হামবুর্গের সকালটা ছিল নরম। রোদের আলোয় তখনো তেজ আসেনি। শহরের ব্যস্ততা পুরোপুরি। আমি ব্রেমেন থেকে হামবুর্গে এসেছি ডা. পারভেজ ভাই ও তার সহকর্মীদের নিয়ে ডেনমার্কের টনডারে যাওয়ার জন্য। অপেক্ষা করছি হামবুর্গ ট্রেন স্টেশনে– বলা চলে ডা. পারভেজ ভাই এই দলের প্রাণভোমরা। পারভেজ ভাই দিগন্তে তাকিয়ে হঠাৎ বললেন, ‘চলেন হারিয়ে যাই?’ এক মুহূর্তের স্তব্ধতা।
Advertisement
ডেনমার্কের দক্ষিণ প্রান্তে, জার্মান সীমান্ত ছুঁয়ে থাকা ছোট্ট এক শহর। নদী নেই, পাহাড় নেই, কিন্তু না কি শান্তি আছে। গাঢ়, গভীর, নির্ভার এক শান্তি। টিকিট আগেই কাটা হলো। প্ল্যাটফর্মে পা পড়লো। ট্রেন এলো গরিমা নিয়ে।
সকাল ৯টার দিকে হামবুর্গ থেকে টনডারের দিকে যাত্রা। জানালার বাইরে গমক্ষেত, গোলাকার টারবাইন, দূরের গির্জা— সব মিলিয়ে যেন পেইন্টিংয়ের ফ্রেম। কনফারেন্সের গাম্ভীর্য ঝরে গিয়ে তার সহকর্মীদের চোখে-মুখে ফুটে উঠলো শিশুতোষ কৌতূহল।
ডা. পারভেজ ভাই হেসে বললেন, ‘আমরা আসলে আজ রোগী নয়, জীবন দেখতে বেরিয়েছি।’ ট্রেনের ধাতব শব্দের মাঝে চুপচাপ কেউ একজন মুখে গুনগুন করছিল,
Advertisement
‘এই পথ যদি না শেষ হয়...’
টনডারে প্রথম পদার্পণ: নিস্তব্ধতার বিস্ময়প্রায় সাড়ে ১১টার দিকে যখন ট্রেন থামল টনডার স্টেশনে, মনে হলো শহরটা যেন ঘুম থেকে সদ্য জেগে উঠেছে। বাতাসে ছিল সজীবতা, দূরে পাখির ডাক। ট্রেন থেকে নামতেই শহর যেন আপন করে নিল চিকিৎসকদের—যেন বললো, ‘এসো, কিছুক্ষণের জন্য মন রেখে যাও এখানে।’
হেঁটে চলা শুরু হলো। রাস্তার ধারে ছোট ছোট ঘর, জানালায় ফুলের টব, দরজায় কাঠের ঘণ্টা। প্রতিটি বাড়ি যেন আপন মনের মতো সাজানো। কোনো তাড়াহুড়ো নেই, কেউ দৌড়াচ্ছে না, কেউ হর্ন বাজাচ্ছে না। এ শহরের ভাষা চোখের ভাষা, আর মুদ্রা সময়ের ধৈর্য।
টনডার ক্রিস্টিক্রিক: এক পবিত্র শূন্যতাপুরোনো গির্জা—ক্রিস্টিক্রিক। প্রাচীন ইটের দেয়ালে সময় জমে আছে। একজন চিকিৎসক ধীরে পেছন থেকে বললেন, ‘এই শহরে আসা, যেন নিজের ভেতরের ক্যানভাসে রং তোলা।’
Advertisement
গির্জার ভেতরে নীরবতা এতটাই ঘন, মনে হয় শব্দও থমকে দাঁড়িয়েছে। কেউ একজন প্রার্থনায় বসে চোখ বন্ধ করলেন। তার মুখে প্রশান্তি, যেন এতদিন পর নিজের মধ্যে ফিরে গেছেন।
ক্যাফের গল্প, কফির ধোঁয়া আর বন্ধুত্বভ্রমণ মানেই একটু স্বাদ। শহরের মাঝখানে একটি নাম না জানা কাঠের দরজার ওপারে পাওয়া গেলো এক পুরোনো ক্যাফে। নাম ‘লিলি কাফেস্তু’, মানে ছোট্ট কফির ঘর।
চায়ের কাপে ধোঁয়া, হালকা বৃষ্টির ফোঁটা জানালার কাঁচে, আর টেবিলজুড়ে গল্প—চিকিৎসা, দেশ, বাংলা, গান, আর স্বপ্নের।
একজন কৌতুক করে বললেন, ‘ডায়াবেটিসের সব ওষুধ জানা, কিন্তু মন ভালো রাখার ট্যাবলেট তো নেই!’ ডা. পারভেজ উত্তর দিলেন, ‘আজকের ট্রিপটাই তো সেই ওষুধ।’
দুপুর গড়িয়ে বিকেল। শহরের অলিগলি ধরে হাঁটতে হাঁটতে মনে হচ্ছিল— এ শহরের দেয়ালেও গল্প লেগে আছে। সময়ের সাথে সাথে গাঢ় হতে থাকলো আলো। আকাশে ছিল লালচে রং, শহরের গায়ে এক রকম কোমলতা। ফিরতি ট্রেনের সময় ঘনিয়ে এলো।
সন্ধ্যার ট্রেনে ফেরার পথ, কিন্তু মন রয়ে গেলোফেরার ট্রেনটি চলে এলো নির্দিষ্ট সময়ে, ইউরোপের শৃঙ্খলায়। ট্রেন চলতে শুরু করলো, আবার সেই সবুজ মাঠ, আবার সেই নীরবতা। কিন্তু এবার সেই দৃশ্য আর আগের মতো ছিল না। এবার তা ছিল ছোঁয়া গন্ধমাখা, স্মৃতির আলোয় রাঙানো। ডা. পারভেজ ভাই চোখ বুঝে বললেন, ‘টনডারে শুধু চোখে দেখিনি, মনেও রেখেছি।’
এই সফর ছিল কয়েক ঘণ্টার, কিন্তু সময়ের দৈর্ঘ্য দিয়ে সব অনুভূতি মাপা যায় না। টনডারে গিয়ে চিকিৎসকরা হয়ত একটিবারের জন্য নিজেদের রোগী করে তুলেছিলেন— যাদের দরকার ছিল নিশ্বাস, নিঃশব্দতা আর একটু আলতো ছোঁয়া।
এই সফরের মানে ছিল না পাসপোর্টে স্ট্যাম্প বাড়ানো বরং হৃদয়ে এক পৃষ্ঠা যোগ করা—যেখানে লেখা থাকবে, ‘সেদিন এক সকালে আমরা ট্রেনে চেপে নিজেদের একটু ভালোবাসতে গিয়েছিলাম।’
লেখক: সাংবাদিক ও গবেষক
এমআরএম/জেআইএম