কূটনৈতিক প্রক্রিয়ায় যুক্তরাষ্ট্রের পারস্পরিক শুল্ক আরোপের প্রভাব মোকাবিলায় কার্যকর উদ্যোগ নেওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন বেসরকারি খাতের উদ্যোক্তারা। তারা জানান, রপ্তানি খাতের সুরক্ষা ও টেকসই করার লক্ষ্যে রাজনৈতিক সংস্কারের পাশাপাশি বাংলাদেশের কূটনৈতিক ও কৌশলগত উদ্যোগ নেওয়া অতীব জরুরি।
Advertisement
শনিবার (১৭ মে) ঢাকা চেম্বার অডিটোরিয়ামে ‘যুক্তরাষ্ট্রের পারস্পরিক শুল্ক এবং বাংলাদেশের কর্ম-পরিকল্পনা’ শীর্ষক সেমিনারে এ মন্তব্য করেন তারা। ঢাকা চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি (ডিসিসিআই) এবং বিজনেস ইনিশিয়েটিভ লিডিং ডেভেলপমেন্ট (বিল্ড) যৌথভাবে এ সেমিনারের আয়োজন করে।
মূল প্রবন্ধে বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) ফেলো দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেন, এ পরিস্থিতিকে অনেকেই দুর্যোগ হিসেবে বিবেচনা করছেন। তবে আমাদের এটিকে একটি সুযোগ হিসেবে গ্রহণ করে কার্যকর উদ্যোগ নিয়ে তা বাস্তবায়ন করতে হবে। আরোপিত পারস্পরিক শুল্কের প্রভাব মূলত পড়বে ভোক্তার ওপর এবং বৈশ্বিক বাজার সেটাকে ইতিবাচক হিসেবে নেবে না। এটি কতটা কার্যকর হবে, সে বিষয়ে তিনি সংশয় প্রকাশ করেন, এছাড়া বিষয়টি কেবল অর্থনৈতিক নয়, বরং অনেকাংশেই ভূ-রাজনৈতিক বলে তিনি অভিমত জ্ঞাপন করেন।
তিনি জানান, যুক্তরাষ্ট্র শুল্ক আরোপের ক্ষেত্রে সেবা খাতকে প্রাধান্য না দিয়ে পণ্য বাণিজ্যকে বেশি হারে গুরুত্ব দিয়েছে। বিষয়টি বাংলাদেশের নেগোশিয়েশনের ক্ষেত্রে সেবাখাতকে প্রাধান্য দিয়ে দ্বিপাক্ষিক আলোচনা চালানো প্রয়োজন বলে তিনি মত প্রকাশ করেন।
Advertisement
দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য আরও জানান, যুক্তরাষ্ট্রের বিবেচনায় এলডিসিভুক্ত দেশগুলোর বাজার ততটা গুরুত্বপূর্ণ না হলেও আমাদের জন্য যুক্তরাষ্ট্রের বাজার যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ, তাই বিষয়টি নিয়ে সুগঠিত, বহুমাত্রিক এবং বেসরকারিখাতকে সম্পৃক্ত করে কার্যকর পদক্ষেপ দ্রুত নিতে হবে।
আইসিসি বাংলাদেশের সভাপতি মাহবুবুর রহমান বলেন, আমাদের সঠিক পদ্ধতিতে কার্যকরভাবে নেগোশিয়েশন চালিয়ে যেতে হবে। বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার একজন সক্রিয় সদস্য হিসেবে যুক্তরাষ্ট্র যেভাবে পারস্পরিক শুল্ক আরোপ করেছে তা কাম্য নয়। বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের সঙ্গে বেসরকারিখাতের সম্পৃক্তকরণ আশানুরূপ নয়, তাই সরকারের সঙ্গে উদ্যোক্তাদের সম্পর্ক আরও জোরালো হতে হবে। তবে কোনো একক বাজারের ওপর রপ্তানির নির্ভরশীলতা কমিয়ে নতুন গন্তব্য যেমন: এশিয়া, মধ্যপ্রাচ্য ও আফ্রিকার প্রতি আমাদের মনোনিবেশ বাড়ানো প্রয়োজন।
ঢাকা চেম্বারের সাবেক সভাপতি ও শাশা ডেনিমস লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক শামস মাহমুদ বলেন, যুক্তরাষ্ট্রে ভোক্তাদের চাহিদা কমার ফলে আমাদের রপ্তানি কমে যাওয়ার আশঙ্কা তৈরি হবে। তৃতীয় কোনো দেশ হতে যুক্তরাষ্ট্রের পণ্য আমদানির ক্ষেত্রে তারা যেন বিষয়টিকে সরাসরি যুক্তরাষ্ট্র হতে আমদানি হিসেবে গণ্য করে, তা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে আলোচনা পর্বে উত্থাপন করতে হবে। বর্তমান সরকার যে সংস্কার কার্যক্রমগুলো হাতে নিয়েছে, তা স্বল্পসময়ে বাস্তবায়নের ওপর তিনি জোরারোপ করেন।
