৪ সালে দেশে চায়ের উৎপাদন কমেছে। বাংলাদেশ চা বোর্ডের তথ্য অনুসারে, ২০২৪ সালে নয় কোটি ৩০ লাখ কেজি চা উৎপাদন হয়েছে। অর্থাৎ, আগের বছরের চেয়ে উৎপাদন কমেছে প্রায় ৯৯ লাখ কেজি।

তবে স্বস্তির খবর, একই সময়ে (২০২৩ থেকে ২০২৪) চায়ের রপ্তানি দ্বিগুণের বেশি বেড়েছে। ২০২৩ সালে বাংলাদেশ থেকে চায়ের রপ্তানি হয়েছিল ১০ লাখ চার হাজার কেজি, যা পরের বছর ২৪ লাখ ৫০ হাজার কেজি হয়। গত বছর ১৯টি দেশে রপ্তানি করা হয়েছে ওইসব চা। রপ্তানির তালিকায় যুক্ত হয়েছে কয়েকটি নতুন দেশ।

Advertisement

দেশে চায়ের চাহিদা ক্রমেই বাড়ছে। এখন আমাদের দেশে উৎপাদিত চায়ের মাধ্যমে সেটা পূরণ হয়। বাড়তি চা এখন রপ্তানির জন্য সঠিক উদ্যোগ দরকার। সবাই চাইলে বাংলাদেশের চা বিশ্বব্যাপী রপ্তানি সম্ভব।-বাংলাদেশ চা অ্যাসোসিয়েশনের চেয়ারম্যান কামরান তানভিরুর রহমান

দীর্ঘ সময় ধরে বাংলাদেশ চা উৎপাদনে পিছিয়ে ছিল। এক দশক আগেও দেশে চা উৎপাদন হতো ছয় কোটি কেজির কিছু বেশি। তবে ধারাবাহিকভাবে উৎপাদন বাড়ার কারণে দেশে চা উৎপাদনের পরিমাণ ১০ কোটি কেজি অতিক্রম করেছিল ২০২৩ সালে, যা বছর বাদে আবার নেতিবাচক ধারায় গেলো।

এ প্রেক্ষাপটে দেশে বুধবার (২১ মে) পালিত হচ্ছে পঞ্চম জাতীয় চা দিবস। এবছর দিবসটির প্রতিপাদ্য, ‘চা দিবসের প্রতিশ্রুতি, চা শিল্পের অগ্রগতি।’

আগে আরও বেশি ছিল রপ্তানি

এদিকে চা বোর্ডের তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, শেষ গত বছর রপ্তানি বাড়লেও দুই যুগ আগে রপ্তানিতে যে জৌলুস ছিল তা এখনো ফেরেনি। আর স্বাধীনতার পর দ্বিতীয় সর্বোচ্চ রপ্তানি পণ্য ছিল এ চা।

Advertisement

আরও পড়ুনদুধ চা নাকি রং চা কোনটি স্বাস্থ্যের জন্য ভালো?চায়ের সঙ্গে যা খেলে সমস্যা হতে পারেযে রেস্তোরাঁয় ১ কাপ চা লাখ টাকারেকর্ড উৎপাদনের পরেও দেশে বাড়ছে চা আমদানি, কমছে রপ্তানি

