জাতীয়

লুটের টাকা দরিদ্র জনগোষ্ঠীর কল্যাণে ব্যয় হবে: গভর্নর

লুটের টাকা দরিদ্র জনগোষ্ঠীর কল্যাণে ব্যয় হবে: গভর্নর

ছাত্র জনতার গণঅভ্যুত্থানে ক্ষমতাচ্যুত ফ্যাসিস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে নজিরবিহীন দুর্নীতির মাধ্যমে বিদেশে পাচার করা টাকা ও স্থাবর-অস্থাবর সম্পদ পুনরুদ্ধারে আন্তরিক প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে সরকার। তাদের সুদৃঢ় পদক্ষেপ গ্রহণের ফলে দেশে-বিদেশে পাচার করা বিপুল পরিমাণ অর্থ মূল্যের স্থাবর ও অস্থাবর সম্পদ বাজেয়াপ্ত ও জব্দ করা সম্ভব হয়েছে।

Advertisement

অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের নির্দেশে বেশ কয়েক মাস আগে বিশেষজ্ঞ সমন্বয়ে গঠিত বাংলাদেশ ব্যাংকের ১১টি শক্তিশালী টাস্ক ফোর্স গঠিত হয়। সেই সঙ্গে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) ব্যাপক তদন্ত চালিয়ে দুর্নীতির তথ্য উদঘাটন করে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের টাস্ক ফোর্সের একাধিক দল ও দুদকের সদস্যরা ব্যাপক অনুসন্ধান চালিয়ে দেশে-বিদেশে বিপুল পরিমাণ অর্থ মূল্যের নগদ টাকার পাশাপাশি স্থাবর ও অস্থাবর সম্পত্তি পাচারের তথ্য সংগ্রহ করেন।

পর্যাপ্ত তথ্য উপাত্ত সংগ্রহ করা হলেও পাচার হয়ে যাওয়া টাকা ফিরিয়ে আনা খুব একটা সহজ কাজ হবে না বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।

Advertisement

খোদ বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আহসান এইচ মনসুর জানিয়েছেন, আইনি প্রক্রিয়া শেষ করে পাচার করা অর্থ ফিরিয়ে আনতে চার থেকে পাঁচ বছর সময় লেগে যাবে।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, বিশ্বের বিভিন্ন দেশ ইউনাইটেড কিংডম (ইউকে), মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, ইউএই ও সিঙ্গাপুর সরকার বাংলাদেশ থেকে পাচার করা অর্থ পুনরুদ্ধারের ব্যাপারে সর্বাত্মক সহায়তা করছে তবে শেষ পর্যন্ত সরকারকে উপযুক্ত তথ্যপ্রমাণ দিয়ে প্রমাণ করতে হবে যে বাংলাদেশ থেকে টাকা পাচার হয়েছে।

এছাড়া পাচারকারীদের অনেকেই বিভিন্ন দেশে নাগরিকত্ব গ্রহণ করেছেন। সেক্ষেত্রে সে দেশের নাগরিকের কাছ থেকে টাকা পুনরুদ্ধার করতে অনেকটা বেগ পেতে হবে।

সোমবার (১৯ মে) রাজধানীর ফরেন সার্ভিস একাডেমিতে এক প্রেস ব্রিফিংয়ে গণমাধ্যম কর্মীরা বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আহসান এইচ মনসুরের কাছে এখন পর্যন্ত স্থাবর-অস্থাবর সম্পদ মিলিয়ে সর্বমোট কত পরিমাণ অর্থ বাজেয়াপ্ত ও জব্দ করা হয়েছে এ ব্যাপারে জানতে চাইলে গভর্নর সুনির্দিষ্ট তথ্য দিতে রাজি হননি।

Advertisement

বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আহসান এইচ মনসুর/ফাইল ছবি

তবে প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে বৈঠককালে ব্যাংকিং সেক্রেটারি নাজমা মোবারকের দেওয়া তথ্য তুলে ধরে বলেন, যে পরিমাণ স্থাবর-সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করা হয়েছে (অভ্যন্তরীণ ১ লাখ ৩০ হাজার ৭৫৮ দশমিক ৭ কোটি টাকা ও বৈদেশিক সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত হয়েছে ১৬৪ দশমিক শূন্য ৩ মিলিয়ন ডলার) আর অভ্যন্তরীণ অস্থাবর সম্পত্তি জব্দ করা হয়েছে ৪২ হাজার ৬১৪ দশমিক ২৭ কোটি টাকা।