বাংলাদেশ টেক্সটাইল মিলস্ অ্যাসোসিয়েশনের (বিটিএমএ) পরিচালক ইঞ্জিনিয়ার রাজিব হায়দার বলেন, চাহিদা মত জ্বালানি সরবরাহ না থাকায় বস্ত্র খাতের ব্যাকওয়ার্ড লিংকেজের প্রায় ৪০ শতাংশ উৎপাদন বন্ধ হয়ে গেছে, তাই শিল্পের চাহিদা মেটাতে এলএনজি আমদানির ওপর তিনি জোরারোপ করেন।
Advertisement
তিনি বলেন, যুক্তরাষ্ট্রের তুলা তুলনামূলক বেশ দামি এবং গুণগত মানও বেশ ভালো, তবে আমদানিতে তিনমাসের বেশি সময় লেগে যাওয়ায়, এখাতের উদ্যোক্তারা তুলা আমদানিতে নিরুৎসাহিত হন। এ সমস্যা সমাধানে আমেরিকার তুলা রপ্তানিকারকদের বাংলাদেশে ওয়ারহাউজ সুবিধা দিলে তুলার আমদানি চারগুণ বাড়বে বলে তিনি মতপ্রকাশ করেন।
ডিসিসিআই সভাপতি তাসকীন আহমেদ বলেন, ক্রমবর্ধমান ভূ-রাজনৈতিক উত্তেজনা এবং বৈশ্বিক বাণিজ্যের গতিশীলতার পরিবর্তনের সন্ধিক্ষণের মধ্যে রয়েছে বাংলাদেশ।
তিনি উল্লেখ করেন, নিজেদের অপ্রচলিত বাজার সম্প্রসারণ, মুক্ত বাণিজ্য চুক্তিকে ত্বরান্বিত করা, কার্যকর ও কৌশলগত অর্থনৈতিক কূটনীতির জোরারোপ, নতুন প্রযুক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে প্রতিযোগিতা সক্ষমতার উন্নতি ও মানব সম্পদের দক্ষতার বিকাশে উদ্যোগী হওয়া প্রয়োজন।
তিনি বলেন, স্বল্পসময়ের মধ্যে প্রস্তাবিত শুল্ক চ্যালেঞ্জ মোকাবিলার জন্য সরকারি-বেসরকারি খাতের সম্পৃক্তকরণের মাধ্যমে একটি কৌশলগত উদ্যোগ গ্রহণ অপরিহার্য বলে মতপ্রকাশ করেন তাসকীন আহমেদ।
বিল্ডের চেয়ারম্যান আবুল কাসেম খান বলেন, যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বাংলাদেশের মুক্ত বাণিজ্য চুক্তি সইয়ের সম্ভাবনা যাচাই, রপ্তানি পণ্যের বহুমুখীকরণে পর্যাপ্ত নীতিসহায়তা নিশ্চিত করতে হবে। নতুন বাজার সম্প্রসারণে রোডম্যাপ প্রণয়ন, আসিয়ানের সদস্যভুক্তির জন্য বাংলাদেশের সক্ষমতা বাড়ানো, বাণিজ্য ও বিনিয়োগ প্রক্রিয়া সহজীকরণে সরকারি সহায়তার দীর্ঘসূত্রতা হ্রাস, বাংলাদেশি ব্যবসায়ীদের বিদেশে বিনিয়োগের সুযোগ দান এবং সরবরাহ শৃঙ্খল ব্যবস্থাপনার ব্যয় হ্রাসের সক্ষমতা বাড়াতে হবে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক মো. মেসবাউল হক বলেন, বাজারে টাকার সরবরাহ বেশ ভালো। তবে শিল্পখাতের আর্থিক চাহিদা মেটাতে ব্যাংকখাতের ওপর বেশি নির্ভরশীল হওয়ায়, ব্যাংক ব্যবস্থার ওপর চাপ প্রতিনিয়ত বাড়ছে। আর্থিক খাতের বাজারে কাঠামোগত দক্ষতা বাড়ানো না গেলে, আর্থিক ব্যবস্থাপনায় স্থিতিশীলতা ফিরে আসবে না।
বাণিজ্য সচিব মাহবুবুর রহমান বলেন, যুক্তরাষ্ট্র থেকে পণ্য আমদানি বাড়িয়ে দুদেশের বাণিজ্য ঘাটতি কমাতে আমরা আগ্রহী। এ লক্ষ্যে দ্বিপাক্ষিক কার্যক্রম অব্যাহত রয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র থেকে তুলা আমদানিতে বাংলাদেশে ওয়ারহাউজ স্থাপনের কথা এরই মধ্যে বলা হয়েছে এবং যুক্তরাষ্ট্র হতে দীর্ঘমেয়াদে এলএনজি আমদানির চুক্তি করা হয়েছে। যার মাধ্যমে দুদেশের মধ্যকার এক বিলিয়ন ডলারের বাণিজ্য বাড়বে। তৃতীয় দেশ হতে যুক্তরাষ্ট্র পণ্য আমদানির বিষয়টি প্রথম আলোচনা পর্বে উপস্থাপন করা হবে, যেন তারা এটাকে সরাসরি বাণিজ্য হিসেবে গণ্য করে, এক্ষেত্রে সেবাখাতে অন্তর্ভুক্ত করার কথা বলা হবে।
ইএআর/এমএএইচ/