প্রবাস

বিশ্বব্যাপী অশান্তি কারও জন্য মুনাফার উৎস

বিশ্বব্যাপী অশান্তি কারও জন্য মুনাফার উৎস

একবিংশ শতাব্দীর বিশ্বে আমরা যেন এক ভয়াবহ বৃত্তে আটকে পড়েছি—যেখানে শক্তিশালী দেশগুলো শান্তির নামে যুদ্ধের জ্বালানি জোগায়, সন্ত্রাস নির্মূলের নামে সন্ত্রাসকে উসকে দেয়, আর গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার নামে স্বৈরতন্ত্রকে টিকিয়ে রাখে। এই বিশ্বে জাতিসংঘ আছে, আছে ন্যাটো, আছে কূটনৈতিক চুক্তির হাজারো ফ্রেমওয়ার্ক। তবুও বিশ্বব্যাপী অশান্তির যেন কোনো অন্ত নেই। কারণ এই অশান্তি কারও কারও জন্য মুনাফার উৎস।

Advertisement

আমেরিকা, বিশ্বের সবচেয়ে বড় অস্ত্র রপ্তানিকারক দেশ, ২০২৩ সালে একাই প্রায় ২৪০ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের অস্ত্র বিক্রি করেছে—যার একটি বড় অংশ গেছে মধ্যপ্রাচ্য ও ইউরোপে। সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরাত, কাতার—সবাই মার্কিন অস্ত্রের অন্যতম ক্রেতা। একইসাথে ইজরায়েলকে দেওয়া হয় প্রতি বছর ৩.৮ বিলিয়ন ডলারের সামরিক সহায়তা, যার মাধ্যমে এই দেশটি যেন নির্বিচারে ফিলিস্তিনের বেসামরিক জনগণের ওপর হামলা চালিয়ে যেতে পারে।

অন্যদিকে ইউক্রেন যুদ্ধ যেন আরেকটি সুযোগ হয়ে এসেছে অস্ত্র শিল্পের জন্য। রাশিয়ার আগ্রাসনকে কেন্দ্র করে ইউরোপে ছড়িয়ে পড়েছে ভয় ও অনিশ্চয়তা, আর আমেরিকার অস্ত্র কোম্পানিগুলো রাতারাতি চুক্তি সই করে ফেলে ইউরোপীয় দেশগুলোর সঙ্গে। পোল্যান্ড, জার্মানি, ফ্রান্স, সুইডেন—সবাই সামরিক বাজেট বাড়াচ্ছে, পুরোনো অস্ত্র পাল্টে নিচ্ছে নতুন প্রযুক্তি। Lockheed Martin, Raytheon, General Dynamics-এর মতো কোম্পানিগুলোর শেয়ারের দাম আকাশছোঁয়া।

তবে এই সন্ত্রাস আর যুদ্ধের খেসারত কে দিচ্ছে? দিচ্ছে সাধারণ মানুষ। গাজার শিশুরা, ইউক্রেনের বৃদ্ধারা, সিরিয়ার উদ্বাস্তু পরিবারগুলো, ইয়েমেনের অনাহারে মরতে থাকা মানুষগুলো। দিচ্ছে আফ্রিকার দরিদ্র কৃষক, বাংলাদেশের দিনমজুর, ভেনেজুয়েলার চিকিৎসা-নির্ভর মায়েরা। আর দিচ্ছে তাদের ছেলেমেয়েরা, যারা টিকটকের বডি ইমেজ সংকট থেকে শুরু করে ড্রোনের ছায়ায় বড় হচ্ছে এক অনিশ্চিত ভবিষ্যতের দিকে।

Advertisement

জাতিসংঘ কেবল বিবৃতি দেয়। ন্যাটো কেবল অস্ত্র পাঠায়। বিশ্বব্যাংক ও আইএমএফ কেবল ‘নিরপেক্ষ শর্তে’ ঋণ দেয়, যার ফলে গরিব দেশগুলোর স্বাস্থ্য ও শিক্ষা বাজেট কাটা পড়ে। মধ্যবিত্ত ধ্বংস হচ্ছে, ধনী আরও ধনী হচ্ছে। সামরিক ব্যয় বাড়ে, অথচ রোগ প্রতিরোধে ভ্যাকসিন আসে না সময়মতো। এই হচ্ছে আমাদের বিশ্বব্যবস্থা—যেখানে ‘শান্তি’ মানে অস্ত্র, ‘উন্নয়ন’ মানে করপোরেট মুনাফা, আর ‘নিরাপত্তা’ মানে সাধারণের ওপর নজরদারি।