আরও পড়ুনপাচারের অর্থ ফেরত পেতে আন্তর্জাতিক সংস্থার দিকে তাকিয়ে দুদকপাচার হওয়া অর্থ ফেরানো যেন রাজনৈতিক কারণে থেমে না যায়: গভর্নরপাচারের অর্থ ও সম্পদ ফেরাতে যেসব পদক্ষেপ নিয়েছে সরকার

শফিকুল আলম জানান, বিদেশে পাচার করা অর্থ ও সম্পদ পুনরুদ্ধার সংক্রান্ত গৃহীত কার্যক্রম ও বাস্তবায়নের অগ্রগতি নিয়ে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের সভাপতিত্বে পর্যালোচনা বৈঠকে এ তথ্য দেওয়া হয়।

ফরেন সার্ভিস একাডেমিতে আয়োজিত প্রেস ব্রিফিং এ ব্যাপারে বিস্তারিত তথ্য উপাত্ত তুলে ধরেন বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আহসান এইচ মনসুর।

এ সময় তিনি বলেন, প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে তাদের বৈঠকটি রুটিন পর্যালোচনা বৈঠক ছিল। প্রতি মাসে একদিন করে তারা প্রধান উপদেষ্টাকে বিদেশে পাচার করা অর্থ ও সম্পদ পুনরুদ্ধারের অগ্রগতি সম্পর্কে অবহিত করে থাকেন।

‘প্রধান উপদেষ্টা লুটের টাকায় ম্যানেজমেন্টে ফান্ড গঠনের পরামর্শ দিয়েছেন। এসব টাকা দরিদ্র জনগোষ্ঠীর কল্যাণে ব্যয় হবে।’

বৈঠকে সম্পদ পুনরুদ্ধারে কী অগ্রগতি হয়েছে, কী ধরনের ইস্যু বা চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করছি, আমাদের কী ধরনের নতুন কার্যক্রম বা আইনগত অসুবিধা দূরীকরণে কি করা যায় তা নিয়ে আলোচনা হয়।

বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর বলেন, বিদেশি প্রতিষ্ঠানগুলোর সঙ্গে যোগাযোগ করেছি, তাদের সহায়তা পেয়েছি, আমরা তাদের ফিনান্সিয়াল নিড অ্যান্ড অ্যাসিস্ট্যান্স অর্থাৎ বাংলাদেশে যে ধরনের বিচারকার্য সম্পাদিত হয়েছে সেটার ভিত্তিতে বিদেশে যারা অর্থ পাচার করেছে বা অর্থ আত্মসাৎ করে চলে গেছে তাদের অর্থ কীভাবে জব্দ করা যায় সেজন্য এমএলএ (মিউচুয়াল লিগ্যাল অ্যাসিস্ট্যান্স) পাঠাচ্ছি।

আহসান এইচ মনসুর বলেন, যারা পলাতক বা যাদের নামে অর্থ আত্মসাৎ ও পাচারের মামলা রয়েছে বিভিন্ন ব্যাংকে তাদের জমা করা অর্থ আমাদের হাতে জব্দ করা আছে। এ অর্থের ব্যবহার কীভাবে করা হবে তা নিয়ে প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে আলোচনা হয়।

তিনি বলেন ,আমাদের হাতে পালিয়ে যাওয়া বিভিন্ন ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের নামে বিভিন্ন ব্যাংকে বেশ বড় বিপুল অংকের টাকা ও শেয়ার সার্টিফিকেট রয়েছে।

তিনি জানান, প্রধান উপদেষ্টা লুটের টাকায় ম্যানেজমেন্টে ফান্ড গঠনের পরামর্শ দিয়েছেন। এ ফান্ডের মাধ্যমে ডিপোজিটর ও দরিদ্র জনগোষ্ঠীর কল্যাণার্থে লুটের টাকা ব্যয় হবে। পুরো টাকাটা সত্যিকার অর্থে বাজেট বা অন্যকোনো কিছুতে নিয়ে এসে পুরো টাকাটা দরিদ্র জনগোষ্ঠীর ম্যানেজমেন্ট ফান্ড হিসেবে ব্যবহৃত হবে।

