আইন-আদালত

রমনায় বোমা হামলা: ২ জনের যাবজ্জীবন, বাকিদের ১০ বছর সাজা

রমনায় বোমা হামলা: ২ জনের যাবজ্জীবন, বাকিদের ১০ বছর সাজা

বহুল আলোচিত ২০০১ সালে রমনা বটমূলে বর্ষবরণ অনুষ্ঠানে বোমা হামলা মামলায় মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামি মাওলানা তাজ উদ্দিন ও যাবজ্জীবন দণ্ড থেকে শাহাদাত জুয়েলকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দিয়ে রায় ঘোষণা করেছেন হাইকোর্ট। সাজাপ্রাপ্ত অন্য আসামিদের ১০ বছর করে সাজা দেওয়া হয়েছে।

Advertisement

মামলায় মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত সাত আসামির সাজা কমেছে। এই সাত আসামির মধ্যে একজনের সাজা কমিয়ে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড এবং বাকি ছয়জনকে ১০ বছর করে কারাদণ্ড দিয়েছেন হাইকোর্ট।

বিচারিক আদালতে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত সাবেক উপমন্ত্রী আবদুস সালাম পিন্টুর ভাই মো. তাজউদ্দিনের সাজা কমিয়ে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছে। এই মামলায় বিচারিক আদালতে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত অপর আসামি মুফতি আব্দুল হান্নানের ফাঁসি আগেই অন্য মামলায় (সিলেটে গ্রেনেড হামলা মামলা) কার্যকর হয়েছে। তার আপিল পরিসমাপ্ত বলে ঘোষণা করেছেন হাইকোর্ট।

বিচারিক আদালতের রায়ে যাবজ্জীবন দণ্ডিত ছয় আসামির মধ্যে শাহাদাতউল্লাহ জুয়েলের দণ্ড বহাল রেখেছেন হাইকোর্ট। যাবজ্জীবন দণ্ডিত অন্য তিন আসামির সাজা কমিয়ে ১০ বছর করে কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছে। আর দুই আসামি মারা যাওয়ায় তাদের আপিল পরিসমাপ্ত ঘোষণা করা হয়েছে।

Advertisement

মঙ্গলবার (১৩ মে) হাইকোর্টের বিচারপতি মোস্তফা জামান ইসলাম ও বিচারপতি নাসরিন আক্তারের সমন্বয়ে গঠিত বেঞ্চ এই রায় ঘোষণা করেন।

আর বিচারিক আদালতে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আকবর হোসেন, আরিফ হাসান, হাফেজ জাহাঙ্গীর আলম বদর, আবু বকর ওরফে হাফেজ সেলিম হাওলাদার, আবদুল হাই, শফিকুর রহমান এবং বিচারিক আদালতে যাবজ্জীবন কারাদণ্ডপ্রাপ্ত সাব্বির, শেখ ফরিদ ও আবু তাহেরের সাজা কমিয়ে ১০ বছরের কারাদণ্ড ও ৫০ হাজার টাকা জরিমানা করেছেন হাইকোর্ট।

আরও পড়ুন

রমনা বটমূলে বোমা হামলা: রায়ের শেষ অংশ ঘোষণা চলছে রমনার বটমূলে বোমা হামলা মামলার বিচার ২৩ বছরেও শেষ হয়নি

তবে বিচারিক আদালতে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত মুফতি হান্নান (সিলেটে গ্রেনেড হামলা মামলায় মৃত্যুদণ্ড কার্যকর) এবং বিচারিক আদালতে যাবজ্জীবন কারাদণ্ডপ্রাপ্ত আবদুর রউফ ও ইয়াহিয়া মারা যাওয়ায় তাদের বিচারিক কার্যক্রম থেকে বাদ দেওয়া হয়।

