বিএনপি নেতা ইশরাক হোসেনকে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের (ডিএসসিসি) মেয়র হিসেবে দায়িত্ব বুঝিয়ে দেওয়ার দাবিতে নগর ভবন ব্লকেড কর্মসূচি চালিয়ে যাচ্ছে তার সমর্থকরা। টানা কয়েকদিন ধরেই চলছে এ আন্দোলন। আন্দোলন কর্মসূচিতে অন্তর্বর্তী সরকারের এক উপদেষ্টাকে হেয় করার ঘটনাও ঘটে। এতে পাল্টা বক্তব্যও এসেছে সেই উপদেষ্টার তরফে। আবার শুনানির অপেক্ষায় মেয়র হিসেবে শপথ না পড়ানোর নির্দেশনা চেয়ে উচ্চ আদালতে দায়ের করা রিট। সব মিলিয়ে আটকে আছে ইশরাক হোসেনের মেয়র হওয়া। এ ইস্যু নিয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমেও চলছে আলোচনা। ২০২০ সালের ১ ফেব্রুয়ারি অনুষ্ঠিত ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন নির্বাচনে আওয়ামী লীগের শেখ ফজলে নূর তাপস বিএনপির ইশরাক হোসেনকে প্রায় পৌনে দুই লাখ ভোটে পরাজিত করেন। তবে ৫ আগস্টের আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর গত ২৭ মার্চ বিএনপির আন্তর্জাতিকবিষয়ক কমিটির সদস্য ইশরাক হোসেনকে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের মেয়র ঘোষণা করে রায় দেন ঢাকার প্রথম যুগ্ম জেলা জজ ও নির্বাচনী ট্রাইব্যুনাল। আদালতের রায়ের পরিপ্রেক্ষিতে ইশরাককে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের মেয়র ঘোষণা করে গত ২৭ এপ্রিল গেজেট প্রকাশ করে নির্বাচন কমিশন (ইসি)। কিন্তু এখন পর্যন্ত ইশরাকের শপথ গ্রহণের ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি।
Advertisement
ইশরাক প্রয়াত বিএনপি নেতা ও অবিভক্ত ঢাকা সিটি করপোরেশনের সাবেক মেয়র সাদেক হোসেন খোকার ছেলে। তাকে দায়িত্ব না দেওয়ার প্রতিবাদে রাস্তায় নেমেছেন তার সমর্থকরা। তাদের অভিযোগ, ২০২০ সালে তারা ভোট দিয়ে ইশরাককে মেয়র পদে নির্বাচিত করেছিলেন। কিন্তু ফল জালিয়াতি করে ইশরাককে পরাজিত করা হয়েছিল। আদালতের রায়ে তিনি মেয়র পদ ফিরে পেয়েছেন। কিন্তু টালবাহানা করে তাকে দায়িত্ব বুঝিয়ে দেওয়া বা শপথ পড়াচ্ছে না স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়। এর প্রতিবাদ জানাতে তারা এই ব্লকেড কর্মসূচিতে অংশ নিয়েছেন।
মেয়র হওয়ার ইস্যুতে যা বলছেন ইশরাকনিজের ভেরিফায়েড ফেসবুক পেজে সোমবার (১৯ মে) একটি পোস্ট শেয়ার করেন ইশরাক হোসেন। যেখানে তিনি দাবি করেন, অন্তর্বর্তী সরকারের একটি অংশের মধ্যে ‘ক্ষমতার লোভ’ জন্ম নিয়েছে।
নিরপেক্ষতা বজায় না রেখে তারা একটি দলের প্রতিনিধির কাজ করেছে অভিযোগ করে সরকার থেকে তাদের পদত্যাগ করার দাবি জানিয়েছেন তিনি।