টাকা পাচার করে যারা পালিয়ে গেছেন তারা আদালতে অপরাধী প্রমাণিত হওয়ার আগ পর্যন্ত সরকার কোন আইনে এটা করবে এ প্রসঙ্গে একজন গণমাধ্যম কর্মী জানতে চাইলে বাংলাদেশ ব্যাংক গভর্নর আহসান এইচ মনসুর বলেন, অবশ্যই আমরা আইনগতভাবে এটা করবো, কোনোমতেই আইনের ব্যতয় হবে না। আদালতের সিদ্ধান্ত হওয়ার পরে এবং আইনের সঠিক ধারা প্রয়োগের মাধ্যমে এ কার্যক্রম করতে হবে। প্রয়োজনবোধে আইন সংশোধন করতে হতে পারে। সেটা নিয়ে আইন মন্ত্রণালয়ের অ্যাটর্নি জেনারেল অফিস কাজ করছে।

‘এস আলম গ্রুপের ইসলামী ব্যাংকের শেয়ার ফেরত দিলে ব্যাংকিং খাত ঘুরে দাঁড়াবে।’

এর লক্ষ্যটা হচ্ছে একটি ফান্ড প্রতিষ্ঠা করা, যে ফান্ডের টাকা দিয়ে ব্যাংকগুলোকে আমরা ক্ষতিপূরণ দিতে পারবো, কারণ ব্যাংকগুলো তো বিশালভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। অধিকাংশ ক্ষেত্রে তাদের ব্যাংকে রীতিমতো লুট করা হয়। আর বাকি টাকা যেগুলো নন-ব্যাঙ্ক রিলেটেড, সে ধরনের সম্পদ সরকার আরেকটা ফান্ডে নিয়ে জনহিতকর কাজে ব্যয় করা হবে।

তিনি ইসলামী ব্যাংকের উদাহরণ টেনে বলেন, এ ব্যাংকে বিদেশি ভালো ভালো বিনিয়োগকারী ছিল কিন্তু তারা সব চলে গেছে। তারা বর্তমানে নাই এবং সেই শেয়ারগুলো একটি মালিকানাধীন ছিল সেটা এখন সরকারের কাছে অবরুদ্ধ অবস্থায় আছে। সে শেয়ারগুলো ট্রানজেকশন করা সম্ভব নয়।

তিনি বলেন, এখন আমরা দেখব সেই গ্রুপের কত লোন আছে, সেই লোনের টাকা তো উদ্ধার করতে হবে, যদি আমরা অর্ধেকও বা তার বেশি জদ্ধকৃত শেয়ার থেকে বের করতে পারি সেটা আমাদের কাজে লাগবে।

এস আলম গ্রুপের ইসলামী ব্যাংকের যে শেয়ার রয়েছে তার মূল্য হয়তো ১২ হাজার থেকে ১৫ হাজার কোটি টাকা হতে পারে। এ টাকা যদি আমরা ব্যাংকে ফেরত দেই, যাদের টাকা আত্মসাৎ করা হয়েছে তারা ও ব্যাংকিং খাত ঘুরে দাঁড়াবে।

আহসান এইচ মনসুর বলেন, জব্দ করা শেয়ারকে আমরা কী করবো? এটা বাংলাদেশ সরকারেরও দরকার নেই, বাংলাদেশ ব্যাংকেরও দরকার নেই। এটা আমরা একজন স্ট্যাটিজিক ইনভেস্টারের কাছে হস্তান্তর করবো।

আরও পড়ুনপাচারের টাকা ফেরত আনা সম্ভব: অর্থ উপদেষ্টাপাচারের অর্থ ফেরত আনার বিষয়ে যা বললেন অর্থ উপদেষ্টাপাচার অর্থ ফেরত আনতে তৎপর দুদক, আসছে এফবিআই

তিনি বলেন, হস্তান্তরের আগে সরকারকে টেম্পোরারি মালিকানা নিতে হবে। এ মালিকানা নিয়ে সরকার শেয়ার হস্তান্তর করতে পারবে। আরেকজনের মালিকানায় থাকা অবস্থায় এটা হস্তান্তর করা যাবে না। সেজন্য আমরা আইনানুগ ব্যবস্থা নিতে যাচ্ছি। নতুন বিনিয়োগকারীর কাছ থেকে যে অর্থ পাওয়া যাবে, ফান্ডের মাধ্যমে সেটা ব্যাংকে স্থানান্তর করা হবে।

