জনবহুল রাজধানীতে বড় উদ্যানগুলোর মধ্যে একটি ঐতিহাসিক সোহরাওয়ার্দী উদ্যান। প্রতিদিন বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার অসংখ্য মানুষ উদ্যানটিতে হাঁটতে ও ঘুরতে যান। এছাড়া ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পাশে হওয়ায় শিক্ষার্থীরাও নিয়মিত যান সেখানে।
Advertisement
তবে মাদকের কারবার, মাদক সেবন, ছিনতাইসহ বিভিন্ন অপরাধের কারণে উদ্যানের পরিবেশ হয়ে উঠেছিল ভয়াবহ। শুধু এসব অপরাধ নয়, উদ্যানটিতে শত শত দোকান বসিয়ে চাঁদাবাজিও করা হতো। ছিনতাইয়ের ঘটনাও ছিল প্রায় নিয়মিত। এছাড়া গত কয়েক বছরে সেখানে কয়েকটি হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ঘটে।
তবে সম্প্রতি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) শিক্ষার্থী ও ছাত্রদল নেতা শাহরিয়ার আলম সাম্য হত্যাকাণ্ডের পর নড়েচড়ে বসেছে প্রশাসন। সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের পরিবেশ ফেরাতে উচ্ছেদ অভিযানসহ বেশকিছু পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। এর সুফলও কিছুটা মিলতে শুরু করেছে।
কিছুদিন আগেও যে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে ছিল মাদকের আড্ডা, অবাধ মেলামেশা আর অপরাধের অভয়ারণ্য, সেই উদ্যানে এখন দেখা যাচ্ছে এক ভিন্ন চিত্র। ৩৬ একরের এই উদ্যানে এখন পাখির কলকাকলি বেড়েছে।
Advertisement
সাধারণ মানুষ যারা আগে নিরাপত্তা আর শালীন পরিবেশের অভাবে উদ্যানে সময় কাটাতে ভয় পেতেন, তারাও এখন স্বস্তিতে হাঁটাহাঁটি করছেন, সময় কাটাচ্ছেন পরিবার নিয়ে। সকালে ও বিকেলে হাঁটার জন্য উদ্যানে আসছেন অনেকে। তবে উদ্যানের পরিবেশ এখনো নোংরা। যেখানে সেখানে ময়লা-আবর্জনা, কাগজের টুকরা, পলিথিন, পড়ে আছে।
আরও পড়ুনবিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে ছুরিকাঘাতে ঢাবি শিক্ষার্থী নিহতসোহরাওয়ার্দী উদ্যানে উচ্ছেদ অভিযানছুরিকাঘাতে ঢাবি শিক্ষার্থী নিহতের ঘটনায় মামলা, গ্রেফতার ৩ঢাকার ব্যস্ত জীবনে মানুষের অবসর বিনোদন কেমন?রোববার (১৮ মে) সোহরাওয়ার্দী উদ্যান ঘুরে এমন চিত্র দেখা গেছে।
গত বৃহস্পতিবার (১৫ মে) সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে গড়ে ওঠা অবৈধ ভ্রাম্যমাণ দোকানপাটসহ স্থাপনা গুঁড়িয়ে দেওয়ার পর উদ্যানের কোথাও এখন দোকানপাট নেই। উদ্যানজুড়ে মানুষের উপস্থিতিও অনেকটা কম।
রোববার সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে নিয়মিত বিশ্রাম কিংবা ঘুরতে আসা বেশ কয়েকজন দর্শনার্থী জাগো নিউজকে জানিয়েছেন, এই উদ্যান এতদিন পরিবারসহ ঘুরতে আসার উপযোগী ছিল না। মাদকের গন্ধ ও ছিনতাইকারীর ভয় আর নারী-পুরুষের অবাধ মেলামেশার কারণে পরিবেশ খুবই নোংরা ছিল। তবে কয়েকদিন থেকে মাদক বেচাকেনা কিংবা মাদক সেবন কমে গেছে। রাত ৮টার পর উদ্যানের গেট বন্ধ হওয়ার কারণে অপরাধও কমেছে।
Advertisement
উদ্যানে নিয়মিত শরীরচর্চা করতে আসা জহিরুল ইসলাম জাগো নিউজকে বলেন, ‘ঢাকায় যতগুলো বড় উদ্যান রয়েছে সোহরাওয়ার্দী উদ্যান তার মধ্যে অন্যতম। প্রাকৃতিক পরিবেশ আর মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের কারণে বহু দর্শনার্থী আসেন। কিন্তু নিরাপত্তার অভাবে উদ্যানটি মাদকসেবীদের আখড়া হয়ে দাঁড়িয়েছে। পশ্চিম পাশ আর পূর্ব পাশে সবচেয়ে বেশি মাদক বেচাকেনা ও মাদকের আড্ডা চলে। কিন্তু কয়েকদিন থেকে মাদক সেবন নেই বললেও চলে।’