Advertisement
ইশরাক লেখেন, ‘যারা নিরপেক্ষতা শুধু বিসর্জন দিয়েছে-তাই নয়; বরঞ্চ একটি দলের প্রতিনিধির কাজ করেছে, তাদের অবিলম্বে পদত্যাগ করতে হবে। এরা হাসিনার মতোই বিচারকদের হুমকি দিয়েছে। নির্বাচন কমিশনকে চ্যালেঞ্জ করছে। উচ্চ আদালতে হস্তক্ষেপ করেছে। আমলাতন্ত্র হাসিনার দোসরদের সঙ্গে নিয়ে লম্বা কুচক্র পরিকল্পনা করছে। একদিন এদের সবার নাম পরিচয় প্রকাশ পাবে।’
পোস্টে তিনি লেখেন, ‘মেয়র ফেওর কিছু না। অন্তর্বর্তী সরকারের কতিপয় ব্যক্তির অন্তরে ক্ষমতার লোভ ও এটি চিরস্থায়ী করার কুৎসিত সত্যটা বের করে আনাটাই ছিলো মুখ্য উদ্দেশ্য’
‘এদের চেহারা উন্মোচন করতে হবে গণতন্ত্রের স্বার্থে, জনগণের ভোটার অধিকারের স্বার্থে। সর্বশক্তি দিয়ে এরা ঢাকায় বিএনপির মেয়র আটকানোর চেষ্টার মধ্য দিয়ে আগামী জাতীয় নির্বাচনে কি ভূমিকা পালন করবে- তা ক্লিন কাট বুঝিয়ে দিল,’ যোগ করেন ইশরাক।
উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়ার ব্যাখ্যাএকইদিন ইশরাকের শপথ নিয়ে পাল্টা স্ট্যাটাসে তাকে শপথ না পড়ানোর কারণ ব্যাখ্যা করেন স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়া।
Advertisement
তিনি লেখেন, ‘প্রথমত, আর্জি সংশোধন অবৈধ মর্মে হাইকোর্টের রায় ভায়োলেট করে নির্বাচন কমিশন ট্রাইব্যুনাল এই রায় প্রদান করেছে।’
‘দ্বিতীয়ত, নির্বাচন কমিশন শুনানিতে অংশগ্রহণ না করায় একপাক্ষিক রায় হয়েছে এবং পরবর্তীতে কমিশন আপিলও করেনি।’
‘তৃতীয়ত, আইন মন্ত্রণালয়ের মতামত চাওয়া হলেও মতামত দেওয়ার আগেই এবং একই সাথে দুইজন নাগরিকের পাঠানো লিগ্যাল নোটিশ উপেক্ষা করে রাত ১০টায় গেজেট প্রকাশ করেছে নির্বাচন কমিশন।’
‘চতুর্থত, উক্ত মামলায় স্থানীয় সরকার বিভাগ পক্ষভুক্ত ছিল না এবং রায়ে স্থানীয় সরকার বিভাগের প্রতি কোনো নির্দেশনার উল্লেখ নেই।’
‘পঞ্চমত, শপথ না দেওয়ার কারণে নির্বাচন কমিশন স্থানীয় সরকার বিভাগকে বিবাদী করে রিট পিটিশন দায়ের করা হয়েছে, যা এখনো বিচারাধীন।’
‘ষষ্ঠত, বরিশাল সিটি করপোরেশন সংক্রান্ত মামলায় আর্জি সংশোধন সংক্রান্ত হাইকোর্টের রায়কে আমলে নিয়ে খারিজ করেছে ট্রাইব্যুনাল। ফলে ট্রাইব্যুনালের দ্বিমুখী অবস্থান বোধগম্য হচ্ছে না।’
‘সপ্তম, মেয়াদ সংক্রান্ত জটিলতা দেখা দিয়েছে; কতদিন মেয়র থাকবেন বা আদৌ মেয়াদ আছে কি না তা স্পষ্ট নয়।’
