আন্তর্জাতিক

স্থলবন্দর ব্যবহারে নিষেধাজ্ঞা: ভারতের ক্ষতি কতটা?

স্থলবন্দর ব্যবহারে নিষেধাজ্ঞা: ভারতের ক্ষতি কতটা?

ভারত স্থলবন্দর দিয়ে বাংলাদেশের তৈরি পোশাক, প্রক্রিয়াজাত খাদ্য, প্লাস্টিক পণ্য, ফলের রস, তুলা, কাঠের আসবাবপত্র ইত্যাদি পণ্য আমদানি নিষিদ্ধ করেছে গত ১৭ মে। ভারতীয় থিংক ট্যাংক গ্লোবাল ট্রেড রিসার্চ ইনিশিয়েটিভের মতে, নয়াদিল্লির এই সিদ্ধান্তের বাংলাদেশের প্রায় ৭৭ কোটি ডলারের বাণিজ্য ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে, যা ভারতে বাংলাদেশের মোট রপ্তানির প্রায় ৪২ শতাংশ।

Advertisement

তবে, এই নিষেধাজ্ঞা শুধু বাংলাদেশের নয়, ভারতের নিজস্ব অর্থনীতি, ব্যবসায়ী, এবং ভোক্তাদের ওপরও উল্লেখযোগ্য ক্ষতি বা প্রভাব ফেলতে পারে। নিচে ভারতের সম্ভাব্য ক্ষতির কথা উল্লেখ করা হলো:

১. ভারতীয় আমদানিকারক ও ব্যবসায়ীদের ক্ষতি:

বাংলাদেশি পোশাকের ওপর নির্ভরশীলতা: ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্যগুলো (আসাম, ত্রিপুরা, মেঘালয়) এবং পশ্চিমবঙ্গের বাজারে বাংলাদেশের তৈরি পোশাক বেশ জনপ্রিয়। সেখানে তুলনামূলক সাশ্রয়ী মূল্যে পাওয়া যেতো এসব পোশাক।

কিন্তু এখন এই পণ্যগুলো কেবল কলকাতা এবং মুম্বাইয়ের নব সেবা সমুদ্রবন্দর দিয়ে আমদানি করা যাবে, যা লজিস্টিক খরচ বাড়াবে। ফলে ভারতীয় আমদানিকারকদের খরচ বৃদ্ধি পাবে এবং লাভের হার কমবে।

Advertisement

আরও পড়ুন>>

বাংলাদেশি পণ্য প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা, ক্ষতির শঙ্কায় ভারতীয় ব্যবসায়ীরা স্থলপথে বাংলাদেশি পণ্য আমদানিতে ভারতের নিষেধাজ্ঞার নেপথ্যে খরচ বাড়বে ৫ গুণ, ভারতের বাজার হারানোর শঙ্কায় রপ্তানিকারকরা

প্রক্রিয়াজাত খাদ্য ও অন্যান্য পণ্য: বাংলাদেশ থেকে আমদানি করা প্রক্রিয়াজাত খাদ্য, ফলের রস, এবং প্লাস্টিক পণ্য ভারতের স্থানীয় বাজারে প্রতিযোগিতামূলক দামে পাওয়া যায়। বিশেষ করে সেভেন সিস্টার্সখ্যাত উত্তরপূর্বের সাত রাজ্যে বাংলাদেশি পণ্যের ব্যাপক চাহিদা রয়েছে। সাম্প্রতিক নিষেধাজ্ঞার স্থানীয় আমদানিকারকরা বিকল্প উৎস খুঁজতে বাধ্য হবেন, যা সময়সাপেক্ষ এবং ব্যয়বহুল হতে পারে।

ড্যানিশ ফুডের হেড অব বিজনেস দেবাশীষ সিংহ জাগো নিউজকে বলেন, সেভেন সিস্টার্সের বাজারে ভারতের নিজস্ব পণ্যের চেয়ে বাংলাদেশের পণ্যের আধিক্য বেশি ছিল। কারণ ভারতের মূল ভূখণ্ডের কোম্পানিগুলোর চেয়ে আমাদের দেশের কোম্পানিগুলো কম খরচে সেখানে পণ্য পৌঁছাতে পারতো। সেই সুযোগ বন্ধ করার জন্য এই পদক্ষেপ বলে মনে হচ্ছে।

২. ভোক্তাদের ওপর প্রভাব:

দাম বৃদ্ধি: বাংলাদেশি পণ্যের আমদানি সীমিত হলে ভারতের ভোক্তাদের জন্য পোশাক, খাদ্য, এবং অন্যান্য পণ্যের দাম বাড়তে পারে। বিশেষ করে বাংলাদেশি পণ্যের ওপর নির্ভরশীল সেভেন সিস্টার্সের ভোক্তাদের বিকল্প পণ্যের জন্য বেশি মূল্য দিতে হবে।

Advertisement

পণ্যের প্রাপ্যতা হ্রাস: স্থলবন্দর দিয়ে আমদানি বন্ধ হওয়ায় এই অঞ্চলগুলোতে পণ্যের সরবরাহে ঘাটতি দেখা দিতে পারে, যা ভোক্তাদের অসুবিধার কারণ হবে।

ভারতে উল্লেখযোগ্য পরিমাণে কোমলপানীয় রপ্তানি করতো বাংলাদেশের আকিজ ফুড অ্যান্ড বেভারেজ লিমিটেড। প্রতিষ্ঠানটির হেড অব মার্কেটিং মাইদুল ইসলাম জাগো নিউজকে বলেন, ভারতের এ সিদ্ধান্তের পর আমরা সেখানকার যে অর্ডারগুলো ছিল, তার উৎপাদন স্থগিত করেছি। আমরা ভারতে বছরে চার থেকে পাঁচ লাখ কার্টন পণ্য রপ্তানি করতাম।

৩. উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় অর্থনীতিতে প্রভাব:

লজিস্টিক জটিলতা: আসাম, মেঘালয়, ত্রিপুরা, মিজোরাম, এবং পশ্চিমবঙ্গের স্থলবন্দরগুলো (যেমন, ফুলবাড়ি, চ্যাংড়াবান্ধা) বাংলাদেশি পণ্যের প্রবেশ বন্ধ হওয়ায় এই অঞ্চলের বাণিজ্য কার্যক্রম ব্যাহত হবে। এই স্থলবন্দরগুলো ভারতের অর্থনীতির জন্য গুরুত্বপূর্ণ। বাণিজ্য কমার ফলে স্থানীয় ব্যবসায়ী এবং পরিবহন শিল্পও ক্ষতিগ্রস্ত হবে।

চাকরি ও আয়ের ক্ষতি: পশ্চিমবঙ্গ এবং উত্তর-পূর্বাঞ্চলে বাংলাদেশি পণ্যের আমদানি ও বিতরণের সঙ্গে জড়িত শ্রমিক, পরিবহনকারীদের অনেকে কাজ হারাতে পারেন। আয়-রোজগারে ধস নামার আশঙ্কা রয়েছে ব্যবসায়ীদেরও।

পেট্রাপোল ক্লিয়ারিং এজেন্টস স্টাফ ওয়েলফেয়ার অ্যাসোসিয়েশনের (পিসিএএসডব্লিউএ) সদস্য কার্তিক চক্রবর্তী দ্য হিন্দুকে বলেন, ভারতের ভেতর দিয়ে বাংলাদেশের তৃতীয় দেশে পণ্য রপ্তানি নিষিদ্ধ (ট্রান্সশিপমেন্ট বাতিল) করার পরেও প্রতিদিন প্রায় ২০ থেকে ৩০টি প্রিমিয়াম পোশাক বহনকারী ট্রাক আসতো। কিন্তু সর্বশেষ আদেশের ফলে স্থলবন্দর দিয়ে এ ধরনের চলাচল সম্পূর্ণভাবে বন্ধ হয়ে যাবে। যখন অনুমতি ছিল, তখন ৬০ থেকে ৮০টি ট্রাকবোঝাই পোশাক ভারতে প্রবেশ করতো।

ভারতের নতুন স্থলবন্দর নিষেধাজ্ঞার ফলে সীমান্ত লজিস্টিক হাবের ট্রাকচালক এবং শ্রমিকরা ক্ষতিগ্রস্ত হবেন বলে নিশ্চিত করেছেন তিনি।

পেট্রাপোল স্থলবন্দর/ ফাইল ছবি: বিশ্ব ব্যাংক

৪. ভারতের রপ্তানি বাণিজ্যে প্রতিক্রিয়া:

বাংলাদেশ এরই মধ্যে ভারতীয় সুতা, চাল, কাগজ, মাছ, তামাক, এবং গুঁড়াদুধ আমদানিতে বিধিনিষেধ আরোপ করেছে। ভারতের নতুন নিষেধাজ্ঞার জবাবে বাংলাদেশ যদি আরও কঠোর পদক্ষেপ নেয়, তা ভারতের রপ্তানি বাণিজ্যের জন্য ক্ষতির কারণ হবে।

