অর্থনীতি

উচ্চাভিলাষী নয়, প্রয়োজন বাস্তবসম্মত বাজেট

উচ্চাভিলাষী নয়, প্রয়োজন বাস্তবসম্মত বাজেট

দেশে উচ্চ মূল্যস্ফীতি রয়েছে। এর নিয়ন্ত্রণ প্রাধান্য দিয়ে ২০২৫-২৬ অর্থবছরের বাজেট করতে যাচ্ছে অন্তর্বর্তী সরকার। যেখানে বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির (এডিপি) ধীরগতি বাস্তবায়ন ও মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের প্রচেষ্টা থাকবে আসন্ন বাজেটে। এজন্য ব্যাংকখাত থেকে ঋণ নেওয়া কমানোর পরিকল্পনা রয়েছে। এসব কারণে সামগ্রিক বাজেটের আকার ছোট করার পরিকল্পনাও হয়েছে।

Advertisement

দেশি-বিদেশি বিনিয়োগ আকর্ষণে বিগত সময়ের অব্যবস্থাপনা, অবকাঠামো ও রাস্তাঘাট নির্মাণ, রাজস্ব ঘাটতি, আর্থিক খাতসহ নানান সংস্কার বিষয় নিয়ে অর্থনীতিবিদ এবং রিসার্চ অ্যান্ড পলিসি ইন্টিগ্রেশন ফর ডেভেলপমেন্টের (র্যাপিড) চেয়ারম্যান ড. মোহাম্মদ আব্দুর রাজ্জাকের সঙ্গে কথা বলেছে জাগো নিউজ। তার সাক্ষাৎকার নিয়েছেন জাগো নিউজের জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক ইয়াসির আরাফাত রিপন।

জাগো নিউজ: দেশের প্রেক্ষাপটে আগামী অর্থবছরের বাজেট কেমন হওয়া উচিত?

ড. মোহাম্মদ আব্দুর রাজ্জাক: সার্বিকভাবে বাস্তবসম্মত হতে হবে। বিলাসী লক্ষ্য থাকা উচিত হবে না। এখানে লক্ষ্য রাখতে হবে যে আমাদের অর্থনীতির ওপরে যে ঝড়ঝাপটা বয়ে গেছে এখান থেকে যেন আমরা পুরোপুরি ঘুরে দাঁড়াতে পারিনি। অতি উচ্চাভিলাষী থাকলে ভালো আউটকাম দেয় না। এ কারণে প্রথম কথা হলো আগামী বাজেট হতে হবে বাস্তবসম্মত।

Advertisement

দ্বিতীয়ত বাজেটের আকার হবে সাত লাখ ৯০ হাজার কোটি টাকা, মানে আগের বছর থেকে একটু কমেছে। আবার এটাও দেখতে হবে যে এই সাত লাখ ৯০ হাজার কোটি টাকা বাস্তবায়ন করাটা সম্ভব হবে কি না। এটা বাস্তবায়ন করতে হলে রাজস্ব আয়ে অনেক বেশি গতি থাকতে হবে। যেখানে রাজস্ব আয়ের গতি সেরকম বাড়েনি। এ বছর এখন পর্যন্ত প্রবৃদ্ধি খুবই কম। যে লক্ষ্যমাত্রা দেওয়া হবে, গণমাধ্যম থেকে জেনেছি সেটা হলেও খুব অতি উচ্চ প্রবৃদ্ধি। কাজেই রাজস্ব আদায়ে এত উচ্চ প্রবৃদ্ধি কীভাবে অর্জন করা হবে সেটা ঠিক করতে হবে। যদি শুধু বড় বাজেট দিই তাহলে সেটাও আমাদের জন্য ভালো হবে না।

আরও পড়ুন

সহজ হচ্ছে সঞ্চয়পত্র কেনা, টকটাইম-সিমে বাড়ছে না ভ্যাট ধার করে, টাকা ছাপিয়ে বাজেট বাস্তবায়ন করবো না: অর্থ উপদেষ্টা বাজেটের আকার বড় হবে না, বক্তৃতা হবে সংক্ষিপ্ত: অর্থ উপদেষ্টা আসছে ৭ লাখ ৯০ হাজার কোটি টাকার বাজেট

জাগো নিউজ: আগামী বাজেটের চ্যালেঞ্জ কী হতে পারে?