এই বাস্তবতাকে অস্বীকার করে লাভ নেই। বরং দরকার সাহস করে সত্য বলার। যারা যুদ্ধ চায়, তারা কখনোই শান্তি আনবে না। যারা দারিদ্র্য তৈরি করে, তারা দানবীর নয়। অস্ত্র উৎপাদন করে কেউ ‘নোবেল শান্তি পুরস্কার’ পাওয়ার যোগ্য নয়। আমাদের দরকার নতুন এক বিশ্বচিন্তা—যেখানে মানবতা হবে কেন্দ্রবিন্দু, ভয় নয়; যেখানে দারিদ্র্য হবে ধ্বংসের শত্রু, লাভ নয়; যেখানে শিশুর কান্না হবে যুদ্ধের অবসানের ডাক, বিজয়ের নয়।

আমেরিকা ও চীন বর্তমানে ‘নতুন ঠান্ডা যুদ্ধে’ লিপ্ত, যার কেন্দ্রবিন্দু ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চল। দক্ষিণ চীন সাগর, তাইওয়ান, দক্ষিণ কোরিয়া—সব জায়গায় অস্ত্র সঞ্চালন বাড়ছে, নৌবহর মোতায়েন হচ্ছে। এই উত্তেজনার প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশকেও যুক্তরাষ্ট্র, ভারত ও চীনের মধ্যকার এক সংঘর্ষ-প্রবণ করিডোরে পরিণত করা হচ্ছে। বারবার চাপ দেওয়া হচ্ছে সামরিক চুক্তি (ACSA, GSOMIA) সই করতে।

শুধু অস্ত্র নয়—ঋণ, অবকাঠামো, বাণিজ্য চুক্তির মাধ্যমে বাংলাদেশসহ গরিব দেশগুলোকে অর্থনৈতিক জালে আটকে ফেলা হচ্ছে। চীন দেয় ইনফ্রাস্ট্রাকচার ঋণ, আমেরিকা চাপ দেয় কৌশলগত অবস্থানের বিনিময়ে সহযোগিতা নিতে, আবার IMF ও World Bank চাপ দেয় নীতিগত সংস্কারের নামে জনকল্যাণ খাতে কাটছাঁট করতে। এই দোটানায় পড়ে বাংলাদেশ আরও ভঙ্গুর হয়ে পড়ছে।

Advertisement

বিশ্বে প্রতি মিনিটে গড়ে ১২ লাখ মার্কিন ডলারের অস্ত্র বিক্রি হয়। অথচ UNICEF-এর হিসেবে, মাত্র ৪৫০ কোটি ডলারে বিশ্বের প্রতিটি শিশুর জন্য এক বছরের প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করা যেতো।

বিশ্ব যখন যুদ্ধ, অস্ত্র ও দুর্নীতির কুটচাল দিয়ে শাসিত হচ্ছে, তখন বাংলাদেশ কি মুক্ত? বরং আমাদের অবস্থান যেন সেই পুরোনো বৃত্তের অভ্যন্তরে একটি অসহায় উপকেন্দ্র। বিশ্বশক্তিগুলো যখন ভয়ের রাজনীতি চর্চা করে, তখন আমাদের রাষ্ট্রযন্ত্র যেন সেই ভয়কে অভ্যন্তরীণভাবে বহুগুণে বাড়িয়ে তোলে। এখানে রাজনৈতিক প্রতারণা ও দুর্নীতির এক জটিল জাল তৈরি হয়েছে, যার ভেতর পড়ে সাধারণ নাগরিক হারিয়ে ফেলছে নিজের নিরাপত্তা, স্বাধীনতা ও ন্যায়ের প্রত্যাশা।