‘অষ্টম, নির্বাচন কমিশনের চিঠিতে ‘‘কোনো প্রকার আইনি জটিলতা না থাকলে পরবর্তী ব্যবস্থা গ্রহণ’’ এর কথা বলা হয়েছে। স্পষ্টতই বিতর্কিত রায়, স্থানীয় সরকার বিভাগের প্রতি কোনো নির্দেশনা না থাকা, লিগ্যাল নোটিশ এবং রিট পিটিশন বিচারাধীন থাকা সংক্রান্ত আইনি জটিলতা রয়েছে।’
আরও পড়ুন ইশরাককে শপথ না পড়াতে রিট শুনানি দুপুরে নগর ভবনের সামনে আজও ইশরাকের সমর্থকদের অবস্থান‘নবম, এই জটিলতা নিরসনে আইন মন্ত্রণালয়ের মতামত চাওয়া হয়েছে।’
‘দশম, আওয়ামী আমলের অবৈধ নির্বাচনগুলোকে বৈধতা দেওয়ার প্রশ্নও প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠেছে। রাজনৈতিক দলগুলো যদি স্বীকার করে যে আওয়ামী আমলের নির্বাচনগুলো বৈধ, তবে সরকারের জন্য এসব প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হবে না।’
তিনি আরও লেখেন, ‘উচ্চ আদালতে বিচারাধীন এবং উপরোল্লিখিত জটিলতা নিরসন না করা পর্যন্ত শপথ গ্রহণ সম্ভব নয়। যথাযথ প্রক্রিয়া অনুসরণ না করে বরং গায়ের জোরে আদায় করার উদ্দেশ্যেই নগর ভবন বন্ধ করে মহানগর বিএনপি এই আন্দোলন চালাচ্ছে। ফলে সিটি করপোরেশনের দৈনন্দিন কাজ ব্যাহত হওয়াসহ জন দুর্ভোগ সৃষ্টি হয়েছে।’
এই উপদেষ্টা বলেন, ‘এসব জটিলতা নিরসন হলে স্থানীয় সরকার বিভাগের শপথ দিতে কোনো সমস্যা নেই। তবে ব্যক্তিগতভাবে আমার বিরুদ্ধে ইশরাক হোসেনের এই আক্রমণাত্মক ও অপমানজনক কার্যক্রমের কোনো কারণ খুঁজে পেলাম না! আবার কেউ বলবেন না যে এটা সাধারণ জনগণ করছে, কারণ বিএনপি এবং অঙ্গসংগঠনের বিভিন্ন গ্রুপের নির্দেশনা এবং গোয়েন্দা সংস্থার তথ্য অনুযায়ী দলীয় নেতাকর্মীরাই কর্মসূচি বাস্তবায়ন করছে।’
সমর্থকদের কাউকে হেয় না করার অনুরোধ ইশরাকেরএদিকে, কাউকে অসম্মান করে সমর্থকদের কোনো কিছু করা থেকে বিরত থাকার অনুরোধ জানিয়েছেন ইশরাক হোসেন। মঙ্গলবার (২০ মে) সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে ইশরাক হোসেন একটি স্ট্যাটাসে এ আহ্বান জানান।
তিনি লেখেন, ‘আমি আন্দোলনরত ঢাকা দক্ষিণ সিটির জনগণ ও ভোটারদের বিনীতভাবে অনুরোধ জানাচ্ছি ফ্যাসিস্ট হাসিনা ও তার দোসরদের বাদে অন্য কোন রাজনৈতিক দলের নেতার বিরুদ্ধে যত ক্ষোভ থাকুক না কেন, আমরা তাদের অসম্মান হয় এরকম কিছু করা থেকে শতভাগ বিরত থাকি। আমরা সমালোচনা করি, রাজনৈতিক বক্তব্যর মধ্য দিয়ে তাদেরকে সতর্ক করি, তাদের ভুল ধরিয়ে দেই কিন্তু অবশ্যই ভাষাগত শিষ্টাচার মেনে।’