ড. মোহাম্মদ আব্দুর রাজ্জাক: এ বছরও আমাদের প্রবৃদ্ধি অনেক স্লো হয়েছে। সামনের বছর একটা ইস্যু আছে সেটা হলো আমরা যে এডিপি দেখি সেই এডিপিও কিন্তু যথেষ্ট বাস্তবসম্মত হতে হবে। এডিপি বাস্তবায়নে স্থবিরতা তো কাটছেই না বরং যেন চলছে আরও ধীরে চলো নীতিতে। রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের পর নানান সংস্কারের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। এডিপির আকার বড় না করে যদি এডিবির গুণগত মানের দিকে নজর দেই সেটা মঙ্গলজনক।

Advertisement

আরেকটা বিষয় হলো এ বছর ব্যাংকখাত থেকে অনেক ঋণ নিয়েছে সরকার। রাজস্ব আদায়ে যেহেতু গতি ছিল না, সে কারণে ব্যাংক ঋণের ওপরে ছিল সরকার। অন্তর্বর্তী সরকার আসার পরে দেখেছি যে রাজস্ব খাতে গতি ছিল না, বৈদেশিক সাহায্যও কম ছিল। কাজেই সরকারকে অনেক বেশি নির্ভর করতে হবে ব্যাংক ঋণের ওপরে। এ সরকার টাকা ছাপায়নি, তবে ব্যাংকিং সিস্টেমে বাণিজ্যিক ব্যাংক থেকে টাকা ঋণ নিয়েছে, সঞ্চয়পত্র থেকেও ঋণ নিয়েছে সরকার।

এই ঋণের সুদের হার বেশি। কাজেই ব্যাংকিং সিস্টেমে ঋণ নিলে সরকারের ওপরে সুদের চাপ পড়ে। সামনের বাজেটে সুদ মেটাতে বড় অংশ পরিশোধে খরচ করতে হবে। সব দিক থেকে মিলিয়ে যেরকম চাপের মধ্যে আমরা আছি, বেস্ট হচ্ছে এমন বাজেট করা যার মাধ্যমে অর্থনীতি স্থিতিশীল (স্ট্যাবিলাইজ) করতে পারি। স্ট্যাবিলাইজ করা হয় যখন মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ করা হয়, যখন ব্যালেন্স অব পেমেন্টে কোনো সমস্যা থাকে সেটাকে নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা করা হয়।

আরও পড়ুন

করারোপের আগে বাজার প্রভাব বিশ্লেষণ চান ব্যবসায়ীরা কৃষিপণ্য সরবরাহে উৎসে কর কমাতে ‘ইতিবাচক’ এনবিআর ‘নতুন সরকার বড় সুযোগ, এখানে বিনিয়োগ সম্ভাবনা রয়েছে’ এসএমই খাতে শিল্পবান্ধব কর ব্যবস্থা প্রণয়নে একগুচ্ছ প্রস্তাব

স্ট্যাবিলাইজের চেষ্টা করেন, তখন অর্থনীতির গ্রোথকে প্রাধান্য দিলে হবে না, তখন স্ট্যাবিলাইজের দিকে প্রাধান্য দিতে হবে। আবার রাজস্ব আয়ের গতি সেরকম বাড়েনি, এর গতি বাড়াতে হবে, এটাও বড় চ্যালেঞ্জ আমাদের। কাজেই বড় বাজেট করলেই লাভ হবে না। এসব চ্যালেঞ্জ আমাদের সামনে আছে। এসব চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় দিক-নির্দেশনা থাকতে হবে বাজেটে।

জাগো নিউজ: সঞ্চয়পত্র থেকে গত কয়েক বছর মুখ ফিরিয়েছে সরকার, এ বিষয়টা কীভাবে দেখছেন?

ড. মোহাম্মদ আব্দুর রাজ্জাক: সঞ্চয়পত্রের মাধ্যমে সঞ্চয়ে উৎসাহ দেওয়া খুব একটা ভালো পদক্ষেপ নয়। সঞ্চয়পত্র কেনা মানে সরকারের একটা কর্জ করা। এখানে যদি উচ্চ সুদের হারে সরকারকে কিনতে হয় তাহলে এর বিপরীতে সরকারের অতিরিক্ত ঋণ হয়ে যাচ্ছে। সঞ্চয়পত্রের মাধ্যমে বিনিয়োগ বাড়ানো বা সঞ্চয় বাড়ানো খুব ভালো উদ্যোগ নয়।

তবে কিছু সময়ের জন্য সরকার কিনতে পারে। কিন্তু দীর্ঘমেয়াদের জন্য করা আপাতত ঠিক হবে না। আসলে হয় কি ক্যাপিটাল মার্কেট স্ট্রং করে যারা সঞ্চয় করছে তারা ওসব জায়গায় বিনিয়োগ করতে পারে। আবার যদি অন্য কোনো প্রকল্প করার সুযোগ থাকে যেমন বেসরকারি সেক্টরের বিনিয়োগ, সেটা ব্যাংকের মাধ্যমে সঞ্চয় কিনে বেসরকারি খাত পায়, তাহলে সেটা ভালো উপায়। কারণ আমাদের রাজস্ব ব্যবস্থা দুর্বল, সেখানে উচ্চ সুদে ঋণ নিলে সরকার কীভাবে পরিশোধ করবে সেটা একটা বিষয় থেকেই যায়।

জাগো নিউজ: বিদেশি বিনিয়োগ টানার বিষয়ে আপনার পরামর্শ কী থাকবে?