Advertisement

আসামিদের ডেথ রেফারেন্সের (মৃত্যুদণ্ড অনুমোদন), আপিল ও জেল আপিলের ওপর শুনানি শেষে হাইকোর্ট ৮ মে রায় ঘোষণা শুরু করেন। রায় ঘোষণার শুরুতে আদালত বলেন, রায়ে এদিন ঘটনা ও সাক্ষী পর্যালোচনা করা হবে। বাকিটা (রায়) পরবর্তী তারিখে হবে। সেদিন রায় ঘোষণার পর আদালত পরবর্তী রায় ঘোষণার জন্য আজ (১৩ মে) দিন ধার্য রাখেন। গত বৃহস্পতিবার (৮ মে) প্রথম দিন মামলার সাক্ষ্য ও জেরাসহ আংশিক রায় পাঠ করেন এবং বাকি অংশ ঘোষণার জন্য ১৩ মে দিন ঠিক করেন হাইকোর্ট। এরই ধারাবাহিকতায় আজ রায় ঘোষণা করেন আদালত।

হাইকোর্টের দেওয়া এই রায়ের বিরুদ্ধে আসামি ও রাষ্ট্রপক্ষ দুই পক্ষই আপিল করার ঘোষণা দিয়েছেন। আদালতে আসামিপক্ষে ছিলেন জ্যেষ্ঠ আইনজীবী এস এম শাহজাহান ও সরওয়ার আহমেদ এবং আইনজীবী মোহাম্মদ শিশির মনির। রাষ্ট্রপক্ষে শুনানি করেন ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল সুলতানা আক্তার রুবী।

এর আগে আসামিদের ডেথ রেফারেন্স (মৃত্যুদণ্ড অনুমোদন) ও আপিলের ওপর শুনানি শেষে গত ১৮ ফেব্রুয়ারি হাইকোর্ট মামলাটি রায়ের জন্য অপেক্ষমাণ (সিএভি) রাখেন। এরপর গত ৩০ এপ্রিল বিষয়টি আদেশের জন্য আদালতের কার্যতালিকায় উঠেছিল। সেদিন আদালত রায়ের জন্য গত বৃহস্পতিবার (৮ মে) দিন ঠিক করেন। সে অনুসারে বৃহস্পতিবার রায় ঘোষণা শুরু করেন হাইকোর্ট। আজ মঙ্গলবার রায় ঘোষণা শেষ হয়।

২০০১ সালের ১৪ এপ্রিল রমনা বটমূলে ছায়ানটের বর্ষবরণ অনুষ্ঠানে বোমা হামলা চালানো হয়। এতে ঘটনাস্থলেই নয়জনের মৃত্যু হয়। পরে হাসপাতালে মারা যান একজন। এ ঘটনায় নীলক্ষেত পুলিশ ফাঁড়ির সার্জেন্ট অমল চন্দ্র চন্দ ওইদিনই রমনা থানায় হত্যা ও বিস্ফোরক আইনে দুটি মামলা করেন।

২০০৮ সালের ৩০ নভেম্বর দুই মামলায় ১৪ জনকে আসামি করে আদালতে অভিযোগপত্র দাখিল করে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি)। সাক্ষ্যগ্রহণ শেষে ২০১৪ সালের ২৩ জুন বিচারিক আদালত হত্যা মামলার রায় ঘোষণা করেন। এরপর ডেথ রেফারেন্স এবং আসামিদের জেল আপিল ও ফৌজদারি আপিলের শুনানির জন্য মামলাটি হাইকোর্টে আসে।

হত্যা মামলার রায় ঘোষণা হলেও বিস্ফোরক মামলাটি ঢাকার দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালে বিচারাধীন রয়েছে।

এ মামলায় বিচারিক আদালত নিষিদ্ধ ঘোষিত জঙ্গি সংগঠন হরকাতুল জিহাদের (হুজি) শীর্ষ নেতা মুফতি হান্নানসহ আটজনের বিরুদ্ধে মৃত্যুদণ্ডাদেশ এবং ছয়জনকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ডাদেশ দেন।