তিনি আরও লেখেন, ‘অনেক তো দেখে আসছি আর পেছনের দিকে দেশটাকে নিতে চাই না। অবশ্যই আমরা রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে মোকাবেলা করব, দেশের বিরুদ্ধে সকল ষড়যন্ত্র রুখে দিবো, নির্বাচনী স্পষ্ট রোডম্যাপ আদায়ের মাধ্যমে আমাদের ভোটের অধিকার ফিরিয়ে আনার জন্য পদক্ষেপ নিব। এমনকি বর্তমানে বিতর্কিত উপদেষ্টাদের পদত্যাগে কঠোর গণতান্ত্রিক আন্দোলন ও করবো। কিন্তু ভাষা ও ব্যবহার জাতে শত্রুও সমালোচনা করতে না পারে।’
ইশরাককে শপথ না পড়াতে রিটঅন্যদিকে, বিএনপি নেতা ইশরাক হোসেনকে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের মেয়র হিসেবে শপথ না পড়ানোর নির্দেশনা চেয়ে উচ্চ আদালতে দায়ের করা রিট আবেদনের ওপর শুনানির জন্য (কজলিস্টে) কার্যতালিকায় রয়েছে। হাইকোর্টের বিচারপতি মো. আকরাম হোসেন চৌধুরী ও বিচারপতি দেবাশীষ রায় চৌধুরীর সমন্বয়ে গঠিত বেঞ্চে শুনানির জন্য রয়েছে রিটটি। আদালতে রিটের পক্ষে শুনানি করবেন আইনজীবী মোহাম্মদ হোসেন।
সর্বশেষ ডিএসসিসি মেয়র নির্বাচন২০২০ সালের ১ ফেব্রুয়ারি ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের নির্বাচন হয়। এতে আওয়ামী লীগের প্রার্থী শেখ ফজলে নূর তাপস মেয়র নির্বাচিত হন। নির্বাচন কমিশন ২ ফেব্রুয়ারি ভোটের ফলাফলের গেজেট প্রকাশ করে। এরপর শপথ নিয়ে দায়িত্ব পালন করে আসছিলেন তাপস।
সেই নির্বাচনে ঢাকা দক্ষিণের মেয়র পদে তাপস পেয়েছিলেন সোয়া চার লাখ ভোট। তার নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী বিএনপির ইশরাক পান দুই লাখ ৩৬ হাজার ভোট। নির্বাচনে অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগ তুলে ফল বাতিল চেয়ে ২০২০ সালের ৩ মার্চ মামলা করেন ইশরাক।
আরও পড়ুন ডিএসসিসির নগর ভবনে তালা, অফিসে যাননি উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ ইশরাককে শপথ না পড়ানোর ১০ জটিলতা জানালেন আসিফ মাহমুদ কর্মীদের দিয়ে উপদেষ্টা আসিফকে আক্রমণ ও অপমান করাতে পারেন নাছাত্র আন্দোলনের পর গত বছরের আগস্ট মাসে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর দেশের সব সিটি করপোরেশনের মেয়রদের অপসারণ করা হয়। এরপর ঢাকা দক্ষিণ সিটির প্রশাসক হিসেবে দায়িত্ব পালন করে আসছিলেন অতিরিক্ত সচিব শাহজাহান মিয়া। এর মধ্যে গত ২৭ মার্চ ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের ২০২০ সালের নির্বাচনে ফজলে নূর তাপসকে বিজয়ী ঘোষণার ফল বাতিল করে বিএনপি নেতা ইশরাক হোসেনকে মেয়র ঘোষণা করেন ঢাকার প্রথম যুগ্ম জেলা জজ ও নির্বাচনী ট্রাইব্যুনালের বিচারক মো. নুরুল ইসলাম। আদালত ১০ দিনের মধ্যে গেজেট প্রকাশের নির্দেশ দেন। এ রায় পাওয়ার পর ২৭ এপ্রিল গেজেট প্রকাশ করে নির্বাচন কমিশন।
এসএনআর/জিকেএস