২০০১ সালে এক কোটি ২৯ লাখ কেজি চা রপ্তানি হয়েছিল, যার মূল্য ছিল ৮৯ কোটি ৪৯ লাখ টাকা। এর পরের বছর গত দুই যুগের মধ্যে রেকর্ড পরিমাণ চা রপ্তানি হয়। অর্থাৎ, ২০০২ সালে এক কোটি ৩৬ লাখ ৫০ হাজার কেজি চা রপ্তানি হয়েছিল, যার মূল্য ছিল ৯৩ কোটি ৯৯ লাখ টাকা। ২০১০ সাল থেকে রপ্তানির বাজার হারাতে থাকলেও ২০১৩ সালে এসে একেবারেই তলানিতে নামে। ২০১৩ সালে মাত্র ৫ লাখ ৪০ হাজার কেজি চা রপ্তানি করতে পেরেছিল বাংলাদেশ। এর পর থেকে খুব বেশি বাড়েনি।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, মান ও দামে প্রতিযোগিতা সক্ষমতায় পিছিয়ে থাকার কারণে রপ্তানি বাণিজ্যে পিছিয়ে পড়েছে বাংলাদেশ। তবে আশার কথা, ২০২৩ সালে ১৩টি দেশে চা রপ্তানি হলেও ২০২৪ সালে চা রপ্তানি হয়েছে বিশ্বের ১৯টি দেশে। যে কারণে রপ্তানিও বেড়েছে।

সবশেষ ২০২৪ সালে রপ্তানি হয়েছে ২৪ লাখ ৫০ হাজার কেজি চা, টাকার অঙ্কে যার মূল্য ৪৫ কোটি ৯৫ লাখ। যদিও এটা আগের বছরের চেয়ে দ্বিগুণেরও বেশি। কারণ আগের বছর রপ্তানি হয়েছিল ১০ লাখ চার হাজার কেজি চা।

আমাদের চা রপ্তানি এখন ধারাবাহিকভাবে বাড়ছে। এই রপ্তানি বৃদ্ধিতে বড় ভূমিকা রাখছে সরকারের প্রণোদনা। গত বছর থেকে রপ্তানির বিপরীতে ২ শতাংশ হারে প্রণোদনা দেওয়া হচ্ছে রপ্তানিকারকদের।- বাংলাদেশ চা বোর্ডের চেয়ারম্যান মেজর জেনারেল শেখ মো. সরওয়ার হোসেন

চা উৎপাদন ও বাজারজাতকরণ সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলো বলছে, আন্তর্জাতিক বাজারে বাংলাদেশের চায়ের যে কদর ছিল সেটা আবার একটু একটু করে বাড়লেও দুই যুগ আগের যে বাজার তার ধারেকাছেও নেই। উৎপাদন দ্বিগুণ হলেও প্রতিনিয়ত বাংলাদেশের চা আন্তর্জাতিক বাজার হারিয়েছে।

আমদানিও কম নয়

একদিকে চায়ের রপ্তানি হচ্ছে, আবার কিছু চা আমদানিও হচ্ছে। ২০২০ সালে দেশে ছয় লাখ ৮০ হাজার কেজি চা আমদানি করা হয়। এরপর তা ক্রমে বেড়ে ২০২১ সালে সাত লাখ ৪০ হাজার কেজি এবং ২০২২ সালে ১০ লাখ কেজিতে এবং শেষ ২০২৩ সালে প্রায় ১২ লাখ কেজি চা আমদানি হয়। গত বছরের আমদানির সুনির্দিষ্ট তথ্য এখনো মেলেনি।

সংশ্লিষ্টরা বলেছেন, বিশেষ করে যেসব চা আমদানি হচ্ছে সেগুলো উন্নতমানের, যার ক্রেতা নামিদামি হোটেল ও উচ্চবিত্ত মানুষ। চায়ের চাহিদা প্রতিনিয়ত বাড়ায় দেশের চাহিদা মিটিয়ে রপ্তানির জন্য খুব বেশি চা অবশিষ্ট থাকছে না। আর যে ধরনের চা বাংলাদেশে আমদানি হচ্ছে তার বেশিরভাগ ভিন্ন পদের। যেগুলো বাংলাদেশে উৎপাদন হচ্ছে না।

