ফেসবুক ছেয়ে গেছে সান্ডায়। সরীসৃপ প্রাণীটিকে নিয়ে রস-রসিকতার পাশাপাশি বিজ্ঞাপনও বানাচ্ছেন অনেকে। কেউ জানাচ্ছেন এই প্রাণী আমাদের আশপাশেই বাস করে, আবার কেউ ছড়াচ্ছেন প্রাণীটির মাংস খাওয়ার পর অসুস্থ হওয়ার খবর। এদিকে পুরাতন গুজব ছড়িয়ে পড়েছে নতুন করে – সান্ডার তেল নাকি যৌনশক্তি বাড়ায়। ‘সান্ডার তেল’ কি সত্যিই যৌনশক্তি বাড়ায়?
Advertisement
সান্ডা নিয়ে নানান গুজব ও তথ্য যাচাই করে আজ (২০ মে) একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে তথ্য যাচাইকারী প্রতিষ্ঠান ফ্যাক্টওয়াচ। সেখানে তুলে ধরা হয়েছে সান্ডার বিস্তারিত। ফেসবুকের কিছু সাধারণজ্ঞান ভিত্তিক পেজে জানানো হচ্ছে সান্ডা কেবল বাতাস খেয়ে বেঁচে থাকে! ফ্যাক্টওয়াচ বলছে এ তথ্যের কোনো ভিত্তি নেই। প্রতিটি প্রাণিকেই বেঁচে থাকার জন্য এমন জৈব যৌগ গ্রহণ করতে হয়, যা শরীরের কোষে গিয়ে শক্তি তৈরি করে। বাতাসের মধ্যে যেহেতু এমন শক্তি তৈরির মতো উপাদান নেই, তাই বাতাস খেয়ে কোনো প্রাণী বেঁচে থাকতে পারে না। সান্ডা মূলত তৃণভোজী প্রাণী। ঘাস, সবজি এবং ফলমূলই তাদের খাদ্য। অপ্রাপ্তবয়স্ক সান্ডা মাঝে মাঝে ছোট পোকামাকড়ও খায়।
সান্ডা নিয়ে বানানো একটি বিজ্ঞাপন
সান্ডা একটি চতুস্পদ প্রাণী, যা মেরুদন্ডী এবং সরীসৃপ শ্রেণীভুক্ত। আকারে ২৫ থেকে ৯০ সেন্টিমিটার পর্যন্ত হতে পারে। আমাদের দেশে এই সরীসৃপটি খুব একটা দেখা যায় না। মূলত আফ্রিকা, মধ্যপ্রাচ্য এবং ভারতীয় উপমহাদেশের শুষ্ক এলাকায় এদের বসবাস। অনেকেই সান্ডা এবং গুইসাপকে মিলিয়ে ফেলছেন। ছবি বানাতে গিয়ে সান্ডাকে গুইসাপ বা গুইসাপকে সান্ডা বলে চালিয়ে দিচ্ছেন। উভয় প্রাণীই সরীসৃপ শ্রেণীভুক্ত। সান্ডা এবং গুইসাপ দুটি প্রাণী একই শ্রেণি এবং বর্গর অন্তর্ভুক্ত হলেও পরিবার ও গণের পার্থক্য রয়েছে। এদের আচার আচরণেও পার্থক্য রয়েছে।
Advertisement
সান্ডা মূলত শুষ্ক, পাথুরে ও মরুভূমি অঞ্চলের প্রাণী। অন্যদিকে গুইসাপ বাস করে জলাভূমি, নদীপাড় এবং ম্যানগ্রোভ বনাঞ্চলে। সান্ডা প্রধানত নিরীহ প্রকৃতির ও শাকাহারী, যার খাদ্যতালিকায় বিভিন্ন গাছপালা ও শাকসবজি থাকে। অন্যদিকে, গুইসাপ একটি মাংসাশী ও সর্বভুক প্রাণী, যা মাছ, ব্যাঙ, ইঁদুর থেকে শুরু করে মৃতদেহ পর্যন্ত খেতে সক্ষম। আকারের দিক থেকে গুইসাপ সান্ডার তুলনায় অনেক বড় ও ওজনদার, গুইসাপের দৈর্ঘ্য যেখানে ৩ মিটার পর্যন্ত হতে পারে, সেখানে সান্ডার দৈর্ঘ্য সাধারণত ২৫ থেকে ৯০ সেন্টিমিটার হয়।
সান্ডা বা গুইসাপের মাংস কি খাবার যোগ্য?ফ্যাক্টওয়াচ জানাচ্ছে, বিশ্বের অনেক জনপদেই সরীসৃপ খাওয়ার রেওয়াজ রয়েছে। সান্ডা বা গুইসাপও খাওয়া হয়। সৌদি আরব বা মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে সান্ডা বেশ জনপ্রিয় খাদ্য। দক্ষিণ আমেরিকার দেশগুলোতে ইগুয়ানা নামক অন্য আরেক প্রজাতির সরীসৃপ বেশ জনপ্রিয় খাবার। আবার মালয়েশিয়াসহ দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ার বিভিন্ন দেশে গুইসাপও খাওয়া হয়।