পাচার করা অর্থ ফেরত আনা সহজ হবে না

পাচার করা টাকা ফেরত আনা সহজ হবে কি না এ ব্যাপারে জানতে চাইলে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর বলেন, টাকা কীভাবে ফেরত আনতে হয় সে ব্যাপারে আমাদের অভিজ্ঞতা নেই। আন্তর্জাতিক অভিজ্ঞতা অনুযায়ী পাচার করা টাকা আইনি প্রক্রিয়া শেষে ফেরত আনতে সাধারণত চার থেকে পাঁচ বছর সময় লাগে। তবে এ ব্যাপারে অন্তর্বর্তীকালীন কিছু ব্যবস্থা নেওয়া যায়।

যেমন বিদেশে তাদের যে সম্পদ আছে সে সম্পদ ফ্রিজ করা যায়। সেটা বছরখানেক বা তার চেয়ে কম সময়ের মধ্যে করা সম্ভব। সেটা করতে দেশে সঠিক আইন প্রক্রিয়া সম্পন্ন করতে হবে তারপর বিদেশে (এমএলএ বা মিউচুয়াল লিগ্যাল এসিস্ট্যান্ট) রিকোয়েস্ট পাঠাতে হবে। এখন আমরা এ পর্যায়ে আছি এবং রিকোয়েস্ট পাঠাচ্ছি।

বিদেশিদের সহায়তা পাওয়া গেলে আমরা অ্যাসেট ফ্রিজ করতে পারবো। ফ্রিজ হলে পরে আদালতে আইনগত প্রক্রিয়া শুরু হবে, সেই প্রক্রিয়া সম্পন্ন হতে চার থেকে পাঁচ বছর সময় লেগে যায়।

তিনি বলেন ,আমাদের যে তথ্য সংগ্রহ, গুণগতমানে জিনিসগুলো বিদেশি কোর্টে রায় পাওয়ার ক্ষেত্রে একটা বিরাট ভূমিকা রাখবে। কাজেই আমাদের এখানে অনেক তথ্য সংগ্রহ করতে হবে, সরবরাহ করতে হবে এবং বিদেশে আইনি প্রক্রিয়া শুরু করতে হবে।

বাংলাদেশ ব্যাংকে দুর্নীতির তদন্ত করবে দুদক

বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তাদের দুর্নীতি প্রসঙ্গে তিনি বলেন, দুর্নীতি যদি হয়ে থাকে সেখানে দুদক আছে, তারা সেটাকে তদন্ত করবে, তদন্ত করে যদি তারা দেখেন সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে চার্জশিট আনা যাবে তাহলে তারা চার্জশিট দাখিল করবেন। এখানে দুদককে কেউ বাধা দিচ্ছে না, দুদক তার নিজস্ব প্রক্রিয়া এ কাজটা করবে। এখানে আমার মন্তব্য করা সমীচীন হবে না।

নগদের ব্যাপারে যা বললেন ব্যাংক গভর্নর

নগদের ব্যাপারে আমাদের অবস্থান সুস্পষ্ট। আমরা মনে করি নগদে যারা অরিজিনাল ম্যানেজমেন্ট এবং বোর্ড ছিল তাদের মাধ্যমে অর্থ আত্মসাৎ করেছে তার পরিমাণ ৬৫০ কোটি টাকা।

‘নগদ কোনো ক্ষতি করতে পারবে না কারণ আমরা ব্যাংকগুলোকে বলে দিয়েছি বড় কোনো ট্রানজেকশন না করতে।’

সরকারের দারিদ্র্য বিমোচন কর্মসূচির অধীনে যে ধরনের অর্থ স্থানান্তর করা হতো নগদের মাধ্যমেই করা হতো। এখানে তারা প্রায় দুই হাজার কোটি টাকার মতো আত্মসাৎ করেছে। এটা বাংলাদেশ ব্যাংকের অডিট ও ইন্টারন্যাশনাল অডিট ফার্মের অডিটও ধরা পড়েছে। আমরা মনে করি তাদের হাতে নগদের কার্যক্রম আবার ফিরে যাওয়া মোটেই উচিত নয়। যেহেতু কোর্টের একটা সিদ্ধান্ত হয়েছে, আমরা কোর্টের পূর্ণাঙ্গ বেঞ্চে আপিল করেছি, শিগগির শুনানি হবে, আমরা মনে করি আমরা আমাদের পক্ষে রায় পাবো। এ সময়ের মধ্যে তারা তাদের পুরো কন্ট্রোল কিন্তু পুরো সিস্টেমে নিয়ে নিয়েছে। তারা অনেক কিছুই করে ফেলতে পারে, এতে আমাদের হাত থাকবে না কারণ এটি এখন আদালতের বিষয়।