কোথায় কেমন উৎপাদন

দেশে বর্তমানে দুই দশমিক আট লাখ একরেরও বেশি এলাকায় ১৬৯টি চা বাগান আছে। এর মধ্যে মৌলভীবাজারের ৯০ বাগান থেকে দেশের মোট উৎপাদনের ৫৫ শতাংশ আসে। দ্বিতীয় বৃহত্তম উৎপাদক হবিগঞ্জ থেকে আসে ২২ শতাংশ চা। অন্যদিকে উত্তরাঞ্চলেও চায়ের চাষ দিন দিন বাড়ছে। যদিও মোট উৎপাদনে হিস্যা এখনো অনেক কম।

দেশে চাহিদা বাড়ছে

দেশের প্রধান চা উৎপাদন মৌসুম জুন থেকে নভেম্বর। বর্তমানে দেশে বার্ষিক চাহিদা সাড়ে আট কোটি কেজি থেকে নয় কোটি কেজির মধ্যে। বাকি চা রপ্তানি হচ্ছে।

এদিকে বাণিজ্য মন্ত্রণালয় বলছে, দেশের মানুষের মধ্যে চা পানের আগ্রহ বেড়েছে। গ্রামাঞ্চলের মানুষও এখন প্রতিদিন চা পান করে। এই চাহিদার ওপর ভিত্তি করে বাংলাদেশে এখন প্রায় চার হাজার কোটি টাকার চায়ের বাজার গড়ে উঠেছে। উৎপাদনের বেশিরভাগই এখন স্থানীয় বাজারে ভোক্তার চাহিদা পূরণে ব্যবহার হচ্ছে।

বিশ্লেষকরা বলছেন, স্থানীয় বাজারের পাশাপাশি বৈশ্বিক বাজার ধরতে চায়ের গুণগত মানসম্পন্ন ভিন্ন ভিন্ন জাত উদ্ভাবন জরুরি। এটা করা গেলে আমাদের চা শিল্পে ভ্যালু অ্যাডিশন হবে। সামগ্রিক প্রক্রিয়াটির জন্য গবেষণা ও উদ্ভাবনের জন্য সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা ও বরাদ্দের প্রয়োজন।

সরকারের নীতি সহযোগিতা দরকার

বাজার সংশ্লিষ্টদের দাবি, আমাদের চায়ের মান নিয়ে কোনো প্রশ্ন নেই। কিন্তু উৎপাদন খরচ বেশি হওয়ার কারণে আন্তর্জাতিক বাজারে প্রতিযোগী দেশের তুলনায় দাম বেশি পড়ছে। যেমন শ্রীলঙ্কার চেয়ে আমাদের চায়ের দাম প্রায় দ্বিগুণ। সেক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক বাজারে সুবিধা পেতে হলে সরকারের নীতি সহযোগিতা এবং প্রণোদনা দরকার।

বাংলাদেশ চা অ্যাসোসিয়েশনের চেয়ারম্যান ও রপ্তানিকারক কামরান তানভিরুর রহমান জাগো নিউজকে বলেন, ‘দেশে চায়ের চাহিদা ক্রমেই বাড়ছে। এখন আমাদের দেশে উৎপাদিত চায়ের মাধ্যমে সেটা পূরণ হয়। বাড়তি চা এখন রপ্তানির জন্য সঠিক উদ্যোগ দরকার। সবাই চাইলে বাংলাদেশের চা বিশ্বব্যাপী রপ্তানি সম্ভব।’

বাংলাদেশ চা বোর্ডের চেয়ারম্যান মেজর জেনারেল শেখ মো. সরওয়ার হোসেন জাগো নিউজকে বলেন, ‘আমাদের চা রপ্তানি এখন ধারাবাহিকভাবে বাড়ছে। এই রপ্তানি বৃদ্ধিতে বড় ভূমিকা রাখছে সরকারের প্রণোদনা। গত বছর থেকে রপ্তানির বিপরীতে ২ শতাংশ হারে প্রণোদনা দেওয়া হচ্ছে রপ্তানিকারকদের।’

এনএইচ/এএসএ/এমএফএ/জেআইএম