ফাঁসির দণ্ডপ্রাপ্ত আসামিরা হলেন, মুফতি আব্দুল হান্নান, মাওলানা আকবর হোসেন, আরিফ হাসান সুমন, মাওলানা তাজউদ্দিন, হাফেজ জাহাঙ্গীর আলম বদর, মাওলানা আবু বকর ওরফে মাওলানা হাফেজ সেলিম হাওলাদার, মাওলানা আবদুল হাই ও মাওলানা শফিকুর রহমান। এর মধ্যে সিলেটে গ্রেনেড হামলার মামলায় মুফতি হান্নানের মৃত্যুদণ্ড এরই মধ্যে কার্যকর করা হয়েছে।

যাবজ্জীবন দণ্ডিত ব্যক্তিরা হলেন, শাহাদাতউল্লাহ জুয়েল, সাব্বির, শেখ ফরিদ, আবদুর রউফ, ইয়াহিয়া ও আবু তাহের।

ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল সুলতানা আক্তার রুবী বলেন, এটি একটি জঘন্যতম হত্যাকাণ্ড। নববর্ষ একটি সার্বজনীন উৎসব। কিন্তু যারা সভ্যতাকে অস্বীকার সাংস্কৃতিক অধিকারকে স্বীকার করে সেই হুজি-বি ২০০১ সালে ১৪ এপ্রিল রাজধানীর রমনা বটমূলে ন্যক্কারজনকভাবে বোমা হামলা করে। ১০ জনের হত্যা এবং শত শত মানুষকে আহত করে। সেই ঘটনার রায়ে ১৪ জনের মধ্যে আটজনের মৃত্যুদণ্ড ছিল। আর ছয়জনের যাবজ্জীবন ছিল। হাইকোর্টে শুনানি শেষে আজ দুইজনের যাবজ্জীবনের রায় দিয়েছেন। এরই মধ্যে দুইজন মারা গেছেন। আর একজনের অন্য মামলায় ফাঁসি কার্যকর হওয়ায় তিনজনকে এ মামলা থেকে বাদ দেওয়া হয়। বাকি নয়জনকে ১০ বছরের কারাদণ্ড দিয়েছেন এবং ৫০ হাজার টাকা জরিমানা করা হয়েছে। আর যাদের ১০ বছর করে কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছে তাদের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রপক্ষ আপিল করবেন।

সিনিয়র আইনজীবী এস এম শাহজাহান পাঁচজন আসামির পক্ষে শুনানিতে ছিলেন। তিনি তাদের পক্ষে আপিল আবেদন করবেন।

আইনজীবী মুহাম্মদ শিশির মনির বলেন, যাবজ্জীবন দণ্ডিত দুইজনের মধ্যে একজন পলাতক। এই মামলায় আমরা বলেছিলাম এই মামলায় এভিডেন্স বলতে কিছু নেই। হাইকোর্টের তিনটি বেঞ্চে ঘুরে চতুর্থ বেঞ্চে ৪৬৭ বার সময় নেওয়ার পর আজকে রায় ঘোষণা করা হয়েছে। যে তিনজন স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন সেখানে পরস্পর বিরোধী কথাবার্তা থাকার পরও তাদের ১০ বছরের সশ্রম কারাদণ্ড দিয়েছেন। আমরা মনে করি হাইকোর্টের এই রায় সঠিক হয়নি। হয়ত লিগ্যাল এভিডেন্স না পেয়ে হাইকোর্ট বিভাগ নৈতিকভাবে সাজা দিয়েছেন। আইনের দৃষ্টিকোণ থেকে সাক্ষ্য প্রমাণের ভিত্তিতে নয়। আমার আসামিদের সাজা খাটা হয়ে গেছে। তারপরও পূর্ণাঙ্গ অনুলিপি পাওয়ার পর উপযুক্ত সময়ে আপিল করবো।

এফএইচ/এমআইএইচএস/এমএস