নগদ প্রসঙ্গে তিনি আরও বলেন, বড় কোনো ক্ষতির সম্ভাবনা নাই কারণ আমরা ব্যাংকগুলোকে বলে দিয়েছি বড় কোনো ট্রানজেকশন তারা করবে না। শুধু ক্যাশ ইন ও ক্যাশ আউট করতে পারবে। আমরা আমাদের দিক থেকে সেফকার্ড নিয়ে নিয়েছি। তবে তারা যেটি করবে বা করতে পারে আমরা সন্দিহান সেটা হলো তারা যে অপকর্মগুলো করেছে সেগুলোকে মুছে ফেলার চেষ্টা করবে। তারা ডাটাবেজকে মুছে ফেলার চেষ্টা করবে, যা আমাদের কাজকে আরও কঠিন করে তুলবে। নতুন করে বড় কিছু ক্ষতির সম্ভাবনা হয়তো তাদের থাকবে না।

বিশ্বের বিভিন্ন দেশ সর্বাত্মক সহায়তার আশ্বাস

পাচার করা অর্থ ফিরিয়ে আনার ব্যাপারে আরেক প্রশ্নের জবাবে আহসান এইচ মনসুর বলেন, যেসব দেশে টাকা পাচার হয়েছে আমরা তো দেশগুলোর সঙ্গে কথা বলছি। বর্তমানে ইউকে সরকারের একটি প্রতিষ্ঠান ছয় মাসের জন্য একজন ব্রিটিশ এক্সপার্ট দিয়েছে।

তিনি আমাদের তদন্ত কর্মকর্তাদের কীভাবে এভিডেন্স তৈরি করতে হয়, কীভাবে কেসগুলোকে ডকুমেন্টেশন করতে হয় তা হাতে কলমে শেখাবে। মামলায় জিততে হলে দেশীয় মানে নয়, আন্তর্জাতিক মানের এভিডেন্স গেদারিং করতে হবে। এ জায়গায় আমাদের গ্যাপ আছে। আমরা চেষ্টা করছি সে গ্যাপগুলো মেটাতে, আমাদের তথ্য কর্মকর্তাদের নতুন করে ট্রেনিং দেওয়া হচ্ছে, আন্তর্জাতিক মানসম্মত কার্যক্রম যেন পরিচালনা করতে পারে সেজন্য তাদের সেই মানের ট্রেনিং দেওয়া হচ্ছে। এক্ষেত্রে ডকুমেন্টেশন খুবই গুরুত্বপূর্ণ বলে তিনি মন্তব্য করেন। বিদেশিরা আমাদের সর্বাত্মক সহায়তার আশ্বাস দিচ্ছেন। তাদের রিকোয়ারমেন্ট অনুযায়ী আমরা তাদের কাছে তথ্যভিত্তিক রিকুয়েস্ট পাঠাবো।

বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর জানান, দুই প্রকারের জব্দ করা সম্পদ রয়েছে। এক. ব্যাংক থেকে ঋণ হিসেবে যা নেওয়া হয়েছে তা পরিশোধ করা হয়নি, এক্ষেত্রে ব্যাংকের কাছে আমরা টাকাটা ফেরত দেব।

দ্বিতীয়ত: ব্যাংকের ঋণ ছাড়াও অন্যভাবেও সম্পদ অর্জন করে অসুদুপায়ে অর্থ আত্মসাৎ করা হয়েছে। উদাহরণস্বরূপ তিনি সাবেক আওয়ামী সরকারের ভূমি মন্ত্রীর কথা উল্লেখ করে বলেন, তিনি ভূমিমন্ত্রী হিসেবে অর্থ আত্মসাৎ করতে পারে, সেই অর্থগুলো তো ব্যাংকে যাবে না, সেটা সাধারণ মানুষের কল্যাণ ব্যবহার করা হবে।

তিনি বলেন, জয়েন্ট ইন্টারোগেশন টাস্ক ফোর্স গঠন করা হয়েছে, তারা কাজ করছে, তাদের জন্য আন্তর্জাতিক মানসম্মত ট্রেনিং এর ব্যবস্থা করেছি। আগামী ৬ মাস ধরে তারা হাতে-কলমে কাজ করবে। সার্বিকভাবে মানোন্নয়নের কাজ চলছে। এটি একদিনের প্রক্রিয়া নয়, তারা এভিডেন্স কালেক্ট করছেন। আমরা সেটা নিয়ে আলোচনা করেছি। সব বিষয় তো বলা যাবে না, অগ্রগতি হচ্ছে, আমরা সেই অগ্রগতি পর্যালোচনা করে যাচ্ছি।

