স্বাস্থ্য

৫০% শিক্ষার্থী পর্যাপ্ত প্রস্তুতি ছাড়াই পাস, নিম্নমানের গবেষণা

৫০% শিক্ষার্থী পর্যাপ্ত প্রস্তুতি ছাড়াই পাস, নিম্নমানের গবেষণা

দেশে বেসরকারি মেডিকেল কলেজের ৫০ শতাংশ শিক্ষার্থী পর্যাপ্ত প্রস্তুতি ছাড়াই পাস করছেন। মেডিকেল কলেজগুলোর জন্য জার্নালে গবেষণা প্রকাশ বাধ্যতামূলক করার ফলে অনেক নিম্নমানের গবেষণা হচ্ছে, যা সম্পদের অপচয় এবং দেশের বৈজ্ঞানিক অগ্রগতিতে কার্যকর অবদান রাখতে ব্যর্থ হচ্ছে।

Advertisement

এছাড়া বেসরকারি মেডিকেল কলেজের লাইসেন্স প্রদান প্রক্রিয়া ধীরগতির, যা প্রায়ই ছয় মাসের বেশি সময় নেয়। ফলে এ খাতে দক্ষ পেশাজীবীর ঘাটতি বৃদ্ধি পায়।

স্বাস্থ্যবিষয়ক সংস্কার কমিশনের প্রতিবেদনে এসব তথ্য উঠে এসেছে। বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যান্ড ডেন্টাল কাউন্সিলের (বিএমডিসি) বার্ষিক প্রতিবেদন-২০২০ এর বরাত দিয়ে কমিশনের প্রতিবেদনে এসব তথ্য জানানো হয়।

জাতীয় অধ্যাপক ও বাংলাদেশ ডায়াবেটিক সমিতির সভাপতি অধ্যাপক একে আজাদ খানকে সভাপতি করে গঠিত ১২ সদস্যের বিশেষজ্ঞ কমিটি গত ৫ মে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের কাছে তাদের প্রতিবেদন জমা দেয়। প্রতিবেদনে স্বাস্থ্যখাতের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের দুর্বলতা ও তা দূরীকরণে বিভিন্ন সুপারিশ তুলে ধরা হয়।

Advertisement

স্বাস্থ্যবিষয়ক সংস্কার কমিশনের প্রতিবেদনে বিএমডিসি সম্পর্কে বলা হয়, প্রতিষ্ঠানটি শাসনব্যবস্থায় বড় ধরনের চ্যালেঞ্জ রয়েছে, যা স্বাস্থ্যসেবা প্রধানের কার্যকারী তাকে ক্ষতিগ্রস্ত করে। যদিও মেডিকেল শিক্ষা ও চিকিৎসা পেশাজীবীদের লাইসেন্স প্রদান নিয়ন্ত্রণ করে, তবু এটি পর্যাপ্ত তদারকির অভাবে ভুগছে বলে উল্লেখ করা হয়।

প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, বিএমডিসি বাংলাদেশের স্নাতকোত্তর ও স্নাতকোত্তর পর্যায়ের মেডিকেল ডিগ্রির পাঠ্যক্রম অনুমোদনের দায়িত্বপ্রাপ্ত সংস্থা। কিন্তু দেশে বিভিন্ন মেডিকেল কলেজে পাঠ্যক্রম বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে সামঞ্জস্য ও কার্যকারিতার ঘাটতি রয়েছে। ফলে চিকিৎসা শিক্ষার মান অসম হয়ে পড়ছে। এই শাসন ঘাটতির পাশাপাশি দুর্বল পর্যবেক্ষণ ব্যবস্থার কারণে কর্মক্ষেত্রে প্রবেশ করা স্বাস্থ্যসেবাকর্মীদের মানেও বৈষম্য দেখা যায়। 

এছাড়া মেডিকেল ভর্তি পরীক্ষা ও অন্যান্য পরীক্ষার শাসনব্যবস্থা প্রায়ই স্বচ্ছতা ও ন্যায্যতার অভাবে সমালোচিত হয়, যা দুর্বল মানের শিক্ষার্থী ভর্তি হওয়ার একটি বড় কারণ বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়।

আরও পড়ুননারীদের স্বাস্থ্যসেবা আরও সহজ ও সম্মানজনক করে তুলতে হবেস্বাস্থ্যখাতে ক্রয় পদ্ধতির দুর্নীতি অন্যতম বড় ব্যর্থতা!অর্ডিন্যান্স আকারে আইন করে বাংলাদেশ হেলথ সার্ভিস গঠনের সুপারিশ

প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যান্ড ডেন্টাল কাউন্সিল, মেডিকেল অ্যাসিস্ট্যান্ট ট্রেনিং স্কুল (ম্যাটস)-এর মতো প্রতিষ্ঠান থেকে প্রাপ্ত যোগ্যতাগুলোর ওপর কর্তৃত্ব রাখতেও সমস্যায় পড়ে, যার ফলে স্বাস্থ্যসেবাকর্মীদের মান নিয়ন্ত্রণ আরও জটিল হয়ে পড়ে। যে ব্যক্তি স্বীকৃত এমবিবিএস বা বিডিএস ডিগ্রিপ্রাপ্ত নন, তিনি যদি চিকিৎসা অনুশীলন করেন, তবে তা আইনত বেআইনি কার্যক্রম হিসেবে গণ্য হবে। এমবিবিএস বা বিডিএস ডিগ্রি ব্যতীত কেউ নিজেকে চিকিৎসক পরিচয়ে রোগী দেখতে পারবেন না।