জহিরুল ইসলাম বলেন, ‘কিছু টোকাই ও পথশিশু রয়েছে যারা সাইকেলে এখনো মাদক বিক্রি করে। তবে এখন যে উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে এটা পুরোপুরি বাস্তবায়ন হলে পরিবেশ অনেকটা উন্নত হবে। দিনেরবেলা বিনোদনের উদ্দেশ্যে মানুষ ঘুরতে আসবে।’
পরিবেশবিদরা বলছেন, ঢাকা শহরের মানুষ নিরাপদ ও সামাজিক উন্মুক্ত স্থানের অভাববোধ করছেন বহু বছর ধরে। অথচ রাজধানীতে যে পরিমাণ উদ্যান আর পার্ক রয়েছে সেগুলোর বেহাল দশা কাটিয়ে উঠলে মানুষের নির্বিঘ্নে সময় কাটানোর মতো একটা জায়গা তৈরি হয়। এখন সময় সোহরাওয়ার্দী উদ্যানকে ঢেলে সাজানোর। ঐতিহাসিক জায়গাকে যদি পরিবেশবান্ধব করা যায়, দোকানবিহীন ও মাদকমুক্ত করা যায়, তবে উদ্যানের প্রকৃত রূপ ফিরবে।
পরিবেশ বাঁচাও আন্দোলনের (পবা) সাধারণ সম্পাদক মেজবাহ উদ্দীন সুমন জাগো নিউজকে বলেন, ‘একটা সময় রমনা পার্কের অবস্থাও খারাপ ছিল। কিন্তু সঠিক পরিচর্যার মাধ্যমে পার্কের পরিবেশ এখন বেশ ভালো। তাহলে সোহরাওয়ার্দী উদ্যান এতদিন অবহেলিত ছিল কেন? সম্প্রতি যেসব ব্যবস্থা নিয়েছে এটার পাশাপাশি এখানে অনেক গাছ লাগানো উচিত। বহু গাছ মৃত, ফাঁকা মাঠ ছাড়াও গাছ লাগানোর মতো পর্যাপ্ত জায়গাও রয়েছে। এছাড়া খাবারের দোকান দেওয়া থেকে বিরত থাকতে হবে। তাহলে ময়লা-আবর্জনা থেকেও রক্ষা পাবে, গাছপালাও সুস্থ থাকবে।’
কমেছে মাদকরোববার ক্রেতা সেজে এক মাদককারবারির সঙ্গে কথা হয় জাগো নিউজের এই প্রতিবেদকের। সাইকেলে ঘুরে ঘুরে তিনি ক্রেতা খুঁজছেন। তিনি বলেন, ‘তিন-চার দিন থেকে বেচাকেনা অনেক কমেছে। আগে বিকেল থেকে রাত পর্যন্ত অনেক বেচাকেনা হতো। এখন বেচাবিক্রি নেই বললেই চলে। যারা কিনতে চায় চোখের ইশারায় মিলে গেলে মাদক বিক্রির কথা স্বীকার করি, নাহলে বেচাকেনা নেই। পুলিশের ভয়ও আছে। আগে যেমন অবাধ বেচাকেনা চলতো, এখন সেটা নেই।’
আরও পড়ুনসাম্য হত্যার বিচার দাবিতে ঢাবি সাদা দলের ৪৮ ঘণ্টার আলটিমেটামপ্রথম বর্ষ থেকেই সাম্য ছিল অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদীসাম্য হত্যা: ছাত্রদলের বিক্ষোভ, উপাচার্য-প্রক্টরের পদত্যাগ দাবিদুপুরে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের পূর্বপাশে ক্রিকেট খেলছিলেন নিউমার্কেট এলাকার বাসিন্দা আজিজ রাজু। তিনি জাগো নিউজকে বলেন, ‘বিকেল থেকে রমনা কালিমন্দিরের পেছন দিয়ে ওই রাস্তার পাশে সবচেয়ে ভয়াবহ অবস্থা থাকে। প্রায় সময় তরুণ-তরুণীরা আপত্তিকর অবস্থায় থাকেন। মাদক সেবনের আড্ডা চলে। এ রকম অবস্থা থাকলে একটা উদ্যানে কোনো মানুষ স্বাভাবিকভাবে ঘুরতে পারবে না। এই অবস্থায় পরিবার নিয়ে এই উদ্যানে বিশ্রাম নেওয়া যায় না। আমরা প্রায়ই এখানে খেলাধুলা করি, বিশ্রাম নিই। তাই এ রকম বহু ঘটনার সম্মুখীন হয়েছি।’
নোংরা পরিবেশ দূর হলে বাড়বে দর্শনার্থীসরেজমিনে উদ্যান ঘুরে দেখা গেছে, যত্রতত্র পড়ে আছে ময়লা-আবর্জনা। উদ্যান ঘুরে দেখা যায়নি কোনো ডাস্টবিন কিংবা ময়লা ফেলার স্থান। উদ্যানের পশ্চিমপাশে টিএসসি গেট সংলগ্ন জায়গায় দেখা গেছে ময়লার ভাগাড়। এছাড়া পুরো উদ্যানজুড়ে যেখানে সেখানে পড়ে আছে নির্মাণসামগ্রী।