বাংলাদেশের বান্দরবানে কয়েকটি রেস্তোরাঁয় গুইসাপের মাংস পরিবেশন বিষয়ক ভ্লগ দেখা গেছে। সাধারণভাবে গুইসাপের মাংসের স্বাদ মুরগির মাংসের সাথে, এবং সান্ডার মাংসকে সুস্বাদু মাছের সাথে তুলনা করা হয়। আরব নিউজে প্রকাশিত একটি নিবন্ধে সান্ডাকে মরুভূমির মাছ হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, ইন্দোনেশিয়ার সুনান কালিযাকা স্টেট ইসলামিক ইউনিভার্সিটি ইয়োগিয়াকার্টা থেকে ২০১৭ সালে প্রকাশিত এক গবেষণাপত্রে সান্ডাকে হালাল (খাবার যোগ্য) এবং গুইসাপকে হারাম (খাবার অযোগ্য) আখ্যা দেওয়া হয়েছে।
তথ্য যাচাইসান্ডা ভেবে গুইসাপ খেয়ে যুবক অসুস্থ – এমন শিরোনামযুক্ত কিছু খবর এবং ফটোকার্ড সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে দেখা যাচ্ছে। স্পষ্টত, রসিকতা হিসেবে এসব ফটোকার্ড তৈরি করা হলেও, কোনো কোনো ফেসবুক ব্যবহারকারী বিষয়টি বিশ্বাস করে নানান রকম প্রশ্ন করছেন। আবার রাজনৈতিক ব্যক্তিদের ছবি ব্যবহার করেও সান্ডা ইস্যুতে আক্রমণ করা হচ্ছে। ফ্যাক্টওয়াচ জানাচ্ছে, ছড়িয়ে পড়া এসব ধারণার মধ্যে দুটি ভুল তথ্য রয়েছে।
Advertisement
প্রথমত, গুইসাপ পুকুরে বাস করে না, বরং মাটির গর্তে বা শুষ্ক পাথুরে জায়গায় বাস করে। তবে এদের পানিতে সাতার কাটার সক্ষমতাও রয়েছে। দ্বিতীয়ত, গুইসাপের মাংস কোনো বিষাক্ত খাবার নয়। বাংলাদেশের বান্দরবানসহ বিশ্বের বেশ কিছু দেশে স্থানীয় বাসিন্দা গুইসাপ রান্না করে খায়। বাণিজ্যিকভাবে সেখানকার স্থানীয় রেস্তোরাঁগুলোতেও গুইসাপের মাংস বিক্রি হয়। এই মাংস খাওয়ায় স্বাস্থ্যগত কোনো সমস্যা হয় না।
সান্ডার তেল কি যৌনশক্তি বর্ধক?না। এমন ক্ষমতার কোনো বৈজ্ঞানিক প্রমাণ পাওয়া যায়নি। কুসংস্কারের ওপর ভিত্তি করে এই প্রাণীর চর্বি বা শরীরের নির্দিষ্ট অঙ্গ সেবন করার কথা শোনা গেছে। তবে এসবের কোনো কার্যকারিতা না থাকলেও, প্লাসিবো ইফেক্টের কারণে কেউ কেউ এর ফলে নিজেকে অধিকতর সুস্থ বা সক্ষম ভাবতে পারেন।
বাংলাদেশে সান্ডা বেশ দুর্লভ একটি প্রাণী। তাহলে ‘সান্ডার তেল’-এর নামে কী বিক্রি হচ্ছে? ‘নিউজবাংলা টুয়েন্টিফোর ডটকম’ কয়েক বছর আগে সান্ডার তেল নিয়ে একটি অনুসন্ধানী প্রতিবেদন করে। প্রতিবেদক সেখানে ক্রেতা সেজে ঢাকার কারওরান বাজারের একটি ‘হারবাল দাওয়াখানা’ নামক দোকানে যান। বিক্রেতা শুরুতে দাবি করেন, তিনি সান্ডার তেল বিক্রি করেন। সৌদি আরব থেকে কিছু ব্যবসায়ীর মাধ্যমে তিনি এই তেল আমদানি করেন। তবে সাংবাদিক পরিচয় পাওয়ার পর দোকানী স্বীকার করেন, এগুলো সান্ডার তেল নয়। নারিকেল তেল আর পাম অয়েল একসঙ্গে করে দুই একটা গাছের শেকড় দিয়ে আগুনে জ্বালিয়ে সেটাকে ছোট ছোট বোতলে ভরে ‘সান্ডার তেল’ নামে বিক্রি করছেন।
আরএমডি