২০২৩-২৪ অর্থবছরে ভারত বাংলাদেশে প্রায় ১ হাজার ২২০ কোটি ডলারের পণ্য রপ্তানি করেছে, যা বাংলাদেশের ভারতে রপ্তানির (১৮০ কোটি ডলার) তুলনায় অনেক বেশি। ফলে, বাংলাদেশ পাল্টা ব্যবস্থা নিলে ভারতের রপ্তানি আরও কমতে পারে।

বাংলাদেশের বাণিজ্য উপদেষ্টা শেখ বশিরউদ্দীন গত ১৮ মে সচিবালয়ে এক ব্রিফিংয়ে বলেছেন, এই নিষেধাজ্ঞায় বাংলাদেশের তুলনায় ভারতীয় ব্যবসায়ীরাই বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবেন। কারণ ভারত বাংলাদেশে বেশি রপ্তানি করে থাকে।

৫. শিল্পের ওপর প্রভাব:

ভারতের পোশাক শিল্প: বাংলাদেশি পোশাকের আমদানি সীমিত হলে ভারতের স্থানীয় পোশাক শিল্প কিছুটা উপকৃত হতে পারে। তবে, ভারতীয় পোশাক প্রস্তুতকারকরা যদি বাংলাদেশি পোশাকের মতো সাশ্রয়ী মূল্যে পণ্য সরবরাহ করতে না পারে, তাহলে বাজারে ঘাটতি এবং মূল্যবৃদ্ধি অনিবার্য হবে।

কাঁচামালের আমদানি: ভারত বাংলাদেশে তুলা এবং সুতা রপ্তানি করে, যা বাংলাদেশের পোশাক শিল্পে ব্যবহৃত হয়। বাংলাদেশের রপ্তানি কমলে এই কাঁচামালের চাহিদাও কমে যেতে পারে, যা ভারতের তুলা ও সুতা রপ্তানিকারকদের ক্ষতি করবে।

৬. দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের অবনতি:

শেখ হাসিনার সরকারের পতন, ভারতের ট্রান্সশিপমেন্ট সুবিধা প্রত্যাহার এবং কিছু ভারতীয় পণ্য আমদানিতে বাংলাদেশের বিধিনিষেধ আরোপ নিয়ে বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ক এরই মধ্যে টানাপোড়েনের মধ্যে রয়েছে। নতুন নিষেধাজ্ঞা দুই দেশের সম্পর্ককে আরও খারাপ করতে পারে, যা ভবিষ্যতে ভারতের বাণিজ্য ও কৌশলগত স্বার্থের ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে।

৭. অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট:

বাংলাদেশের বিকল্প বাজার: বাংলাদেশ ভারতের পরিবর্তে চীন, ইউরোপ, বা অন্যান্য বাজারের দিকে ঝুঁকতে পারে। এটি ভারতের অর্থনৈতিক প্রভাব এবং বাংলাদেশের বাজারে প্রবেশাধিকার কমিয়ে দিতে পারে।

ভারতের অভ্যন্তরীণ চাপ: পশ্চিমবঙ্গ এবং উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্যগুলোর ব্যবসায়ী ও ভোক্তাদের ক্ষোভ এই নিষেধাজ্ঞার বিরুদ্ধে রাজনৈতিক চাপ সৃষ্টি করতে পারে, যা ভারত সরকারের জন্য অভ্যন্তরীণ সমস্যা হয়ে উঠতে পারে।

অর্থাৎ, ভারতের নতুন নিষেধাজ্ঞা বাংলাদেশের পোশাক ও অন্যান্য পণ্যের আমদানি সীমিত করলেও এটি দেশটির নিজস্ব অর্থনীতির ওপরও বিরূপ প্রভাব ফেলবে। ভারতীয় আমদানিকারক, ভোক্তা, এবং উত্তর-পূর্বাঞ্চলের ব্যবসায়ীরা বাড়তি খরচ, পণ্যের ঘাটতি এবং বাণিজ্য হ্রাসের মুখোমুখি হবেন। এছাড়া, বাংলাদেশের পাল্টা ব্যবস্থা এবং দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের অবনতি ভারতের রপ্তানি বাণিজ্য এবং অঞ্চলগত প্রভাবকে ক্ষতিগ্রস্ত করতে পারে।

কেএএ/