ড. মোহাম্মদ আব্দুর রাজ্জাক: বিদেশি বিনিয়োগ আনতে তো সময় লাগে। কমিটমেন্ট করলেও সেটা সময়ের ব্যাপার। আগে যেসব জায়গায় আমাদের অব্যবস্থাপনা ছিল যেমন বন্দর, এয়ারপোর্ট, সড়ক-অবকাঠামো; এসব জায়গায় কি আমরা খুব বেশি উন্নত করতে পেরেছি? এগুলো আমরা আসলেই খুব বেশি উন্নত করতে পারিনি। অনেক সংস্কার কমিশন করা হয়েছে, ভালো সুপারিশ আছে, সদিচ্ছা আছে। তবে এখনো আমরা বাস্তবায়ন করতে পারিনি। ওয়ানস্টপ সার্ভিস যে ভালোভাবে চালাতে পারছি তাও কিন্তু নয়, সেগুলো নিয়ে নানান কথাবার্তা হচ্ছে। অবকাঠামোতো আছেই, বিদ্যুৎ-জ্বালানি নিয়েও অনেক লেখালেখি হচ্ছে।

কাজেই এমন পরিবেশে বিদেশি বিনিয়োগ তো কঠিন। যদি মূল্যস্ফীতির হার বেশি থাকে, ব্যালেন্স অব পেমেন্টে থাকে, ফরেন রিজার্ভ যদি কমে যেতে থাকে বা চাপের মধ্যে থাকে তাহলে বিদেশি বিনিয়োগকারীরা উৎসাহ বোধ করেন না। কারণ তারা ভাবেন এখানে বিনিয়োগ করলে সেফ রিটার্ন পাবো কি না, পয়সা ফেরত নিয়ে যেতে পারবো কি না ইত্যাদি। এ কারণে আমরা ফরেন বিনিয়োগ অত বেশি পাচ্ছি না। আবার লোকাল বিনিয়োগের ক্ষেত্রেও বাধা আছে। এখানে সুদের হার অনেক বেশি বেড়েছে। এত বেশি সুদ নিয়ে বিনিয়োগ করাটাও কঠিন বিনিয়োগকারীর জন্য। এ কারণে ব্যক্তি বিনিয়োগের ক্ষেত্রে একটা চাপ তৈরি হয়েছে।

আরও পড়ুন

আসন্ন বাজেটে তামাক পণ্যে কার্যকর করারোপের দাবি কৃষিখাতে সুনির্দিষ্ট প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা দরকার এডিপি ২ লাখ ৩০ হাজার কোটি টাকা, বড় অঙ্কের বরাদ্দ কমছে স্বাস্থ্যে আয়কর রিটার্ন জমা না দেওয়া ব্যক্তিদের নজরদারিতে আনছে এনবিআর

জাগো নিউজ: সরকারের সংস্কার নিয়ে বিশেষ করে আর্থিক খাত সংস্কার নিয়ে আপনার কাছে জানতে চাই।

ড. মোহাম্মদ আব্দুর রাজ্জাক: সংস্কারের মাধ্যমে সবচেয়ে বড় পরিবর্তন হয়েছে মনিটরিং পলিসি, আর্থিক পলিসি। ভালো সংস্কার আমরা দেখতে পাই। বিনিময় হারটাও বাজারের ওপরে ছেড়ে দিল কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এগুলো সংস্কারের অর্জন বা ফল। অনেক জায়গায়ই ভালো হয়েছে। ব্যাংকখাতে আগে অনেক অব্যবস্থাপনা ছিল, সেগুলোয় ভালো সংস্কার হয়েছে। বেশ কিছু ব্যাংকের (১৪ টি ব্যাংক) বোর্ড ভেঙে দিয়ে নতুন করে বোর্ড পরিবর্তন করা হয়েছে।

ব্যাংক থেকে এখন টাকা লুটপাট হচ্ছে বলে আমার জানা নেই, অর্থাৎ আর লুটপাট নেই, বন্ধ হয়েছে। এগুলো পজিটিভ দিক। কিন্তু সংস্কারের অনেক দিক আছে। কারণ সংস্কার করলেন কিন্তু অনেক দুর্বল ব্যাংক রয়েছে সংস্কারের পর তারা টিকে থাকবে কি না। তাদের কী করবেন সেটাও একটা বিষয়। সব মিলিয়ে সংস্কারের দিক যদি দেখা যায় সেটা ইতিবাচক অবস্থা আছে।

ইএআর/এমএমএআর/এমএফএ/এমএস