Advertisement

বিএমডিসি এ বিষয়ে একটি চিঠি প্রদান করে বিষয়টি অবহিত করবে এবং অন্যান্য সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলিকে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়ার অনুরোধ জানাবে।

কোনো বিদেশি চিকিৎসক যদি বিএমডিসির অনুমতি ব্যতিরেকে বাংলাদেশে চিকিৎসা অনুশীলন করেন, তবে তা অননুমোদিত ও বেআইনি কার্যক্রম হিসেবে গণ্য হবে। বিএমডিসি কারও ডিগ্রির স্বীকৃতি ও পেশাগত যোগ্যতা যাচাই না করা পর্যন্ত কাউকে চিকিৎসা প্রদানের অনুমতি দিতে পারে না।

মেডিকেল এথিকস কমিটি এবং রিপোর্টিং গাইডলাইন থাকা সত্ত্বেও অনিয়ম ও অনৈতিক আচরণের বিরুদ্ধে বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যান্ড ডেন্টাল কাউন্সিলের প্রয়োগক্ষমতা দুর্বল। দেরি ও জবাবদিহির অভাবে বহু অনিয়মের অভিযোগ নিষ্পত্তি হয় না।

এছাড়া বিএমডিসি একটি বিচ্ছিন্ন ব্যবস্থায় কাজ করে যেখানে অন্যান্য নিয়ন্ত্রক সংস্থার সঙ্গে সমন্বয় অত্যন্ত দুর্বল, ফলে অকার্যকারিতা আরও বাড়ে।

কমিশনের প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, চিকিৎসকদের বিরুদ্ধে অভিযোগ নিষ্পত্তি প্রক্রিয়াকে দ্রুত, স্বচ্ছ এবং কার্যকর করতে একটি আধুনিক ডিজিটাল অভিযোগ নিষ্পত্তি প্ল্যাটফর্ম গড়ে তোলা জরুরি। এই প্ল্যাটফর্মের মাধ্যমে অভিযোগকারীরা সহজে অনলাইনে অভিযোগ দায়ের এবং প্রতিটি অভিযোগের অগ্রগতি পর্যবেক্ষণ করতে পারবেন। এতে স্বয়ংক্রিয় অভিযোগ শ্রেণিবিন্যাস, নির্ধারিত সময়সীমার মধ্যে তদন্ত ও সিদ্ধান্ত গ্রহণের ব্যবস্থা থাকবে।

পাশাপাশি, তথ্যপ্রযুক্তি নির্ভর এই ব্যবস্থার মাধ্যমে সেবাপ্রদানকারীর এবং অভিযোগকারীর পরিচয় গোপন রেখে নিরপেক্ষতা নিশ্চিত করা যাবে। এই প্ল্যাটফর্ম স্বাস্থ্যখাতের জবাবদিহি ও নৈতিকতা নিশ্চিত করার পাশাপাশি জনগণের আস্থা বৃদ্ধিতেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে। বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যান্ড ডেন্টাল কাউন্সিলের আইনগত ক্ষমতা ও কাঠামোকে আরও কার্যকর করে শুধু নিবন্ধন নয়, বরং নীতি প্রণয়ন, প্রশিক্ষণ এবং মূল্যায়ন প্রতিষ্ঠানে রূপান্তর করা জরুরি।

কমিশন জানায়, বিএমডিসির তত্ত্বাবধানে একটি ডিজিটাল অভিযোগ প্ল্যাটফর্ম চালু করতে হবে, ১৬২৬৩ কল সেন্টারকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেওয়া, আইনগত ক্ষমতা প্রদান করা এবং বিকেন্দ্রীকরণ করে বিভাগীয় পর্যায়ে অফিস চালু করা। রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যান্ড ডেন্টাল কাউন্সিলের স্বাধীনতা ও কার্যকারিতাকে আরও ক্ষতিগ্রস্ত করে।

বিএমডিসির বার্ষিক প্রতিবেদন (২০২০) অনুযায়ী, ১০০টিরও বেশি অনিয়ম সংক্রান্ত অভিযোগের মধ্যে মাত্র ৩৫ শতাংশ সময়মতো নিষ্পত্তি হয়। এই শাসন সংক্রান্ত সমস্যাগুলো এবং অনিয়ম ও নিয়ন্ত্রণমূলক পদক্ষেপ ব্যবস্থার কেন্দ্রীভূত কাঠামো, স্বাস্থ্যখাতে জরুরি প্রতিক্রিয়া প্রদানের পথে বড় প্রতিবন্ধক হয়ে দাঁড়ায়। জবাবদিহির অভাব, সিদ্ধান্ত গ্রহণে বিলম্ব এবং মান বজায় রাখার অনির্ধারিত প্রয়োগ রোগীর নিরাপত্তা এবং দেশের স্বাস্থ্যসেবার সামগ্রিক মানকে ব্যাহত করে।

তাই স্বাস্থ্যখাতে ভালো ফলাফল নিশ্চিত করতে প্রক্রিয়া সহজীকরণ, সমন্বিত মানদণ্ডের প্রয়োগ এবং নিয়ন্ত্রক সংস্থাগুলোর মধ্যে সমন্বয় বৃদ্ধির লক্ষ্যে অবিলম্বে সংস্কার প্রয়োজন বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়।

এমইউ/ইএ/জেআইএম