প্রকাশ্যে খুন হচ্ছে মানুষ, দিবালোকে গুম হয়ে যাচ্ছে কণ্ঠস্বর। যারা প্রতিবাদ করে, তারা নিখোঁজ হয়—যারা চুপ করে, তারা দিনশেষে টিকে থাকলেও প্রতিনিয়ত ভীত ও আশাহীন। বিচারবিহীনতার এমন সংস্কৃতি তৈরি হয়েছে যে মানুষ এখন আর ন্যায়বিচার চায় না, শুধু বেঁচে থাকার সুযোগ চায়। প্রতিটি অঙ্গনে—প্রশাসন, বিচার বিভাগ, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী—একটি ঘূর্ণিপাক চলছে, যেখানে ন্যায়ের বদলে দলীয় আনুগত্য পুরস্কৃত হচ্ছে।

আর এই অবস্থার মাঝে যখন ভারত হুমকি দেয় বা চাপে ফেলে, তখন মনে হয়—আমরা পরাধীন কোনো অনুগত প্রদেশ, স্বাধীন রাষ্ট্র নই। বাংলাদেশের ভূখণ্ড কেবল ভূগোলের মানচিত্রে স্বাধীন, বাস্তবে যেন সে এক করিডোর, এক স্ট্র্যাটেজিক ‘প্যাসেজ’—যার ওপর দিয়ে চলে পরাশক্তির গাড়ি, অথচ যার গৃহস্থ বাড়িগুলো ধ্বংস হয়ে যায় এই চাকার নিচে।

এই পরিস্থিতিতে মনে পড়ে যায় সেই গভীর অথচ কঠিন সত্যভাষী গানের কথা:

‘তুমি হাকিম হইয়া হুকুম কর, পুলিশ হইয়া ধরসর্প হইয়া দংশন কর, ওঝা হইয়া ঝাড়তুমি বাঁচাও তুমি মারো,তুমি বিনে কেহ নাই আল্লাহ…’

কিন্তু আজকের বাস্তবতা আমাদের আরও নির্মম এক সত্যের সামনে দাঁড় করায়। এখন আর মানুষ শুধু সৃষ্টিকর্তার ওপর নির্ভর করে না—কারণ সৃষ্টিকর্তার নামে যারা ক্ষমতার অপব্যবহার করে, তারা যেন নিজেরাই ‘ঈশ্বর’ হয়ে উঠেছে। রাজনীতি এখন নীতি নয় বরং এক ‘ডিভাইস’—যার মাধ্যমে জনগণকে শোষণ করা হয়। উন্নয়নের নামে ভোগ বিলাস, গণতন্ত্রের নামে দখলদারি।

এই বাংলাদেশের দিকে তাকিয়ে আমরা কি আশা করব, না প্রশ্ন করব—বিশ্বযুদ্ধের ছায়া যখন চারদিকে, তখন আমরা কি শুধুই এক নিরীহ পর্যবেক্ষক, না নিজের ভেতরেই এক অসহনীয় যুদ্ধক্ষেত্র?

এই প্রশ্নের উত্তর যদি না খুঁজে পাই, তাহলে বিশ্বব্যবস্থার ভাড়াটে শক্তিগুলোর মতো আমাদের নিজস্ব অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক ব্যবস্থাও নিঃসন্দেহে এই অশান্তিরই অংশীদার।

আমরা যদি প্রশ্ন না করি, জবাব খুঁজে না ফিরি—তবে আমরা এই ব্যবস্থার নীরব অংশীদার হয়ে থাকবো। এখনই সময় বিশ্বশান্তির নামে যারা অশান্তি ছড়ায়, তাদের মুখোশ খুলে দেওয়ার। বাংলাদেশকেও আর নিরীহ দর্শক হয়ে নয়, ন্যায়ের পক্ষে স্পষ্ট অবস্থান নিতে হবে—অভ্যন্তরীণভাবে যেমন, আন্তর্জাতিক পর্যায়েও তেমন। কারণ, যারা অন্যের লাশের ওপর দাঁড়িয়ে ‘উন্নয়নের’ জয়গান গায়, তারা ইতিহাসের নয়, মানবতার আদালতে অপরাধী হিসেবেই বিবেচিত হবে।

—রহমান মৃধাগবেষক এবং লেখকসাবেক পরিচালক, ফাইজার, সুইডেনRahman.Mridha@gmail.com

এমআরএম/জেআইএম