যৌথ তদন্ত দল তারা ১১টা গ্রুপে বিভক্ত হয়ে যার যার গ্রুপের সম্পদ তারা আলাদা আলাদা ভাবে আমাদের দিয়েছে, আমরা সেটাকে আলাদা আলাদাভাবে ট্রিট করব। একজনের সম্পদের বিবরণী আরেকজনের জানার দরকার নাই।

তিনি বলেন, আমরা এখনো নতুন নতুন সম্পদ উদঘাটন করছি। এটি একটি প্রক্রিয়াধীন ব্যাপার। যে সম্পদ আমরা এরই মধ্যে দিয়েছি তার ওপর ভিত্তি করেই মামলা দায়ের করা হয়েছে।

আরও পড়ুনপাচার হওয়া অর্থ ফেরাতে শ্রীলঙ্কার সহায়তা চেয়েছে সরকারপাচারের অর্থ ফেরাতে এফবিআইসহ আন্তর্জাতিক সংস্থার সঙ্গে বৈঠকপাচারের অর্থ ফেরাতে বিদেশি পরামর্শক প্রতিষ্ঠান নিয়োগ অনুমোদন

দেশে-বিদেশে জব্দ করা টাকা ও শেয়ারের সার্বিক মূল্য কত জানতে চাইলে তিনি বলেন, এটা এখনই বলা যাবে না। এর পরিমাণ ক্রমেই বাড়ছে এবং বাড়তেই থাকবে। কারণ নতুন নতুন অর্থ উদঘাটিত হয় এবং হিসেবে যোগ হয়। আইনগতভাবে আমাদের দালিলিক প্রমাণ উদঘাটন করতে হয়। এগুলো আদালতে বিচারাধীন বিষয় বলে তিনি জব্দ করা শেয়ার ও টাকার অংক বলতে চাইছিলেন না। যখন আদালতের রায় হবে তখন টাকার অংক বলা যাবে বলে তিনি মন্তব্য করুন।

ফান্ড গঠন ও কার্যক্রম কী এ সরকারের আমলে হবে

প্রধান উপদেষ্টার নির্দেশে জব্দ করা অর্থ দিয়ে যে ফান্ড গঠনের কথা বলা হচ্ছে সেটি বর্তমান সরকারের আমলে গঠন ও ব্যবহার করা যাবে কি না এমন প্রশ্নের জবাবে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর বলেন, এ সরকারের আমলেই এ ফান্ড গঠন ও ব্যবহার করা যাবে। কারণ এ টাকাটা সরকারের ফান্ডে রয়েছে। আইনগত প্রক্রিয়া দ্রুত শেষ করতে পারলেই, প্রয়োজনে আইন পরিবর্তন করে এ ফান্ড সরকারের কাছে হস্তান্তর হবে।

যেসব পাচারকারী নাগরিকত্ব গ্রহণ করেছেন তাদের ব্যাপারে যা বললেন বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর

ইউকে, যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, ইউএই, সিঙ্গাপুরসহ বিভিন্ন দেশে যারা টাকা পাচার করেছেন তাদের অনেকেই নাগরিকত্ব গ্রহণ করেছেন, সেক্ষেত্রে পাচার করা টাকা পুনরুদ্ধার করা সম্ভব হবে কি না এমন এক প্রশ্নের জবাবে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর জানান, সবগুলো দেশই টাকা পুনরুদ্ধারের ব্যাপারে সহায়তার আশ্বাস দিয়েছে। যদি আমরা প্রমাণ করতে পারি যে আমাদের টাকা পাচার করেই তারা সে দেশে নিয়েছে তাহলে তাদের নাগরিকত্ব বাতিল করতে পারে। তবে সব কিছু প্রমাণ করার দায়ভার আমাদের ওপর। দেশি-বিদেশি গণমাধ্যমে অর্থপাচারের ব্যাপারে প্রয়োজনীয় প্রচারণা সফলভাবে করা গেলে রাজনৈতিক চাপ বাড়বে, পাশাপাশি যথাযথ প্রমাণ দিতে পারলে অর্থ ফিরিয়ে আনার ব্যাপারে সফলতা আসবে বলে তিনি আশাবাদ ব্যক্ত করুন।

এমইউ/এমআরএম/জেআইএম