বাংলাদেশ গাছ রক্ষা আন্দোলনের সমন্বয়ক আমিরুল রাজীব জাগো নিউজকে বলেন, ‘সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে এতদিন শিশু, বৃদ্ধ ও পরিবার নিয়ে যাওয়ার মতো অবস্থা ছিল না। এখন একটা মার্ডারের পর প্রশাসনের টনক নড়েছে। প্রশাসনের নাকের ডগায় অবাধ মাদকসেবন চলতো। একটা উদ্যানের প্রকৃত অবস্থা ছিল না। এই উদ্যানের গাছ কাটা নিয়ে বহু আন্দোলন করেছি। বহু প্রস্তাবনা দিয়েছি, কোনো সমাধান হয়নি। এখন এটার সংস্কার জরুরি।’
আমিরুল রাজীব আরও বলেন, ‘নিয়মিত পরিচ্ছন্নতা অভিযান এবং সচেতনতামূলক উদ্যোগ নেওয়া হলে নোংরা পরিবেশ অনেকটাই কমে যাবে। এছাড়া উদ্যানের প্রতিটি পয়েন্টে ডাস্টবিন রাখা জরুরি। এই ঘটনার পর দোকানপাট যদি আর চালু না হয় তাহলে উদ্যান পরিষ্কার থাকবে। আর পরিচ্ছন্ন ও নিরাপদ পরিবেশ দর্শনার্থীদের আস্থাও ফিরিয়ে আনবে, দর্শনার্থীর সংখ্যাও বাড়বে।’
উদ্যান সংস্কারে নেওয়া হচ্ছে ব্যবস্থাঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ও ছাত্রদল নেতা শাহরিয়ার আলম সাম্য খুনের পর সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে নিরাপত্তা বাড়ানোর ওপর জোর দেওয়া হয়েছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন ও সোহরাওয়ার্দী উদ্যান সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের মধ্যে সভা করে সাতটি সিদ্ধান্তের কথা জানিয়েছিলেন স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়া। সেগুলো হলো, ১. রাজু ভাস্কর্যের পেছনের গেটটি স্থায়ীভাবে বন্ধ করা হবে। ২. সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে অবৈধ দোকান উচ্ছেদ, মাদক ব্যবসা বন্ধ এবং পরিচ্ছন্নতা নিশ্চিতে গণপূর্ত মন্ত্রণালয়, সিটি করপোরেশন, ডিএমপি ও মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের সমন্বয়ে যৌথ অভিযান পরিচালিত হবে। ৩. নিয়মিত মনিটরিং ও অভিযানের জন্য সংশ্লিষ্ট স্টেকহোল্ডারদের নিয়ে একটি কমিটি গঠন করবে গণপূর্ত মন্ত্রণালয়। ৪. উদ্যানে পর্যাপ্ত আলো ও সিসিটিভি ক্যামেরা স্থাপন এবং সেগুলোর নিয়মিত মনিটরিং করা হবে। ৫. সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে একটি ডেডিকেটেড পুলিশ বক্স স্থাপন করা হবে। ৬. উদ্যানে রমনা পার্কের মতো সুশৃঙ্খল ব্যবস্থাপনা চালু করা হবে এবং ৭. রাত ৮টার পর উদ্যানে জনসাধারণের প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা কার্যকর করা হবে।
এর মধ্যে বেশ কয়েকটি সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন করা হয়েছে। রাত ৮টার পর সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে জনসাধারণের প্রবেশ নিষিদ্ধ করা হয়েছে। অবৈধ দোকানপাট উচ্ছেদ করা হয়েছে। উচ্ছেদ অভিযানের পর এখন দোকান নেই। স্থায়ীভাবে টিএসসি সংলগ্ন উদ্যানের গেট বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। উদ্যানে আলোর ব্যবস্থার জন্য এরই মধ্যে লাইট লাগানো শুরু হয়েছে।
গত ১৩ মে রাতে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে দুর্বৃত্তদের ছুরিকাঘাতে খুন হন শাহরিয়ার আলম সাম্য। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের ২০১৮-১৯ শিক্ষাবর্ষের শিক্ষার্থী এবং স্যার এ এফ রহমান হল শাখা ছাত্রদলের সাহিত্য ও প্রকাশনা সম্পাদক ছিলেন।
ঘটনার পরদিন সকালে সাম্যর বড় ভাই শরীফুল ইসলাম শাহবাগ থানায় ১০–১২ জনকে আসামি করে হত্যা মামলা দায়ের করেন। হত্যা মামলায় এরই মধ্যে তিনজন গ্রেফতার হয়ে পুলিশি রিমান্ডে আছে।
আরএএস/ইএ/এমএমএআর/জেআইএম